বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। এটি দেশের জন্য প্রকৃতি প্রদত্ত এক অমূল্য উপহার। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি হাজারো পর্যটকের ঢল নামে এই সৈকতে। সৈকতে শীতল হাওয়ায় প্রশান্তি খুঁজতে, সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ে পা ভেজাতে, সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের গর্জন শুনতে কিংবা রাতের সমুদ্র দেখতে সৈকতে মুখর থাকেন পর্যটকরা। এ যেন প্রকৃতি আর সমুদ্রের সঙ্গে পর্যটকদের গভীর মিতালি। তাই তো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বহুমাত্রিক সৌন্দর্য উপভোগে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যান পর্যটকরা। দূর হয় জীবনের ক্লান্তি-ক্লেশ-দুর্ভাবনা।
তবে কিছুদিন পরপর সমুদ্রের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। সমুদ্রে গোসলে নেমে চোরাবালিতে আটকে পড়ে, গুপ্ত খাদে পড়ে কিংবা ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে অনেকের। এর মধ্যে কারও কারও লাশ ফেরত পাচ্ছেন স্বজনরা। আবার কারও কারও জন্য অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর গুনতে হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সৈকতের ভাঙ্গন ঠেকাতে বসানো হয়েছে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ। জিও ব্যাগের পাশ থেকে শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন বসিয়ে তোলা হয়েছে বালু। এতে করে সমুদ্র সৈকতের অসংখ্য স্থানে তৈরি হয়েছে গভীর গর্তসহ চোরাবালি। মানবসৃষ্ট এই চোরাবালির কারণে সমুদ্রে গোসল করা এখন বিপদসঙ্কুুল হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত সমুদ্রে কোনো না কোনো স্থানে গোসল করতে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে এ ঘটনার শিকার হচ্ছে শিশু-কিশোর পর্যটকরা।
এক সময়ের শোভামণ্ডিত নিরাপদ সমুদ্র সৈকত ভাঙ্গনের কবলে পড়ে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। ব্যাপকভাবে ভেঙ্গেছে, সৈকত এমন রূপ কেন ধারণ করছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সৈকতের বিভিন্নস্থানে মানবসৃষ্ট চোরাবালিকেই দায়ী করছেন সচেতন মহল।
চোরাবালিতে আটকে গত পাঁচ বছরে প্রাণহানি ঘটেছে ৩৫টি। বিপন্ন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে চার শতাধিক জনকে। গত কয়েক বছর সমুদ্র সৈকতের ডায়বেটিকস হাসপাতাল পয়েন্ট থেকে হিমছড়ি পয়েন্টে অন্তত ৩০টি পয়েন্টে শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করায় সেখানে নতুন করে তৈরি হচ্ছে চোরাবালি। এতে সামনের দিনগুলোতে আরও প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, সম্প্রতি সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলি পয়েন্টে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের পর তা জিও ব্যাগে ভরা হয়েছে। এতে ওই পয়েন্টের একাধিক স্থানে গভীর গর্ত হয়ে চোরাবালির সৃষ্টি হয়েছে। ওই সময় লাইফ গার্ড ও বীচ কর্মীরা জানিয়েছিলেন, ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীর তলদেশে গভীর গর্ত তথা চোরাবালির সৃষ্টি হয়েছিল। এতে ওই চোরাবালিতে পড়ে শিক্ষার্থীরা প্রাণ হারায়।
তবে জেলা প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও লাইফ গার্ড কর্মীরা বার বার পর্যটকদের সর্তক করছেন, এতেও প্রাণহানি থামাতে পারছেন না।
চোরবালি কেন হয়, এমন প্রশ্ন করা হলে বীচকর্মী ও লাইফ গার্ড কর্মীরা বলেন, যেখানে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হয় সেখানে নির্দিষ্ট জায়গায় বড় ধরণের অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়। আর সেই গর্ত স্রোতের টানে ভরাট হয়। তখন সেই গর্তের মধ্যে কেউ পড়ে গেলে সহজে বের হতে পারে না। ফলে কিছুক্ষণ মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে সমুদ্রে গোসল করতে আগ্রহীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। সৈকতে গোসল করতে নেমে নিয়মিত না হলেও মাঝেমাঝেই আমরা চোরাবালিতে আটকে পর্যটকের মৃত্যুর খবর শুনতে পাই।
জেলা প্রশাসক বলেন, সমুদ্রের পানিতে নামার আগে ১০টি নির্দেশনা মানতে হবে পর্যটকসহ সবাইকে; যা আমরা সতর্ক বার্তা হিসেবে নির্ণয় করেছি। এ নির্দেশনা সৈকতের উল্লেখযোগ্য পয়েন্টে লাগানো হয়েছে। পর্যটকদের জানা উচিত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে লাইফগার্ড আছে। এখানে সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। কোন চিহ্ন দিয়ে কি অর্থ প্রকাশ পায়, লাল পতাকার অর্থ কী ইত্যাদি। পর্যটকদের সহায়তার জন্য এখানকার বিচকর্মীরা সার্বক্ষণিক সজাগ রয়েছেন। সৈকতের প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ভেঙে বিলীন হচ্ছে সৈকত। এজন্য বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ মেয়াদী সমীক্ষার মাধ্যমে একটি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নের মতামত দিয়েছেন ।
সূত্র জানায়, ২০০০ সালের শেষের দিকে আমেরিকান একদল গবেষক সেইসময় বলেছিলেন, আগামী ৪০ বছরে সাগর ভেঙে পুনরায় আগের জায়গায় চলে আসবে। সে হিসেবে বিগত বছরগুলোতে নাজিরারটেক, ডায়াবেটিস পয়েন্ট, কবিতা চত্বর, শৈবাল পয়েন্ট, লাবণী পয়েন্ট, সী-গালের সামনের পয়েন্ট, কলাতলী হোটেল ক্রাউন থেকে মেরিনড্রাইভের সড়কের বেলি হ্যাচারি পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সৈকত সাগর তলে বিলীন হয়ে গেছে।
২০০৫ সালে তখনকার পুরাতন সড়ক সাগর তলে গিয়ে ক্রাউন হোটেলের কাছাকাছি আসলেও পরবর্তীতে আবার ভাঙ্গন রোধ হয়ে প্রায় দুইশ’ মিটার চর জাগে। কিন্তু সম্প্রতি নাজিরারটেক থেকে বেলি হ্যাচারি পর্যন্ত আবার ব্যাপক আকারে ভাঙ্গন শুরু হয়।
অন্যদিকে,এই ভাঙ্গন কোথায় গিয়ে থামে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, জিও ব্যাগ বা বাঁধ যা-ই দেয়া হোক না কেন নাজিরারটেক থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত আরও ১ কিলোমিটার সৈকত সাগরে বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ সবের তিনি কোনো উপযুক্ত ব্যাখ্যা না দিলেও কক্সবাজারের মহেশখালীর সন্তান আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম বাঁধ নির্মাণের ৩১৪০ কোটি টাকার প্রকল্পের বিরোধিতা করে সৈকতে জিও ব্যাগ স্থাপন করে ভাঙ্গন ঠেকানোর প্রচেষ্টাকেও একটি নিষ্ফল ও অপচয়মূলক কাজ বলে বর্ণনা করেন। তার মতে, সৈকতে বিগত কয়েক বছরে সমিতিপাড়া থেকে কলাতলী পর্যন্ত যেসকল বহুতল স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনাগুলো সরানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, প্রয়োজনে বাঁধের টাকা থেকে ওদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক। ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেয়া হলে সৈকত আবার পুনর্গঠিত হবে, যেটা কলাতলী সাবমেরিন কেবল পয়েন্টে দেখা গেছে। তিনি বাঁধ প্রকল্পটিকে টাকা হাতানোর কৌশল মনে করছেন। জোয়ার-ভাটাএলাকার উপকূলে বহুতল ভবন ও স্থাপনা থাকলে সাগরের ভাঙ্গন সৃষ্টি হয় এজন্য তিনি দ্রুত এসব স্থাপনা সরানোর তাগিদ দেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন