শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের দায় কার?

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে যিনি আসীন হন, তিনি উচ্চমূল্যের বেতন-ভাতাসহ সপরিবারে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভোগ করেন। তার বাড়িতে, গাড়িতে ও টেবিলে জাতীয় পতাকা থাকে। তাকে সম্মানিত করার জন্য সার্বক্ষণিক সবকিছু প্রস্তুত থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যক্তির রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যের দায় কি ব্যক্তির না রাষ্ট্রের? পক্ষপাতহীনভাবে এ বিষয়টি গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। রাষ্ট্র বা জনস্বার্থবিরোধী কোনো কথা প্রকাশিত হলে বলা হয়, ওই বক্তব্য সরকার বা দলের নয়; বরং তা তার ব্যক্তিগত, এমন মন্তব্য করে উড়িয়ে দেন দলীয় ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদবিধারীরা।

সম্প্রতি অনৈতিক, অসামাজিক, রাষ্ট্রবিরোধী, ঠগবাজ, ভূমিদস্যু, জুয়াড়ি, কালোবাজারিদের সাথে ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ আমলা, সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিদের সাথে যৌথ ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হচ্ছে। এ ধরনের ছবি ইতোপূর্বেও ভাইরাল বা প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু হালে বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে। স্মরণ রাখা দরকার, একজন ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন, তখন তিনি অবশ্যই জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। কৌশলে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের সাথে সখ্য করে নিজেদের স্বার্থে যৌথ ছবি ক্যামেরাবন্দি করার পেছনে দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথমত, এ ধরনের যৌথ ছবি প্রদর্শিত হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছবিধারীকে সমীহ ও সম্মান করে চলে। কারণ, যাদের হাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সিনিয়র ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন, লোভনীয় পোস্টিং দেয়ার ক্ষমতা, তাদের সাথে ফ্রেমবন্দি যৌথ ছবি দেখে উল্টো ফ্রেমবন্দিদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের প্রতি নজরদারি করা তো দূরের কথা, বরং তদবিরের জন্য তোষামোদ করতে থাকে। তখন ফ্রেমবন্দি ছবিধারীরা এর ফয়দা শতভাগ লুটতে থাকে। দ্বিতীয়ত, এসব যৌথ ছবি প্রদর্শন জনগণকে ক্যামোফ্লে¬জের মধ্যে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মোটকথা, ব্লাকমেইল করার জন্য এটি একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। তবে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক বা অবচেতন মনেই হোক, এ ব্লাকমেইলিংয়ের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে দিচ্ছেন রাষ্ট্রীয় পদধারী ব্যক্তিরা, শুধু সস্তা জনপ্রিয়তা বা উপঢৌকনের বিনিময়ে। উপঢৌকনের আকার, রকম, প্রকার ও স্বাদ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্নতর হতে পারে। জনপ্রিয়তা দেখানোর বিনিময়ে ভাবমর্যাদাকে সমুন্নত রাখার বিষয়টিও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিবেচনায় থাকা বাঞ্ছনীয়। হোয়াইট কালার ক্রিমিনালরা সুদূরপ্রসারী চিন্তা করেই সব কিছুতে ইনভেস্ট করে। এ ধরনের যৌথ ছবি বর্তমানে একটি ইনভেস্টমেন্ট, অর্থাৎ ভবিষ্যৎ বা হালে ব্যবহৃত মূলধন হিসেবে ব্যবহার হয় এবং হয়েছে।

অনেক সময় রাষ্ট্রীয় পদধারীরা নিজের ওজন নিজে বোঝেন না। মনে করেন, রাষ্ট্রের চেয়ে তাদের গুরুত্ব ও ওজন অনেক বেশি। নিজেদের অনেক বেশি যোগ্য মনে করার কারণে রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা রক্ষার পরিবর্তে নিজেকে জাহির করার জন্য বেশি পরিপক্বতা প্রদর্শন করেন। শেখ হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন প্রায়ই অযাচিত অর্বাচীন কথা বলে থাকেন, যা শুধু রাষ্ট্রীয় ভাবমর্যাদা নয়; বরং সার্বভৌমত্বের চাদরে টান মারে, আঘাত হানে রাষ্ট্রীয় সত্তার মর্যাদার ওপর। তিনি এমনটি বলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো, শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর জন্য ভারতকে বলে এসেছি, যেকোনো মূল্যে তাকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে হবে (লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, জ্বালানির মূল্য, সীমাহীন লোডশেডিং যখন চরম পর্যায়ে, তখন তার ‘দেশবাসী বেহেশতে আছে’ বলা কথাগুলো না হয় বাদই দিলাম)। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি বলে শুনেছি। তারপরও অন্য কিছু মন্ত্রীর মতো বেফাঁস কথা ছাড়াও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল হেয় হয়, রাষ্ট্রের মর্যাদা হানি হয়, এ ধরনের কথা তিনি বলেন কেন? মন্ত্রীরা অধিকাংশই জনবিচ্ছিন্ন। জনগণের পালস বা জনগণের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তাদের। অন্যদিকে, বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসতে হলে জনসম্পৃক্ততা লাগে না; বরং রাজসিংহাসনের জন্য প্রয়োজন হয় উত্তরাধিকার। তবে যার আন্দোলন সংগ্রাম ও জনসম্পৃক্ততা রয়েছে, যিনি বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে মাঠে-ময়দানে থাকেন তার কথা ভিন্ন এবং উত্তরাধিকারের জন্য আন্দোলন সংগ্রামী নেতাকর্মীরা নিজ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত।

আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য মোতাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন তাদের দলীয় সদস্য নন, অর্থাৎ দলের সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বা ছিল না। অথচ, এ ব্যক্তিকেই আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়ে নৈশভোটে এমপি-মন্ত্রী বানিয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, সংশ্লিষ্ট আসনে আওয়ামী লীগের কি কোনো উপযুক্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল না, যিনি সাধারণ মানুষের দুঃখ-সুখের সাথে জড়িত এবং জনগণের পালস বুঝতে সক্ষম? রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা না থাকলেও শুধু সাবেক অর্থমন্ত্রীর ভাই হওয়ার কারণেই কি তাকে এমপি-মন্ত্রী বানানো হয়েছে। মোমেন সাহেব তার দেয়া বক্তব্যকে পরবর্তীতে মিডিয়াতে অস্বীকার করায় আওয়ামী লীগের সে সব নেতাকেও মিথ্যাবাদী বানিয়েছেন, যারা তার অর্বাচীন বেফাঁস কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘তিনি দলের কেউ নন’।

দেশ স্বাধীন হয়েছে দু’বার। কিন্তু রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হয়নি। একটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হলো দলীয় কর্মীদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জনে প্রশিক্ষণ দেয়া। সে মানসিকতা নিয়ে বুর্জোয়াবেষ্টিত দলগুলো চলছে না এবং সে ধরনের মানসিকতাও তাদের নেই। বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে ২০০৪-০৫ সালে ঢাকা-আগরতলা আন্তর্জাতিক বাস পরিষেবা উদ্বোধন করার প্রয়োজনে আমাকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকবার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের এমপি-মন্ত্রীদের সাথে দফায় দফায় আলোচনা করতে হয়েছে। তখন দেখেছি, দলের প্রতি প্রদত্ত সার্ভিস বিবেচনা করে বিভিন্ন পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। সে সময় ত্রিপুরা রাজ্যের ট্রান্সপোর্ট ও বিদ্যুৎমন্ত্রী দু’জনই আমাকে বলেছেন, তারা প্রথমে দলে যোগদান করার পর দলের কাজ করতে হয়েছে, পরে পর্যায়ক্রমে পঞ্চায়েত, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও রাজ্যসভায় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে এবং এতগুলো ঘাট পেরিয়ে এখন তারা মন্ত্রিত্ব করছেন। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রে বা দলে কর্মের কোনো মূল্য নেই, কর্ম থাকুক বা না থাকুক মূল্য রয়েছে উত্তরাধিকারের। কেউ কেউ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি সার্ভিস না থাকলেও তাদের ভাগ্যে ঘুম থেকে উঠেই জুটে যায় ‘গরম ভাত’। পান্তা ভাত রয়ে যায় সংগ্রামী নেতাকর্মীদের ভাগ্যে।

রাজাশাসিত (কিংডম) রাজ্যে এখনো আইনগতভাবেই উত্তরাধিকার বিদ্যমান। কিন্তু রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয়, সেখানে জনসম্পৃক্ততার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া বাঞ্ছনীয়, নতুবা রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে তারতম্য থাকে কোথায়? আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পদ-পদবি বা দায়িত্ব প্রাপ্তির জন্য উত্তরাধিকারই যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। সমাজ, দেশ, দল ও রাষ্ট্রের প্রতি কার কতটুকু সার্ভিস রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হলে যথাযথ ব্যক্তি যথাযথ স্থানে পদায়িত হবে।

শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর কথাটির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পূর্ব অনুমোদন ছিল কি না- তা কিন্তু সরকারের পরবর্তী কার্যক্রমে বোঝা যাচ্ছে না। কথাটি বলে জনাব মোমেন ভুল করেছেন, এ ধরনের মন্তব্য না করে; বরং তার পরবর্তী বক্তব্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতি বিদ্রূপ করেছেন। অন্যদিকে ভুল হতে পারে, যথাযথ যোগ্যতার অভাবেও মানুষ ‘ধরা কে সরা’ মনে করে ভুলকে ‘সঠিক’ বলে মনে করে। রাষ্ট্রের কর্ণধার হওয়া সত্ত্বেও জনগণের পালস বোঝার সক্ষমতা তাদের নেই। জনপ্রতিনিধিত্ব করতে হলে প্রথমে জনগণকে বুঝতে হবে, কোন কারণে জনগণের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় তা-ও জানতে হবে।
পৃথিবীতে বিভিন্ন ক্যাটাগরির সরকার গঠন ও পরিচালনা পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটিই প্রমাণিত, ‘গণতন্ত্রই’ সরকারপদ্ধতির সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু আমাদের দেশের বুর্জোয়াপরিবেষ্টিত রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই।


লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন