চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ধর্মঘটের গতকাল ১৭তম দিনেও দেশের সবকটি চা বাগানে কাজ বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকেরা তাদের দাবি আদায়ে সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করছেন। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে খেজুরিছড়া চা বাগান, কালীঘাট চা বাগান, রাজঘাট চা বাগানসহ বিভিন্ন বাগানে ৩০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা সেøাাগান দিতে দেখা গেছে। খেজুরিছড়া বাগানের চা শ্রমিকরা জানান, আমরা ১৭ দিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ঘরে খাবার নেই। না খেয়ে রয়েছি। আমরা ১২০ টাকা মজুরি পাই, তা দিয়ে সবকিছু করা যায় না। সংসারের খরচ অনেক, জিনিসের দাম বেড়েছে। আমরা এত পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি পাই না। আমরা এখন প্রধানমন্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে আছি। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই মেনে নেব।’
খেজুরিছড়া চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মহেশ্বর দাস বলেন, চা শ্রমিকেরা এখন কাউকেই নেতা মানছেন না। আমরা পঞ্চায়েত কমিটিও কোনো কেন্দ্রীয় কমিটি মানছি না। আমাদের শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটিই বলেন, আর জনপ্রতনিধি বা সরকারি কর্মকর্তা বলেন, সবাই এক হয়ে আমাদের এই ন্যায্য দাবির আন্দোলন বানচাল করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আমরা অপেক্ষায় আছি, প্রধানমন্ত্রী নিজ মুখে সিদ্ধান্ত দিলেই আমরা কাজে ফেরত যাব।
এদিকে চা শ্রমিকদের আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করতে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। চলমান ধর্মঘটে বাংলাদেশ চা– শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের প্রত্যাখ্যান করে গড়ে উঠছে ‘চা শ্রমিক অধিকার পরিষদ’ নামের নতুন সংগঠন। এই সংগঠনটি গতকাল বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে কালীঘাট চা বাগানের দুর্গামন্দিরে সভা শুরু করে। নতুন এই সংগঠনের পঞ্চায়েত নেতা ও তরুণ-যুবকদের অগ্রাধিকার দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে কালীঘাট চা বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি অভান তাঁতীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সকাল থেকে কালীঘাট, জেরিন, লংলা, গান্ধীছড়া, হুগলি ছড়া, আমরাইল ছড়া, ভুরভুরিয়া, ভাড়াউড়া, ডাকছড়া, খাই ছড়া, লস্করপুর, রাজঘাট, খেজুরি, লাখাই, বিলাশছড়াসহ বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিকেরা সভায় যোগদান করেন। সভায় প্রায় তিন হাজার চা শ্রমিক উপস্থিত হন। নতুন এই সংগঠনের বিষয়ে জানতে চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নিপেন পালের মোবাইলনে একাধিক বার কল দিলেও তিনি কল ধরেননি এবং পরে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে চা শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চলমান ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানিয়ে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে ছাত্র-ছাত্রীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় কয়েকটি বিদ্যালয়ের ক্লাস বর্জন করে উপজেলার খেজুরিছড়া চা বাগানের দুর্গামন্দিরের সামনের রাস্তায় জড়ো হয়ে তাদের দাবি তুলে ধরেন। এই সব শিক্ষার্থীদেও বাবা-মারা চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলে, চা শ্রমিকেরা অনেক কষ্ট করে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা করান। সন্তানদের পড়াশোনা করানোর জন্য চা শ্রমিকদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। কিন্তু শ্রমিকেরা যেন তাদের সন্তানদের ঠিকমতো পড়াশোনা করাতে না পারেন, সে জন্য বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বিভিন্ন বৈষম্যের মধ্যে রেখেছে। পরবর্তী প্রজন্মও যেন সারা জীবন চা বাগানের ‘দাস’ হয়ে জীবন কাটাতে পারে, সেটাই বাগান কর্তৃপক্ষের চাওয়া বলে দাবি করে শিক্ষার্থীরা।
উলেখ্য যে, গত ৯ আগস্ট থেকে দেশের ১৬৭ চা বাগানের ২৩২টি ফাঁড়ি বাগানের চা শ্রমিকরা চার দিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি ও পরে ১৩ আগস্ট থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করছেন চা শ্রমিকেরা। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেও সেটা মানছেন না সাধারণ শ্রমিকেরা। বাগানে বাগানে ঘুরে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার অনুরোধও জানাচ্ছেন ডিসি, এসপিসহ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
এদিকে মৌলভীবাজার জেলা সংবাদদাতা জানান, আন্দোলনের ১৭তম দিনেও ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে জেলার ৯২টি চা বাগান সহ দেশের ১৬৭টি চা বাগানের শ্রমিকরা অনড় রয়েছেন। সকাল থেকে কাজে যোগ দেননি শ্রমিকরা। সাধারণ চা শ্রমিকরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সরাসরি ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছেন। না হলে তাদের রুটি রুজির লাগাতার ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন। ৩০০ টাকা মজুরি দাবিতে দেওরাছড়া চা বাগান, প্রেমনগর চা বাগান, মৌলভী চা বাগান, মাজদিহি চা বাগান ও হামিদিয়া চা বাগানের কয়েক হাজার শ্রমিক একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মৌলভীবাজার জেলা সদরের আসেন। শহরের ঢাকা-মৌলভীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কের বেরীর পাড় মোড়ে রাস্তায় বসে শ্রমিকরা বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বিক্ষোভ পালন করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন