দেশের মানুষ কতটা অনিরাপদ এয়ারপোর্ট সড়কের উত্তরায় চলন্ত গাড়ির উপর উড়াল সেতুর গার্ডার পড়ে ৫ জন মানুষের মৃত্যু তার প্রমাণ। আরো প্রমাণ পুরান ঢাকায় প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লেগে ঘুমন্ত ৬ শ্রমিক অঙ্গার হওয়ার ঘটনা। ওদিকে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অপ্রতিরোধ্য। ডিমের হালি জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে ৫০ থেকে ৭০ টাকা। চাল, তেল, তরকারির দাম আকাশ ছোঁয়ার পরও আমরা বেহেশতে আছি, এমন গল্প শোনান আমাদেরই এক মন্ত্রী। পণ্যের মূল্য চড়া এদেশে; মানুষের মূল্য একদম নেই। মানুষের মূল্য নেই তাই পথে-ঘাটে মানুষ মরে। আর কতকাল এদেশের মানুষ এই দৃশ্য দেখবে, এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের কাছে করতেই হয়।
বাংলাদেশ যেন অব্যবস্থাপনা আর দুর্ঘটনার স্বর্গরাজ্য। প্রতিদিনই অবহেলা আর অব্যবস্থাপনায় সড়কপথে, নৌপথে কিংবা শিল্পকারখানায়, ঘরে-বাইরে অথবা যে কোনো জনসমাগমস্থলে মায়ের কোল খালি হচ্ছে। এটিই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্ঘটনা এখন দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এভাবে আর চলতে পারে না, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না।
বিয়ের পর কনের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছিলেন বর-কনেসহ স্বজনরা। চলতি পথে রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার চাপায় গাড়িতেই মৃত্যু হয়েছে তাদের ৫ জনের। গার্ডার পড়ে এদেশে বহু প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। এর আগে চট্টগ্রাম শহরে ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘ ৯ বছর ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। যদিও মামলার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি)।
রাজধানীর উত্তরার ঘটনায় এখন দেখছি হৈ চৈ হচ্ছে বেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, এটাতেও কারো দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মেয়র আতিকুল ইসলাম উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখার কথা বলে দায় সেরেছেন। তার চোখের সামনেইতো বেষ্টনী ছাড়া দীর্ঘদিন এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হচ্ছে। বহু দুর্ঘটনাও ঘটছে। তিনিও কি এ দায় এড়াতে পারবেন? সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতনদের নানা বক্তব্য শুনে মনে হয় তারা যেন দুধে ধোয়া। সবাই চায়না ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) উপর দায় চাপাচ্ছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি’র দায় আছে। তবে এসব যারা দেখবেন তাদের দায়টা একটু বেশি। প্রশ্ন হলো, তাদের চোখের সামনে চায়না প্রতিষ্ঠান মানুষের জানমাল অনিরাপদ রেখে কাজ করে কী করে? সরকার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে বুঝা যায়, এবারও সবাই অন্যের উপর দায় চাপিয়ে পার পেয়ে যাবেন।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার একেএম মনির হোসেন পাঠান পত্রিকায় বলেছেন, সড়ক নিরাপত্তা যেকোনো কনস্ট্রাকশন কাজের অন্যতম সেফটি ইস্যু। এগুলো ছাড়া কোনো চুক্তি হয় না। চুক্তির মধ্যে আছে ঠিকাদার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ইস্যুগুলো নিশ্চিত করার পরই কেবল কাজে যেতে পারবে। সেগুলো কনফার্ম করেছে কি না, সেটি যাচাই করার জন্য কনসালটেন্ট আছে, প্রজেক্ট পার্সন আছে। দাতা সংস্থা এডিবির (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) কনসালটেন্টও আছে। তারাও বিষয়গুলো মনিটর করে। তারা যাচাই করে দেখবে, সেফটি মেজারমেন্টগুলো ঠিক আছে কি না, যদি সেগুলো ঠিকমত কাজ করে তাহলে সে কাজ করার অনুমতি পাবে। অন্যথায় পাবে না। প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্টরা এ দায়িত্ব কি পালন করেছেন? সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার যে এসব বললেন, তিনিও কি এ দায় কোনভাবে এড়াতে পারেন?
সরকারের সবচেয়ে অগ্রাধিকারের এ কাজে এমন দুর্ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক। এটা নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। তাই প্রশ্ন উঠছে এটা দুর্ঘটনা, নাকি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড? সেখানে গার্ডার তুলতে যে ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে, এটাকে ‘ক্রলার ক্রেন’ বলা হয়। গার্ডার বা ভারী কোনো জিনিস তোলার সময় ক্রেনের ব্যবহারের সময় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু এর ফলে যেন প্রাণহানি না হয়, তার জন্য নিরাপত্তাবেষ্টনী অত্যাবশ্যকীয় একটি শর্ত। সেটা উত্তরায় মানা হয়নি। অনেকটা জনগণকে অনিরাপদ রেখেই দীর্ঘদিন ধরে সবার চোখের সামনে কাজ চলছে। এ দায় কেবল সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানেরই নয়। যারা এর দেখভাল করেন, তাদের দায়ও। এত বড় একটা কাজ, যে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা মোটেও পর্যাপ্ত ছিল না। যখন কোনো ড্রেন সংস্কারের মতো কাজ হয়, সেখানেও কোনো ফিতা দিয়ে এলাকা ঘিরে রাখা হয়। দুই পাশে লোকবল রাখা হয় ব্যবস্থাপনার জন্য। আর এখানে এত বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হচ্ছে, সেখানে নিরাপত্তাবেষ্টনী বলতে কিছু ছিল না। বিষয়টাকে একেবারেই অবহেলা করা হয়েছে।
পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ডে মানুষ পুড়ে অঙ্গার হওয়ার কথা আর কত বলব? সেখানকার প্লাস্টিক কারখানা আর কেমিক্যাল গোডাউনের কথা কার না জানা? মাঝে মধ্যেই আগুন লেগে মানুষ মরে। তাতে কারো এসে যায় না কিছুই। সেদিনও ঘুমন্ত ৬ শ্রমিক পুড়ে মরলো। এর দায় নেবে কে? প্রতি বছর আগুনে পুড়ে মানুষ মরলেও কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সেখানে রয়ে গেছে সংশ্লিষ্টদের পয়সা দিয়ে যথাস্থানে। তাহলে তো মানুষ মরবেই। কোনভাবেই আগুনের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলছে না পুরান ঢাকাবাসীর। এর আগে পুরান ঢাকার নিমতলী কিংবা চুড়িহাট্টাই নয়, পুরান ঢাকার অলি-গলিতে প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল থেকে লাগা অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডে পুড়েছে শত শত প্রাণ। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৬৭ জন। এর নয় বছর আগে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিল ১২৪ জন। এ দুই ঘটনার জন্যই দায়ী করা হয় অবৈধভাবে কেমিক্যালের গুদামের ব্যবসাকে। আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক কারখানা ও প্লাস্টিক গুদাম করা আইনত নিষিদ্ধ হলেও পুরান ঢাকার রাসায়নিক বাণিজ্য কার কব্জায়? স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে। গত এক দশকে পুরান ঢাকায় আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে প্রায় দেড় হাজার মানুষ (১৪৯৩ জন)। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ২০১১ সালে ৩৬৫ জন। এক দশকে আগুনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ২৮৬ কোটি, ৮৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৪ টাকা। তারপরেও প্লাস্টিক ও কেমিক্যালের কারখানায় চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে পুরান ঢাকার মানুষ।
মৃত্যুর ধরন যাই হোক, সরকারি খাতায় সেগুলো অপঘাত বা দুর্ঘটনা বলে চালানো হলেও এর সবই সংশ্লিষ্টদের অবহেলাজনিত মৃত্যু। কেবল তদন্ত করলেই চলবে না, জড়িতদের আইনের আওতায় এনে কঠোর দণ্ড নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহি-দায়বদ্ধতাও নিশ্চিত করতে হবে। আর কত প্রাণ ঝরে গেলে কর্তৃপক্ষ দায় বোধ করবে, জানি না। সংশ্লিষ্টদের নিদ্রা ভঙ্গ হলেই এ প্রশ্নের জবাব মিলবে। এভাবে একের পর এক দেশের মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে, আর সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন তা হতে পারে না।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সমাজ গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন