হুজুরের কাছে বিদায় আনতে গেলাম। অনেকটা ভারি গলায় বললেন " বলো দূরে যাচ্ছি কাছে আসার জন্য"
হুজুরের আবেগ, ভালবাসা বুঝার মত বয়স বা পরিপক্বতা কোনটাই তখন ছিলনা। সুদূর চলে গেলাম। কি এক সিন্ধুসম মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে এক অনিশ্চিত অজানার দিকে পা বাড়ালাম।
সময়ের পাখায় ভর করে জীবন এগিয়ে চললো। আমার আর কাছে আসা হলো না।
যেদিন হুজুর ইন্তেকাল করলেন,সেদিনও আমি সেইই সুদূর এ। খবর পেয়ে পাগলের মত হয়ে ছুটলাম। কিন্তু নিয়তি আমায় আর কাছে যেতে দিলনা। বরংচ আরো দূরে সরিয়ে দিল। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে। বিগত দশটি মাস একটা চাপা অপরাধবোধকে সঙ্গী করে প্রবাস জীবন কাটছিল। হঠাৎ একদিন শ্রদ্ধেয় হাফিজ সাব্বির ভাই(হাফি:) বার্মিংহাম থেকে ফোন করলেন। ব্রিটেনে অবস্থানরত হুজুরের ছাত্রদের নিয়ে বার্মিংহাম সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদে হুজুরের ঈসালে সওয়াব মাহফিলের আয়োজন করছেন। খুশিতে রব্বে করিমের দরবারে শুকরিয়া আদায় করলাম। হুজুরের নিজ হাতে, পরম যত্নে গড়া সোনার মানুষদের সংস্পর্শে গিয়ে হুজুরকে অনুভব করার ও তপ্ত হৃদয়ের ক্ষতস্থানে কিছুটা প্রলেপ দেয়ার একটা সুযোগ আল্লাহ করে দিয়েছেন।
দিনটি ছিল ৬-ই সেপ্টেম্বর, ১০-ই সফর, রোজ মঙ্গলবার। বৃষ্টিস্নাত বার্মিংহাম নিউ স্ট্রিট রেল স্টেশনে নেমে যখন সিরাজামমুনিরা মসজিদের উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা দিলাম, পাপী মনে একটা ভাবনার উদয় হলো। কোন গতানুগতিক স্বরণসভার মত মাহফিলটা হয়ে যায় কিনা।তাহলে আমার হৃদয়ের অপূর্ণতা চিরকাল অপূর্ণই থেকে যাবে!
সিরাজামমুনিরার আঙ্গিনায় প্রবেশের পর থেকে আমার আশংকা ভুল প্রমাণিত হতে লাগলো। একটা আদর্শ ঈসালে সওয়াব মাহফিল যেরকম হওয়া উচিত, ঠিক সেরকমই আয়োজন করতে সাব্বির ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন আয়োজক কমিটি যেন কোন কার্পণ্য করেননি। কুরআন তেলাওয়াত, খতমে খাজেগান, কসিদায়ে বুরদা পাঠ, জিকির, মিলাদ এবং হুজুরের বর্ণাঢ্য নেক জীবনের স্মৃতিচারণসহ মেহমানদের আপ্যায়ন কোন কিছুতেই খুলুসিয়তের বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলনা।
বৃটেনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হুজুরের হাতে গড়া আলেম-উলামাসহ হুজুরের অনেক ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষীরা মাহফিলে যোগদান করেন।
মাহফিলের দুটি বিষয় আমাকে অভিভূত করেছে।
১. আমার জানামতে সিরাজামমুনিরায় হুজুরের এই ১ম ঈসালে সওয়াব মাহফিলে হুজুরের নিজ পরিবারের কোন সদস্য কিংবা কোন আত্মীয়স্বজন উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু মাহফিলের প্রতিটা কার্যক্রমসহ বক্তৃতা বা আলোচনায় হুজুর সম্পর্কে যে দরদ বা অনুভূতি ছিল, তা আত্মার আত্মীয়তাকেও ছাপিয়ে গেছে। হুজুর যেরকম আল্লাহর ওয়াস্তে তার ছাত্রদেরকে ভালবেসেছিলেন, ছাত্ররা যেন সেই প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে কোন অংশে পিছপা হতে রাজি নয়।
এরকম খুলুসিয়ত এ জামানায় খুবই বিরল এখন।
২. হুজুর যেরকম আপন পীর-মুর্শিদের বাড়ীর ঈসালে সওয়াব মাহফিলে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন,(আমি হুজুরকে ছাহেব বাড়ীর পুকুরপাড়ে রুমাল বিছিয়ে কিংবা বালাই হাওড়ের ধূলাবালিতে বসে থাকতে দেখেছি) এই মাহফিলেও হুজুরের হাতে গড়া স্বনামধন্য আলেম উলামারা যারা নিজ নিজ অবস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত, তারাও সেভাবে নিজেদের রেপুটেশনকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এমনকি ছিলনা কারো জন্য কোন বিশেষ চেয়ারের বরাদ্দ।
ব্রিকলেন জামে মসজিদের খতিব,সিদ্দিকী হুজুর রহঃ এর সাবেক সহকর্মী ও লন্ডনস্থ দারুল হাদিস লতিফিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস হযরত মাও: নজরুল ইসলাম সাহেবের সভাপতিত্বে এবং সিদ্দিকি হুজুর রহঃ এর পরম স্নেহধন্য ছাত্র, বার্মিংহাম সিরাজামমুনিরা জামে মসজিদের পরিচালক হাফিজ সাব্বির ভাইয়ের সুনিপুণ পরিচালনায় মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্য পেশ করেন সায়্যিদ শায়খ জুবা ফাদি ইবনে আলী(সিরিয়া), বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন লতিফিয়া ক্বারী সোসাইটি ইউকের সেক্রেটারি মাওলানা মুফতি আশরাফুজ্জামান সাহেব, দারুল হাদিস লতিফিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা শিহাবুদ্দিন সাহেবসহ প্রমুখ উলামায়ে কেরামগন।
অশ্রুসজল নয়নে বক্তারা হুজুরের সফল জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ও স্মৃতিচারণ করেন। যা পরিবেশকে বারবার সিক্ত করেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এসব আলোচনা শুনার মাধ্যমে হুজুরের সংস্পর্শ অনুভব করেছি যা আমার কামনা ও কারণ ছিল সিরাজামমুনিরায় আসার। মনে হয়েছে যেন আমি কিছুটা হলেও হুজুরের কাছে আসতে পেরেছি।
পরিশেষে বার্মিংহাম সিরাজামমুনিরা জামে মসজিদ কর্তৃপক্ষের কৃতজ্ঞতা আদায় করছি এরকম সুন্দর, সার্থক ও নূরানি একটি ঈসালে সওয়াব মাহফিল আয়োজন করার জন্য। আল্লাহ আপনাদেরকে দুনিয়া-আখেরাতে এর সর্বোত্তম জাজা দান করুন।একই সাথে আকুল গুজারিশ করছি যেন এর ধারাবাহিতা জারি থাকে প্রতি বছর।
আল্লাহ পাক উস্তাদুল আসাতিজা আল্লামা আব্দুল কাইয়্যুম সিদ্দিকী হুজুরের দরজাকে বুলন্দ করুন এবং হুজুরকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।
মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম
অক্সফোর্ড, ইউকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন