মিয়ানমারে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় রাখাইন রাজ্যে গত কিছুদিন ধরে অব্যাহত সংঘর্ষ চলছে, যার প্রভাব পড়ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরেও। বিশেষ করে বান্দরবানের ঘুমধুম ও তমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। অন্যদিকে এসব রাজ্যের অনেক মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
অগাস্ট মাসে বাংলাদেশের এলাকায় গোলা পড়ার কারণে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ। রবিবারও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় যেকোনো ধরনের গোলার ব্যবহার করার আগে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের রীতি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে এসব গোলাগুলির ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের সঙ্গে কোনরকম তথ্য আদান-প্রদান করা হয়নি বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তরকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মিয়ানমারে সংঘর্ষের ঘটনায় ''বিজিবি এবং অন্যান্য বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে, যেন কোন ধরনের অনুপ্রবেশ যাতে না ঘটে, সেটা রোহিঙ্গা হোক, তাদের বিদ্রোহী বাহিনীর হোক অথবা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হোক - সেটা আমরা বরদাস্ত করবো না। আমরা আর কোন রোহিঙ্গাকে নিতেও প্রস্তুত নই। ''
সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারে কড়া সেন্সরশিপ থাকায় সেদেশের কোন তথ্য পাওয়া বেশ কঠিন। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি, বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দা এবং মিয়ানমারের সংবাদপত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, অগাস্ট মাসের শুরু থেকে সেদেশের রাখাইন, তানপট্টি ও হাকা রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর লড়াই চলছে।
একদিকে যেমন রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে - অন্যদিকে গত মে মাস থেকে কায়াহ, কাইন ও চিন রাজ্যেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই যুদ্ধে হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করছে সেদেশের সামরিক বাহিনী।
থাইল্যান্ড ভিত্তিক মিয়ানমারের দৈনিক ইরাবতির খবর অনুযায়ী, রবিবার মংডুতে আরাকান আর্মির (এএ) হামলায় সীমান্ত রক্ষী পুলিশের অন্তত ১৯জন নিহত হয়। তারা ওই স্টেশনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার নিয়ে বিমান হামলা শুরু করে। রাখাইন রাজ্যের একাধিক স্থানে এসব বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়। এর আগে থেকেই গত একমাস ধরে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট অফ পিসের তথ্য অনুসারে, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ২০২০ সালে আরাকান আর্মির সঙ্গে সেদেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতি সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাখাইন রাজ্যেও সেনাবাহিনী বিরোধী মনোভাব বেড়ে ওঠে। এরই সুযোগে আরাকান আর্মি ওই যুদ্ধবিরতি থেকে বের হয়ে আবার নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।
কিন্তু ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে চায় সামরিক জান্তা। এর আগে তারা রাখাইন ও অন্যান্য রাজ্যে নিজেদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। রাখাইন রাজ্য তাদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ রাজ্যের সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত রয়েছে, বলছে ইন্সটিটিউট অফ পিস। দৈনিক ইরাবতি বলছে, দোসরা অগাস্ট থেকে আরাকান আর্মি একাধিক জায়গায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর হামলা শুরু করে। এর পাল্টা জবাব হিসাবে অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হেলিকপ্টার ও বিমান হামলার পাশাপাশি সেখানকার ছয়টি সেনা চৌকি থেকে প্রতিদিন ৩০০/৪০০ শেল ছোঁড়া হচ্ছে বলে ইরাবতি জানিয়েছে।
দৈনিক ইরাবতি খবর দিয়েছে, মেয়িক ওয়া গ্রামে গত বুধবার হামলা চালিয়ে ১০ সৈন্য হত্যা করেছে আরাকান বাহিনী। রাখাইনের গণমাধ্যম জানিয়েছে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর রাখাইন রাজ্যের আন শহরতলীতে একটি সেবা বহরে অতর্কিত হামলা করে আরাকান আর্মি। সেখানে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সড়কের ওপর সামরিক বাহিনীর গাড়িতে আগুন জ্বলছে। আরাকান আর্মি তাদের এসব হামলা শুরু করেছে এমন সময়, যার কিছুদিন আগে থেকেই মিয়ানমারের কয়েকটি রাজ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর হামলার মুখে পড়েছে সেনাবাহিনী।
বিশেষ করে সাগাইং ও ম্যাগওয়া অঞ্চলে জান্তা বিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোসের্স (পিডিএফ) সেনাবাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই শুরু করেছে। চীন স্টেটে অন্তত দুটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী - চীন ডিফেন্স ফোর্স ও চীন ন্যাশনাল আর্মি সে দেশের সেনা ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালাচ্ছে বহু দিন ধরেই। ইরাবতির খবরে বলা হয়েছে, কায়াহ রাজ্যে গত মে মাস থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে বিদ্রোহী কারেনি ন্যাশনালিটিজ ডিফেন্স ফোর্স, দ্যা কারেনি আর্মিসহ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। পাশের শান রাজ্যেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
বিদ্রোহীদের দাবি, এ পর্যন্ত তারা দেড় হাজার সৈন্যকে হত্যা করেছে - যদিও এই তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। গত বছর থেকে সে দেশের গণতন্ত্রকামীরাও আর্মির বিরুদ্ধে নিয়মিত বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সেই সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন ও নির্যাতন। এসব বিদ্রোহ দমনে তীব্র গোলাগুলি, মর্টার ছাড়াও বিমান ও ভারী কামানের গোলা ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা সেখানকার একাধিক গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে এবং গ্রামে গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে। ফলে এসব এলাকা থেকে বহু মানুষ ভারতের মিজোরামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন