শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

কবির জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক চেতনা

সমর আরিফ | প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) যে এক বিশিষ্ট স্থানে সমাসীন সে বিষয়টি সাহিত্যবোদ্ধাগণ ও গবেষকগণ বিনা বাক্যব্যয়ে স্বীকার করে নেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশমাতৃকার বেহাল দশা দেখে কবি নজরুল ইসলাম দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করলেন সত্যিকার মুক্তির জন্য ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। তাই তাঁর প্রথম চেষ্টা ছিল শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মাঝে জাতীয়তাবোধের চেতনা সৃষ্টি করা এবং তা বিদ্রোহীভাব ধারণ করার মাধ্যমে সম্ভব। তিনি লিখলেন অগ্নিবীণা কাব্য (১৯২২)। তৎকালীন ভারতবর্ষে এর আগে কোনো কবি এভাবে মানুষের স্বাধীনতার চেতনায় ধাক্কা দিতে পারেননি।
অগ্নিবীণার মাধ্যমে কবি মূলত তিনটি বিষয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন- ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ, ব্রিটিশ শাসন-ত্রাসন এবং যত অনাচার, নিয়ম-শৃংখল। তিনি এও প্রতিজ্ঞা করেন যে যতদিন এ পৃথিবীতে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হবে এবং অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ’ থামবে না, ততদিন তিনি শান্ত হবেন না। সাহিত্যমানেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি অনন্য। প্রত্যহিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ থেকে শুরু করে পৌরাণিক বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা এবং বৈচিত্র্যময় অলঙ্কার ও ছন্দ কবিতাটিকে দিয়েছে অনন্য উচ্চতা। এটি শুধু বাংলা সাহিত্যের সম্পদ নয়, বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারে করে নিয়েছে জায়গা। অগ্নিবীণার বারোটি কবিতায় তিনি একইসাথে ইসলামি ঐতিহ্যমন্ডিত বিষয়বস্তু ও হিন্দু ঐতিহ্যের শব্দ প্রয়োগ করে দুটি সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করেন-যাতে সামষ্টিকভাবে স্বাধীনতার সংগ্রামে সম্পৃক্ত করা যায়। এটি তাঁর সাহিত্য দর্শনের একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য যা সমসাময়িক অন্যান্যদের লেখায় একেবারেই বিরল।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার দুটি পঠন রীতি উন্মোচন করা যায়। এক, আমিত্ব অর্থাৎ আমি নিজেই বিদ্রোহী হিসেবে রুদ্রমূর্তি ধারণ করবো এবং শোষক ব্রিটিশদের উপনিবেশ ও আইন অমান্য করবো। দুই, কবি অন্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে ‹বল বীর› শব্দটি সচেতনভাবে ব্যবহার করেন যাতে প্রত্যেককে গণ-অভ্যুত্থানে সম্পৃক্ত করা যায়। যেটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও চিন্তার দৃশ্যমান প্রতিফলন।
অগ্নিবীণা কাব্যে তাঁর প্রথম কবিতা ‹প্রলয়োল্লাসে› লেখেন-
‹জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে... এবার মহা নিশার শেষে/আসবে উষা অরুণ হেসে করুণ বেশে।›
এখানে সুস্পষ্ট যে তিনি সকলকে জয়ধ্বনি করতে আহ্বান জানাচ্ছেন। অন্যদিকে, ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’ কবিতায় আহ্বান জানান নতুন রূপের আবির্ভাব ঘটানোর জন্য –
‘শ্বেত শতদল-বাসিনী নয় আজ রক্তাম্বর ধারিণী মা,/ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।’
‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ভারতবাসীকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করতে লেখেন- ‘আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ।/এই দুলালাম বিজয়-নিশান, মরতে আছি-মরব শেষ।’ ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), ‘বিষের বাঁশি’ (১৯২৪), ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭), ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯), ‘প্রলয় শিখা’ (১৯৩০), ‘শেষ সওগাত’ (১৯৫৮), ‘ঝড়’ (১৯৬০) সহ বিভিন্ন লেখায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য কড়া ঝংকার তুলেছেন। বলা হয়ে থাকে যে সময়ে বিশিষ্ট অনেক সাহিত্যিকই শোষক ব্রিটিশদের ধামাধরা ছিলেন-ঠিক সে সময়েই সম্ভবত তিনিই তৎকালীন একমাত্র কবি, যিনি কাব্য ও প্রবন্ধে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়েছেন। যার ফলে সময়ে সময়ে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। কারারুদ্ধ থেকেও ব্রিটিশ বিরোধী কবিতা লেখাতে ব্যস্ত ছিলেন; দমে যাননি তিনি। এছাড়া, বাজেয়াপ্ত হয়েছে তাঁর প্রায় পাঁচটি কাব্য ও প্রবন্ধগ্রন্থ। নজরুল একসময় বুঝতে পারলেন শুধু বিপ্লবের ডাক দিয়ে কাজ হবে না। আপামর জনগণকে এক করতে হবে। উপেক্ষিত বৃহদাংশকে বাদ দিয়ে গণ-আন্দোলন সম্ভব নয়। সমাজে সাম্য আনতে হবে। তাই তিনি ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে নারী-পুরুষের জয়গান গাইলেন।
‘জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান/মাতা ভগ্নি বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহান।’
কবি নারী জাতির ত্যাগ-তিতিক্ষাকে আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যবহার করার আহ্বান জানান। আবার নারীকে শৃঙ্খলবন্দী রাখার ফল জানিয়ে সকলকে সতর্ক করেছেন- ‘নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে/আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।’
‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে সকলের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য ছন্দবদ্ধ করেন- ‘গাহি সাম্যের গান- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/ যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।’
এ নিশ্চয়ই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকল ভারতবাসীকে একসুতোয় বাঁধার নিপুণ প্রয়াস। এখানেই থামেননি তিনি। সমাজে শ্রেণিবৈষম্য দূর করে মানবিক সমতা প্রতিষ্ঠা করতে কুলি, মজুর ও কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র সুনিপুণভাবে অঙ্কন করেন তাঁর কবিতায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে সকলের অংশগ্রহণ অনিবার্য। জাত-পাত, লিঙ্গ ও শ্রেণিবৈষম্য থাকলে ব্রিটিশরা বিভাজনের খেলা খেলবে। ফলে স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটাতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে। আর নজরুলের এই আশঙ্কার বিষয়টি সমকালীন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আজও মূর্ত হয়ে দেখা দেয় মাঝে মাঝে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন