বিশ শতকের সূচনা লগ্ন। চারদিকে চলছে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধি আন্দোলন। এ পর্যায়ে প্রকৃত স্বাধীনতার কথা ভারতবাসী তথা বাংলার মানুষদের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বাঙ্গালীর দ্বিতীয় জাগরণের পর্যায়ক্রম ধারা তখন সবে শুরু হয়েছে বলা যায়। যার মূল ভূমিকা মুসলিম সাহিত্য সমাজকে কেন্দ্র করে। ঐ সময় নিজের পত্রিকা ‹গণবাণী›-তে ১৯২৬ সালে নজরুল লিখলেন- হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই-ই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়।গ্ধ (হিন্দু মুসলমান- কাজী নজরুল ইসলাম, (গণবাণী, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬)সবরকম ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি সর্বদা চেয়েছেন জাতপাতের ঊর্ধ্বে মানবধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে। হয়তো এ কারণে তাঁর বলিষ্ঠ উচ্চারণ, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া,/ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।/হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি-ভাব্লি এতেই জাতির জান,/তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে এক শ’-খান!/এখন দেখিস্ ভারত জোড়া প’চে আছিস বাসি মড়া,/মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া।’ নজরুল সাম্যবাদ এবং ধর্মীয় নিরপেক্ষতার পূজারি ছিলেন। ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামীর ও সাম্প্রদায়িকতার র্উবেধ।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর (১৬ জুন, ১৯২৫) বাংলার রাজনৈতিক পরিমন্ডল যখন ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিমজ্জিত হতে শুরু করে। সেই সময়ে বাংলার আনাচেকানাচে দাঙ্গার অন্যতম কারণ হিসেবে হিন্দুদের মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো আর মুসলমানেদের গরু কোরবানির ঘটনাক্রম একটা বড় রকমের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে থাকে। এই দুটি বিষয়কেই কঠোরতম সমালোচনা করেন নজরুল যে সতর্কতার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তেমনভাবে সেই সময়ে মানুষকে খুব কম জনই সতর্ক করেছিলেন।
নজরুল ধর্মকে কখনোই রাজনীতির সাথে মিলিয়ে দেননি। অবশ্য এজন্যে মুসলমান সমাজের একটা অংশের ভয়ংকর ক্রোধের মুখোমুখি নজরুলকে হতে হয়েছিল। তবুও তিনি আপোস করেননি। ‹ধূমকেতু›র সম্পাদক হিসেবে রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তিনি যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তা গোটা বিশ্বের রাজদ্রোহীদের সেরা দশটি জবানবন্দির ভেতর একটি। এই দৃঢ়তা, নির্ভীকতা এবং আদর্শবাদিতা- সমসাময়িককালে খুব অল্প মানুষে ভেতরেই পাওয়া যায়। মুসলমানদের রক্ষণশীল অংশ নজরুলকে অভিহিত করেছেন ‹নাস্তিক› হিসেবে। কেউ কেউ নজরুলকে সাম্প্রদায়িক বলতেও ছাড়েন নি । নজরুল মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন স্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে বনে-জঙ্গলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন-“কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’/কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?/হায় ঋষি দরবেশ,/বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ- দেশ।/সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,/স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!/ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেশ দর্পণে নিজ-কায়া,/ দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া।”
যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার শিক্ষা তা তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন এবং তার লিখনীতে তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি লিখেছেন-“নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।/নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গির্জা-ঘর,/নাইকো পাইক-বরকন্দাজ নাই পুলিশের ডর।/এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশ্ত, এখানে বিভেদ নাই,/যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই!/ নেইকো এখানে ধর্মের ভেদ শাস্ত্রের কোলাহল,/পাদরি-পুরুহিত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।/হেথা স্রষ্টার ভজনা-আলয় এই দেহ এই মন,/ হেথা মানুষের বেদনায় তাঁর দুখের সিংহাসন!/সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে-নামে যে-কেহ ডাকে,/যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে-নামে ডাকে সে মাকে!/পায়জামা প্যান্ট ধুতি নিয়া হেথা হয় নাকো ঘুঁষোঘুঁষি,/ধুলায় মলিন দুখের পোশাকে এখানে সকলে খুশি।”
জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। তাইতো লিখতে পেরেছেন, গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/ যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।’ তিনি লিখেছিলেন ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধ থেকে আরো স্পষ্ট হয় নজরুল যে কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন: “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের ভিতর বাস করা মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুন্ন হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।’
অসামপ্রদায়িকতা আরো স্পষ্ট হয় যখন কবি লিখেন, ‘আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই আমি এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল মানুষের। কবি চায়না দান,কবি চায় অঞ্জলী ,কবি চায় প্রীতি। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভারা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে ক্ষুধা দীর্ন মুর্তিতে ব্যথিত পায়ে তাকে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি,কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি। কবি নজরুল তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে, তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে’। বাস্তবতার নিরিখে আমরা জেগে আছি না ঘুমিয়ে আছি সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। আমরা কি দেশ মাকে এমন কথা আর বলতে পারবো না? আমরা যদি এইভাবে সব দেখে শুনেও চোখ বন্ধ করে থাকি, তাহলে কি সত্যিকার রাত পোহাবে? সাম্প্রদায়িকতার কড়ালগ্রাস থেকে মুক্তি মিলবে? আমাদের সামনের আঁধার দূর করতে হলে নজরুলকে নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের টানাটানি বন্ধ করতে হবে। নজরুল ইসলামকে তাঁর দর্শন ও চিন্তার জায়গায় রাখতে হবে। নজরুলকে সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে রাখতে হবে। আমাদের এই দেশে যে হারে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটছে। সময় এসেছে গোটা দেশে কবির অসাম্প্রদয়িক চিন্তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার, নজরুল চর্চা বাড়িয়ে দেওয়ার,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নেওয়ার। এ ব্যাপারে সরকারী উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি থাকতে হবে। আমরা চাই সংস্কৃতিবান্ধব সরকার কবি নজরুলের সামগ্রিক সৃষ্টি সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হবেন।চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ুক নজরুলের চেতনা। দূর হোক সাম্প্রদায়িক অমানিশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন