কুমিল্লার রাণীর বাজার রিপন আটা মিলের ফ্লোরে ঘুমিয়ে থাকা আবু বকর হঠাৎ প্রলাপ বকতে বকতে চিক্কুর মেরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে- লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা... জোয়ালেমিন।
ওর মা এই দোয়া শিখিয়েছিল; মা বলেছিল, এ দোয়া পড়লে আপদ দূর হয়।
ভয় ও শূন্যতায় জড়সড় হয়ে আবু বকর হাতরে খুঁজে বেড়ায় পানির বোতল..!
ওর পাশে শায়িত আজগর ঘুম থেকে জেগে ওঠে; ঘুমজড়ানো চোখে তাকিয়ে থাকে প্রলাপরত বকরের দিকে, কী রে বকর, কী হইছে তর? তরে এমন পেরেশানি দ্যহাইতাছে ক্যান?
আগে পানির বোতলটা দে, ভেতরটা ওলটপালট হইয়া গেছে দোস্ত! মোবাইলের টর্চ জ্বেলে মশারির বাইরে হাত বাড়িয়ে বোতলটা এনে বকরের হাতে দেয় আজগর, কী রে, তর কি শরীর খারাপ? চল, সদর হাসপাতালে লইয়া যাই?
বোতলের ছিপি খুলে মুখ হা-করে পানি ঢালতে থাকে- মুখে, চোখে, মাথায়, আর মর্মস্পর্শী কণ্ঠে হেঁকে ওঠে- বাজান, কই রে সুহেল; সাজেদা.., কই গো বউ আমার...
বসা থেকে ওঠে ঘরের আলো জ্বেলে বকরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আজগর, কী রে বকর, কী হইছে তর? খুইলা কইবি তো!
ডুকরে কেঁদে ওঠে আবু বকর, কী কইতাম রে আজগর; একটু আগে আমার বউ সাজেদা আর ছোটো পোলা সুহেল জোর গলায় আমারে ডাক দিয়া গেল!
দুশ্চিন্তার ঘাম চিকচিক করে ওঠে আজগরের কপালের বলিরেখায়, কস্ কী? তর কি মাথা খারাপ হইয়া গেছে নাকি, কোনো খোয়াব দেখস নাই তো?
খোয়াব না রে আজগর, খোয়াব না; একটু আগে আমার বউ সাজেদা আর শিশুপোলা সুহেল চিৎকার কইরা ডাকতে ডাকতে কই চইলা গেল...!
কস্ কী তুই..? তর কোনো কথাই তো বুঝতাছি না।
কতদিন পর আইজ আবারো সেই ডাক শুনতে পাইলাম; ট্রেনের বাঁশির সুর আমারে ঘুমাইতে দেয় না, ওই শব্দ কানে গেলেই উম্মাদ হইয়া যাই, ওই বাঁশির ডাকে যেন শুনতে পাই- আমার বউ সাজেদা আর সুহেলের ডাক!
তুই শান্ত হ, সবই মিছে মায়া; আমার গুরুজ্বি অধর মুসাফির কইত- বাছারে, এই দুনিয়া শুভঙ্করের ফাঁকি; তুই আর কান্দিস না দোস্ত; পেছনের কথা ভুইলা যা।
এই জন্যই তো আমি খগড়াছড়ির জঙ্গলে গিয়া পইড়া রইছি; ওইখানে রেলগাড়ির সাইরেন বাজে না। কিন্তু কই, ভুলতে পারলাম কই; কেউ এমন জ্বালা ভুইলা থাকতে পারব রে?
কী অপূর্ব সুন্দরী আর শান্তশিষ্টই-না ছিল ভবানীপুরের মতিন মোল্লার মেয়ে সাজেদা; পড়াশোনার দৌঁড় স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেনি; কৈশোর থেকেই গ্রামের ছেলেরা গিয়ে ওর রূপের ঘ্রাণে আমোদিত হতো, প্রেমজড়ানো স্বপ্ন দেখত!
গ্রামের একজন চাষাভুষা হলেও আত্মসম্মানবোধ নিচে নামতে দেয় না মতিন মোল্লা। জমিজিরাত, গৃহস্থ-সংসারে বেশ উন্নতি দেখেও অব্যক্ত কারণে জয়নাল আবেদিনের পোলা আবু বকরের কাছে সাজেদাকে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না মতিন মোল্লা।
সাজেদাকে কাছে না-পাওয়ার দুঃখ সইতে না পেরে কলেজ ছেড়ে বিদেশে চলে যায় আবু বকর, কাজ খুঁজে নেয় আরবের এক উষর মরুপ্রান্তরে, খেঁজুরবাগানে। দেশ ছেড়ে গিয়েও সাজেদার প্রতি ওর মনের আকর্ষণ কিছুতেই কমাতে পারেনি, বরং খুব কাছে টানতে থাকে সাজেদাকে। প্রায়ই ফোনে যোগাযোগ করে ওর সাথে।
ছোটোবেলা থেকেই নিজেকে সবসময় বড় করে দেখানোর তীব্র প্রবণতা ছিল বকরের। আর ওর প্রতি মেয়েদের আকর্ষণ করার পরীক্ষায় পাস করে ফেলেছিল স্কুলে পড়ার সময়েই; কতই-না ছলিয়েভুলিয়েও সাজেদাকে রাজি করতে না পেরে কী কান্না আর আকুলিবিকুলিই করেছিল বকর!
শেষবার মোবাইলে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বকর বলেছিল, সাজেদা, তোমারে বউ কইরা ঘরে নিবার না পারলে, জীবনে আর বিয়াই করমু না; দেশেই আসমু না কোনোদিন।
আবু বকরের কান্নার স্রোতে ভেসে গিয়েছিল সাজেদা, বলেছিল- বাপে বিয়া না-দিলে, আমি কী করতাম; আমি কি আর বাপেরে এই কথা কইতে পারি?
যেইভাবেই হউক চাচারে বোঝাইয়া কইও সাজেদা, নইলে কোনো একদিন শোনতে পাইবা, আরবের জনহীন নিথর মরুভূমিতে হয়ত পইড়া থাকব এই হতভাগা আবু বকরের লাশ; চাচারে বোঝাইয়া কইও তুমি; যেইভাবেই হউক ওনারে রাজি কইরো।
ছবছর পর দেশে ফিরে এসে সাজেদাকে বিয়ে করে পৃথিবী যেন জয় করে ফেলেছিল আবু বকর; গভীর প্রেম ও আনন্দে বল্গাহীন ঘোড়ার বেগে ছুটে চলে ওদের সুখের সংসার।
প্রবাসজীবনে প্রভূত অর্থের মালিক হয়ে গেছিল আবু বকর, আঙুল ফুলে কলাগাছ। বাড়িতে তিনতলা ডুপ্লেক্স দালান তুলে চমক লাগিয়ে দিয়েছিল গ্রামবাসীদের। এরপর কী থেকে কী হয়ে যায়!
অজানা কারণে আরবে পুলিশের হাতে ধরা পরে বকর। মাস ছএক জেল খেটে দেশে ফেরার পর উপার্জনের অঙ্ক মেলাতে গিয়ে ওর চোখ কপালে গিয়ে ঠেঁকে- বিরাট এক ঋণের বোঝা জগদ্বল পাথরের মত ওর মাথায় চেপে আছে। দালানসহ বসত বাড়ি বিক্রি করে দিয়েও ঋণ পরিশোধ হয়নি ওর।
এদিকে বউ, দুই ছেলে ও এক মেয়ের অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসার যোগান যেন ওর কাছে হিমালয়ের ভার হয়ে দাঁড়ায়! অভাব ও দারিদ্রতার বানে ওর জীবন থেকে কোথায় ভেসে গেল- মা-বাবার কথা, ভাই-বোনদের কথা; প্রিয় ছোটোবোন ফেরদৌসির কথা তো কালেভদ্রেও মনে পড়ে না ওর; যে বোনটি বড় হয়েছে বকরের কাঁধে চড়ে; আর ছোটোভাই আতিক? ওর কথাও আজ মনে পড়ে না আবু বকরের; সবাই যেন পর হয়ে গেছে।
ইদের কেনাকাটা করতে গিয়ে আগে আতিকের পাঞ্জাবি-পায়জামা, টুপি জুতো কেনার পর বাকি কেনাকাটা; তিনবছর বয়সে একবার আতিকের পাকস্থলি ফুডপয়জনে আক্রান্ত হয়েছিল; রাতভর কতই-না কান্না, একমাত্র বকরের কোলে চড়ে কাঁধে মাথা হেলিয়ে চুপ মেরে শোয়ে থাকত; আজ সবই কেবল ধুসর স্মৃতি; দারিদ্রতা সব ভুলিয়ে দিতে জানে! বাবার মৃত্যুর পর থেকে পরিবারের সকলেই ধীরে ধীরে ওর কাছ থেকে দূরে চলে যায়, নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে ওরা। অভাব অনটন ও দারিদ্রের ঘোর অন্ধকারে পড়ে একসময় গোটা পৃথিবীই ওর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়।
বেঁচে থাকার কোনো পথ না পেয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে ঢাকার মালিবাগ রেলক্রসিংয়ের পাশে ছোটো একটি বাসায় গিয়ে ওঠে বকর; খিলগাঁও মাটির মসজিদের সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সবজি বিক্রির ব্যবসা শুরু করতে এতটুকুও লজ্জাবোধ করেনি আই.এ পাস আবু বকর। জীবন যদি পতিত হয় বিপন্ন ঝড়ের মুখে, লাজ-লজ্জা বলে কী আর থাকে! সবজি বিক্রির উপার্জন দিয়ে সংসারের খরচ মেটাতে পারছে না দেখে স্বামীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে সাজেদা; অর্থোপার্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অর্থাভাবে ভালোবাসা পালিয়ে যাবার আগেই এখানেওখানে কাজ খুঁজে বেড়ায় সাজেদা; গ্রামের লাজরাঙা, শান্তশিষ্ট মেয়েটি অবশেষে শ্রমিকের চাকরি খুঁজে পায় পোশাক তৈরির কারখানায়।
সংসারের দৈন্যদশা আর ঋণের চাপে দিন দিন কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়তে থাকে বকর; একসময় গতিময় জীবনের বেগ কমে আসে দেহ ও মনে। কদিন আগে বারডেম হাসপাতালে দশ টাকার টিকেট দিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিল ও, ডায়েবেটিস ধরা পড়েছে। ডাক্তার সাহেব আবু বকরকে ভাত কম খেতে পরামর্শ দেয়ায় মনে মনে খুব ক্ষেপে ওঠেছিল, বেটা, এমনিই তো ভাত জোটে না, বেশি খামু কইত্যে।
হামেশাই বউ-বাচ্চাদের সাথে বাকবচসায় লিপ্ত হয়ে পড়ে আবু বকর। খিটখিট মেজাজী হয়ে ওঠতে থাকে দিন দিন। এমন পরিস্থিতিতে বড় ছেলে ও মেয়েটি অপ্রাপ্ত বয়সেই কাজের সন্ধানে ছুট দেয়।
সবসময় তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে ঘরে আসে বকর; ধমক, তর্ক-বির্তক, বেহুদা স্ত্রী সন্তানদের ওপর উদ্ধত আচরণ; দিন দিন সংসারটি নরকে পরিণত হয়ে ওঠে; প্রায়ই স্বামীর প্রতি অভিমানে ছোটোবোন মাজেদার বাসায় চলে যেত সাজেদা; হাতির ঝিলের পশ্চিম পারে থাকে ওরা, বেগুনবাড়িতে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন