শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর

| প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ চারদিনের সরকারি সফরে ভারতে যাচ্ছেন। অতিমারি করোনা বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বড় রকমে বদলে দিয়েছে। এর জের থাকতে থাকতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই যুদ্ধ চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিকে আরো অবনমিত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর বিশেষভাবে তাৎপর্যবহ। আরো একটি দিক দিয়ে এ সফরের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। আগামী বছর বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন। সম্ভবত এই মেয়াদের মধ্যে এটাই প্রধানমন্ত্রীর শেষ ভারত সফর। বাংলাদেশের নির্বাচনের পরে রয়েছে ভারতের সাধারণ নির্বাচন। সেই হিসাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মেয়াদকালও শেষ দিকে। এমতাবস্থায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের রাজনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে, যা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনা হতে পারে, এটা ধরে নেয়া যায়। কিন্তু মানুষ জানতে পারবে না, তাদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে। কারণ, তার রেকর্ড রাখা হয় না এবং যৌথ ইশতেহারেও তা স্থান পায় না। অন্যদিকে তারা উভয়ে স্বাভাবিকভাবেই চাইবেন, এই সফর সূত্রে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এমন কিছু অর্জন, যা আগামী নির্বাচনে পুঁজি হতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের কাছ থেকে পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারত অনেক দূর এগিয়ে আছে। যা চেয়েছে, তাই অবলীলায় পেয়েছে। বাংলাদেশ বলতে গেলে কিছুই পায়নি। এবার, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে বাংলাদেশ দেখার মতো কিছু পাবে কিনা, সেটাই লক্ষ্য করার বিষয়। জানা গেছে, আগামী মঙ্গলবার দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠক শেষে পাঁচ থেকে সাতটি কিংবা তারও বেশি সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাণিজ্য, যোগাযোগ, জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয় প্রাধান্য পেতে পারে। পানি নিয়েও আলোচনা হবে, তবে তিস্তা চুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।

বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য অসম। বিপুল ঘাটতি বাংলাদেশের প্রতিকূলে। প্রায় এমন কোনো পণ্য নেই, যা ভারত থেকে আমদানি না করা হয়। চোরাপথেও আসে বিভিন্ন রকমের বিপুল পণ্য। অথচ, সামান্য কিছু সংখ্যক পণ্য ভারতে রফতানি হয়। শুল্ক-অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে যেতে পারে না। কয়েকটি পণ্য বিশেষ করে, পাটের ক্ষেত্রে অ্যান্টি ডাম্পিং বাধাও আছে। অতীতে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশি পণ্য প্রতিরোধক বাধাগুলো দূর করার তাকিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। চাল, গম, পেঁয়াজ, ইত্যাদি নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। দেখা গেছে, মাঝেমধ্যেই এসব পণ্য ভারতের পক্ষ থেকে রফতানি বন্ধ কিংবা শুল্ক বাড়ানোর কারণে আমদানি ব্যাহত হয়েছে। বিপাকে পড়েছে এদেশের মানুষ। এক্ষেত্রে কোনো গ্যারান্টি বাংলাদেশের পক্ষে নেই। তবে তা থাকা উচিত বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। শুল্ক বাধা না থাকলে বাংলাদেশি পণ্য রফতানি বাড়তো এবং ১৩০ কোটি মানুষের একটি বড় বাজার লাভ করা সম্ভব হতো। তাতে বাণিজ্য ঘাটতি কমতো। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যে সংকটে পড়েছে, বাণিজ্য সংক্রান্ত আলোচনায় তা প্রাধান্য পাবে বলে আশা করা যায়। বাণিজ্য ক্ষেত্রে সব রকম সহযোগিতা বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে। তা পাওয়ার ব্যাপারে ভারতের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। যোগাযোগ, সংযুক্তি বা কানেক্টিভিটির বিষয়ে আলোচনা অনেক হয়েছে। কাজ যা হয়েছে, তা ভারতের একান্ত স্বার্থেই হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের বন্দর, স্থল, রেল ও নৌপথ ব্যবহারের অধিকার লাভ করেছে। বলতে গেলে বিনা শুল্কে ভারত তার পণ্যাদি এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ভূমি ও পথ ব্যবহার করে। ভারতের রাজ্য থেকে রাজ্যে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যে খরচ হয়, এখানে তাও সম্ভবত হয় না। বাংলাদেশ কিন্তু অনুরূপ সুবিধা ভারতের কাছ থেকে পায়নি। শুধুমাত্র ভারতের সঙ্গে নয়, কানেক্টিভিটি নেপাল, ভুটান চীন প্রভৃতি দেশের সঙ্গেও হওয়া উচিত, যাতে সবাই তার সুফল পেতে পারে। ভারত এই বহু পাক্ষিক কানেক্টিভিটিতে নারাজ। কানেক্টিভিটির সুযোগ ভারত এখনো বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানকে দেয়নি।

জ্বালানি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্বজুড়েই বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের, দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ সর্বক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাবে পড়েছে। মূল্যস্ফীতির রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত রাশিয়া থেকে কমদামে আনা জ্বালানি তেল বাংলাদেশে রফতানি করে যেমন সহযোগিতা করতে পারে, তেমনি নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতেও সহযোগিতা করতে পারে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এসব বিষয় গুরুত্ব পাবে এবং বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে সিদ্ধান্ত হবে বলে আমরা আশা করি। প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। পানিবিষয়ক আলোচনা বিশেষ করে, কুশিয়ারার পানি ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই হবে। গঙ্গা-তিস্তা ও অন্যান্য নদীর পানি নিয়ে অবশ্য কিছু হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং স্বীকার করেছেন, পানি ভাগাভাগির বিষয়টি বিশেষভাবে ভারতের ওপর নির্ভর করে। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ইস্যু আর কতদিন ভারতের অনিচ্ছায় ঝুলে থাকবে, সেটাই প্রশ্ন। বাংলাদেশ ও ভারত নিকটতম প্রতিবেশী। নিকটতম বন্ধুও বটে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দু’দেশের সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব সর্বোচ্চ উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে বলে দু’ দেশের সরকারের তরফে দাবি করা হয়। এ দাবি কতটা সত্য বা সঠিক তা নিয়ে মতভেদ আছে। বাস্তবে সবাই দেখছে, বাংলাদেশের কাছে কোনো কিছু চেয়ে ভারত বিমুখ হয়নি। তথাকথিত ট্রানজিট থেকে শুরু করে বাণিজ্যে একাধিপত্য সব কিছুই সে পেয়েছে। তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য নিরাপদ হয়েছে বাংলাদেশের সহযোগিতার কারণে। বিনিময়ে বাংলাদেশ তিস্তার পানি ও সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধে ভারতের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পায়নি। বাণিজ্য অসমতা বেড়েছে লাগাতার। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় উপায় হলো, দেবো ও নেবো সমানে সমান। একতরফা সম্পর্ক কখনোই টেকসই হয় না। কিন্তু ভারত এ বিষয়টি আমলে নেয় না। বাংলাদেশের মানুষ এতে ক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট। এদেশের মানুষ কী চায়, ভারতের সেটা অজানা থাকার কথা নয়। ভারতকে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া ও প্রত্যাশার মূল্য দিতে হবে। তাদের সমস্যার সমাধানে সহযোগিতা করতে হবে। বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে তার দায়িত্বও বেশি। আর বাংলাদেশ সরকারকে জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের ইচ্ছা-অভিপ্রায়ের মর্যাদা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দু’ দেশের সম্পর্ক গঠনমূলক, সৃজনশীল এবং সমতাধর্মী হোক, এই কামনাই করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
হামজা ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১:২২ এএম says : 0
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দু’ দেশের সম্পর্ক গঠনমূলক, সৃজনশীল এবং সমতাধর্মী হোক, এই কামনাই করি।
Total Reply(0)
হামজা ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১:২৩ এএম says : 0
বাংলাদেশের মানুষ এতে ক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট। এদেশের মানুষ কী চায়, ভারতের সেটা অজানা থাকার কথা নয়।
Total Reply(0)
হামজা ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১:২৩ এএম says : 0
ভারতকে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া ও প্রত্যাশার মূল্য দিতে হবে। তাদের সমস্যার সমাধানে সহযোগিতা করতে হবে। বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে তার দায়িত্বও বেশি। আর বাংলাদেশ সরকারকে জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের ইচ্ছা-অভিপ্রায়ের মর্যাদা দিতে হবে।
Total Reply(0)
হামজা ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১:২২ এএম says : 0
আমরা চাই ভারত থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যাগুলো আদায় করুক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের মনে প্রাণে বিশ্বাস আপনি আমাদের ইচ্ছা রাখতে পারবেন
Total Reply(0)
jack ali ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১১:৩৪ এএম says : 0
কতবার আমাদের দেশকে আর বিক্রি করা হবে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন