শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

মানুষ হওয়ার গল্প

মোরশেদুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

ফজরের আযানের আগে মুয়াজ্জিনের ঘুম ভাঙে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আজকাল সেটা আলার্ম ক্লোকের অবদান। কিন্তু নুরুদ্দীনের ঘুম ভাঙে আযানেরও আগে দিকে দিকে যে মোরগ ডাকে সেই মোরগের শব্দে। রাতভর অন্ধকার ঝরে ঝরে বরফ হয়ে আছে সর্বত্রই। নিজের গায়ের লোমও দেখা যায় না। কিন্তু এসব কোনো বাঁধাই তো আর পেট মানে না। নিজের পেটে না হয় একরকম সান্ত্বনা চাপা দিয়ে রাখা যায়। কিন্তু বউ-বাচ্চাদের পেটে? পেটের তাগিদে ঘন অন্ধকারের বরফ কেটে-চিঁড়ে নদীর পানে ছোটে নুরুদ্দীন। দুধকুমর নদী। মাঝে মাঝে চর পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খণ্ড খণ্ড উড়ন্ত মেঘের মতো। সেই চরের ফাঁকে ফাঁকে থাকা পানিতে সন্ধ্যায় সে কারেন্ট জাল পাতে। আর সুবহে সাদিকেরও আগে মোরগের শব্দের তালে তালে ছোটে জাল তুলতে। তারপর একটা দুইটা করে মাছ খোলে। সেই মাছ পাঁচ কিলোমিটার দূরের মধ্য কুমুরপুর বাজারে এনে বিক্রি করে কেনে চাল-ডাল-তরিতরকারি। এভাবেই বউ-বাচ্চার পেটের ক্ষুধা তাড়িয়ে হাসি ফোঁটায় মুখে মুখে।

নুরুদ্দীনের এসব দুঃখগাথা হঠাৎ মনে পড়ার কারণ, প্রথমত তাকে আর মাছ বিক্রি করতে দেখা যায় না গত দুই-তিন বছর ধরে; দ্বিতীয়ত, এলাকার লোকজন বলাবলি করে, এখানে-সেখানে, চায়ের দোকানে যে তার একটা ছেলে ‘মানুষ’ হয়েছে। হয়েছে সরকারি অফিসার। তাই দিন ফিরেছে নুরুদ্দীনের। হাসি ফুটেছে তার এলাকার গরীব মানুষদের মুখে। কেন? কারণ এই যে, ছেলে প্রায় বাড়ি আসে, তাদের খোঁজ-খবর নেয়, অনেককে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করে; মসজিদের ছাঁদ ঢালাইসহ বিভিন্ন কাজে টাকা দেয়, ইত্যাদি। ঔৎসুক্যের বশে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, ছেলেটা দ্বিতীয় শ্রেনির একটা সরকারি চাকরি পেয়েছে। কিন্তু কোন ছেলেটা তা ঠাহর করতে পাচ্ছিলাম না।
দীর্ঘদিন পরে আজ নুন খাওয়া গ্রামের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমনই সময় বিকেলের বৃদ্ধ রোদে দেখা হয় নুরুদ্দীনের সাথে। পিচঢালা বেহাল রাস্তায়। সে হাত তুলে সালাম দিয়ে তার পান-চুন-জর্দা খাওয়া দুই পাটি কালো কালো দাঁত বের করে। আমি দাঁড়িয়ে যাই। নেমে পড়ি সাইকেল থেকে।
‘ওয়ালাইকুম সালাম। কী খবর নুরু মিয়া, তোমারে তো দেখাই যায় না! কেমন আছ? দিনকাল চলছে কেমন?
‘আছি মাস্টার, আলহামদোলিল্লা। ভালোই আছি। তোমার খবর কী? এতি ক্যা বেন আইছেন?’
আমি হাসি। প্রায় সমবয়সের হওয়ায় ইয়ার্কির সুরে সুরে বলি: ‘তোমার খোঁজেই আইসলাম। তোমার ভাবী তোমার মাছের কথা বলে মাঝে মাঝে। বাজারে তো সব ফিড খাওয়া চাষের মাছ। তোমার দুধ কুমরের মাছ খাইতে চায়, তাই আইসলাম।’
ইত্যাদি কিছু ইয়ার্কি-ঠাট্টা-হাসির পর সে তার বাড়িতে নিয়ে গেল আমাকে। খুব জিদ করেই। ভালোবাসা থেকে নিয়ে গেল না তার ‘মানুষ’ হওয়া অফিসার ছেলের টাকায় বানানো বিল্ডিং (পাকা) বাড়ি দেখানোর জন্যে, বুঝতে পারলাম না। মনে মনে এইসব ভাবছি আর বিভিন্ন নিয়ে কথা বলছি নুরুদ্দীনের সাথে। আমাদের কথপোকথনের শব্দ শুনে তার স্ত্রী বেড়িয়ে এসে খুবই আশ্চর্য হয়ে গেল।
‘আরে! মাস্টার ভাইক পাইলেন কোন্টে!’
নুরুদ্দীন বললো: ‘ঘাটাত। মেলা দিন পরে দেহা হই্ল, তাই নিয়ে আইসলাম।’
‘ভাই আইসো, বাইরে আছেন ক্যা দাঁড়ে? ঘরের ভিত্রে আইসো, বইসো।’ স্ত্রীর কথায় সাহস পেয়ে নুরুদ্দীন তার বিল্ডিং ঘরে নিয়ে বসালো আমাকে। আর স্ত্রীকে হাঁক ছেড়ে বললো: ‘কী আছে, কিছু নিয়ে আইসো, মাস্টার খালি মুখে যাইবে!’ ‘না, না, নুরু মিয়া, আমি কিছু খাবো না, খালি একটা পান খাওয়া যায়।’ আমি বললাম। নুরুদ্দীনের তিন সন্তানের একটা আমার ছাত্র ছিল। নাম মবিন রহমান। হাইস্কুলে পড়িয়েছি তাকে। তারপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়ার কারণে দীর্ঘদিন দেখা হয় না। তাই সেই নাম আমি আজ স্মরণ করতে পাচ্ছিলাম না।
‘ঐ যে হামার যে ছেলেটা তোমার ছাত্র আছিল, তায় চাকরি পাইয়া হামাক এই বিল্ডিং বানাইয়া দিছে। পঞ্চগড়ত আছিল এলা রংপুরত থাকে ভাই।’
‘আমি জানি, নুরু মিয়া, সব শুনেছি। যাক আল্লাহ রহমত করেছে তোমার ওপর। আর এখন মাছ মারা লাগে না তোমার।’
নুরুদ্দীনের সাথে ইত্যাদি কথা বলি অবচেতন মনে। আর চেতন মনে দেখি ঘরের ভিতরের ডিজাইন, খাট, সোফাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র। এই বাড়িতে এর আগেও এসেছিলাম। বসার জন্য চেয়ারও ছিল না একটা। টুলে বসেছি! যাক, দিন পাল্টেছে। আমার দৃষ্টি বয়স্ক হয়ে গেছে তাই হয়তো সবকিছুই নতুন মনে হলো। নতুন মনে হলো আরো একটা কারণে, সেই পুরনো ঘুঘু, কাক কিংবা শালিকের কোনো শব্দ শুনতে পেলাম না। শব্দ শুনতে পেলাম কবুতরের। ঔৎসুক্যের বশে নুরুদ্দীন আমাকে কবুতর দেখাতে বাড়ির আরো ভিতরে নিয়ে যায়। চাঁদের মতো স্নিগ্ধ আভায় হাসে নানা জাতের ফুল। ফুলগুলোর হাসি নিষ্কলুষ হলেও আমার মন নানা অসহ্য প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পাওয়ায় কলুষিত হওয়ার দশা! দেখলাম অনেক কবুতর যা আমার বাপের জনমেও দেখিনি। দেখলাম গিরিবাজ, জালালি, ম্যাগপাই, বুডারবল ইত্যাদি অনেক দামী জাতের কবুতর। আজ নিজেকে সার্থক মনে হলো! কোনো এক ‘মানুষ’ হওয়া ছাত্রের বদৌলতে এসব দামী জাতের কবুতর দেখার সৌভাগ্য হলো! এতদিন শুধু শুনেই গেছি। আজ দেখলাম।
আমার সাবেক ছাত্র দ্বিতীয় শ্রেনির একটা সরকারি চাকরি করে। দ্বিতীয় শ্রেনির একজন চাকুরের এত শখ দেখে, এত শৌখিনতা দেখে আমি পুলকিত বোধ করি না শিউরে ওঠে আমার শরীল, বুঝি না। হঠাৎ প্রশ্ন করি নুরুদ্দীনকে, ‘ছেলেরে বিয়া দেও না? পাত্রী দেখব?’
‘দেমো মাস্টার, দেমো। বেটা চাকরি পায়া বাড়ি-ঘর ঠিক কল্লো। মাইয়াটার বিয়ে দিলাম। তাতে বেটার ১৫/২০ লাখ ট্যাহা খরচ হইছে। তার উপ্রে, দ্যাহেন না বেটার এই যে কবুতর পালার শখ! এইগ্ল্যারও মেলা দাম। এট্টে প্রায় ২/৩ লাখ ট্যাহার পাখি আছে। ফির ছোট বেটার পড়ার খরচ সামলাইতে মবিন হামার কাহিল। দেহি, বিয়ে তো দেওয়ায় নাগিবে, আইজ হোক আর কাইল হোক। তা, বেটার হাউশ, হামাক আরব দ্যাশ দেখে আনবে, তারপর বিয়ে করবে।’ এক নিঃশ্বাসে নুরুদ্দীন অনেক কথা বলে ওঠে। আমি শুনি আর বিদায় নিতে নিতে শুধু একটা কথা বলে উঠি: পাত্রী একটা আছে, ঐ পায়রা ডাঙার চেয়ারম্যানের বেটি। কিন্তু তোমার ছেলে বেতন কত পায়? সেটা না কইলে ঘটকালি করবো কেমনে?’
আনমনে নুরুদ্দীনের সরল উত্তর: ‘পায়, পঁচিশ/ছাব্বিশ হাজার ট্যাহা পায়, মনে হয়।’ সময় পাল্টেছে। পাল্টেছে জেলে নুরুদ্দীনের জীবনমান, খাওয়া-দাওয়া, বাড়ির চেহারা; অনেক কিছুই। তবু আমার প্রশ্নের কারণ ও উত্তর দেওয়ার কৌশল শেখেনি নুরুদ্দীন। আমি ‘ও!’ বলে মাথা নিচু করে বিদায় নেই তার থেকে।
ততক্ষণে রাতের অন্ধকার নেমেছে মূর্খ গ্রামের বুক জুড়ে। সে অন্ধকার তাড়াতে গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলছে বৈদ্যুতিক আলো। সে আলোর দিকে যখনই তাকাই আমি যেন আরও অন্ধ হয়ে যাই!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
Mahin Hossain ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৯:৩১ এএম says : 0
সমাজের অশিক্ষিত জনতা সরকারি চাকরি পেলেই ঘুষের টাকার প্রতি ঝুকে পড়ে সবার আগে
Total Reply(0)
Sazzad zami ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ২:১১ পিএম says : 0
অসাধারণ লেখনী।শুধুমাত্র টাকা পয়সা অর্জন করলেই হয় না,শিক্ষাটাও মানুষের জীবনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।আর টাকার নেশায় মানুষ এখন পাপ পূন্য ভুলতে বসেছে এ বিষয়টি লেখক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
Total Reply(0)
মোঃ ইউনুস মোল্লা ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৪:০৭ পিএম says : 0
নুরুদ্দীনের সরল উত্তর: ‘পায়, পঁচিশ/ছাব্বিশ হাজার ট্যাহা পায়, মনে হয়।’ সময় পাল্টেছে। পাল্টেছে জেলে নুরুদ্দীনের জীবনমান, খাওয়া-দাওয়া, বাড়ির চেহারা; অনেক কিছুই। তবু আমার প্রশ্নের কারণ ও উত্তর দেওয়ার কৌশল শেখেনি নুরুদ্দীন। আমি ‘ও!’ বলে মাথা নিচু করে বিদায় নেই তার থেকে।
Total Reply(0)
Najmul Hasan Nayem ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৩:৫২ পিএম says : 0
অসাধারণ লেখনি
Total Reply(0)
মোঃ ইউনুস মোল্লা ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৪:০৬ পিএম says : 0
নুরুদ্দীনের সরল উত্তর: ‘পায়, পঁচিশ/ছাব্বিশ হাজার ট্যাহা পায়, মনে হয়।’ সময় পাল্টেছে। পাল্টেছে জেলে নুরুদ্দীনের জীবনমান, খাওয়া-দাওয়া, বাড়ির চেহারা; অনেক কিছুই। তবু আমার প্রশ্নের কারণ ও উত্তর দেওয়ার কৌশল শেখেনি নুরুদ্দীন। আমি ‘ও!’ বলে মাথা নিচু করে বিদায় নেই তার থেকে।
Total Reply(0)
Mobaidul islam ranu ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১১:৪৬ পিএম says : 0
প্রতিকূল পরিবেশের অনুকূল পরিবেশনাই লেখকের কাজ
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন