শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

জীবনানন্দ অলঙ্কার ও শৈল্পিক চিত্রকল্পের কবি

সমর আরিফ | প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি তিনি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যাদের মহাকালের নির্বাচিত ছোট্ট তরীতে স্থান দেবে, তাদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) অন্যতম। এই তরণীর প্রথম সারিতেই তিনি উপবিষ্ট থাকবেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক। তবে কবি হিসেবেই নিজের প্রকৃষ্ট জাত চিনিয়েছেন।

রবীন্দ্র-নজরুল যুগে বিচরণ করেও বাংলা সাহিত্যে ত্রিশের দশকের পঞ্চপাণ্ডবদের পৃথক করা যায় স্বকীয়তার কারণে। তন্মধ্যে, জীবনানন্দ দাশ বিশিষ্ট। অন্যরা এখন মলিন হলেও তিনি স্বীয় আভায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন সাহিত্য-আড্ডায়, সাহিত্য-সমালোচনায় এবং সাহিত্য-গবেষণায়। নিজস্ব ঢঙে তিনি প্রকৃতির রূপ, নির্জনতা, বিষণ্নতা, বিরহ তুলে এনেছেন কবিতায়। তাঁর কাব্যিক শৈলী সেকাল তো বটেই, একালেও তরুণ কবিদের ভাবায়। তাঁকে অনুসরণ-অনুকরণ করে।
তাঁর কবিতায় সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে পরাবাস্তববাদ বা অধিবাস্তববাদ- অবচেতন মনের ভাবনাকে অবাস্তব ও উদ্ভট চিত্রকল্পের রূপ দান। এতে তিনি সমালোচিত হয়েছেন কারো কারো কাছে। এতে কিবা আসে যায়! বাংলা সাহিত্যকে নতুন কিছু তো দিতে পেরেছেন সফলভাবে- এটাই তাঁর অবদান। বৈচিত্র্যময়তাই কবিকে অনন্য করে রাখে। যারা স্রোতে গা এলিয়ে দেন, তারা কালের অতলে তলিয়ে যান।
জীবনানন্দের বিরুদ্ধে অনেকেই অভিযোগ তোলেন তাঁর কবিভাষা জটিল ও নিগূঢ। দুর্বোধ্যতার বদনাম দেয়া হয়েছে। এটি সত্য। তিনি ভাব ও চিত্রকল্পকে অনেক সমকালীন কবিদের থেকে দুর্বোধ্য করে তুলেছিলেন। এখনও অনেক সাহিত্যপ্রেমী তাঁর কবিতার ভাব ও বিষয়বস্তু উদ্ধার করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। এর কারণ হতে পারে দুটো: এক, তাঁর কাব্য রচনার কাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বেকারত্ব, শিল্প-কারখানার অচলাবস্থা, দাঙ্গা, অনাহার, মহামন্দা, সামাজিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি। সকল কবিই সময় দ্বারা প্রভাবিত হন। তাই তাঁর সেই কঠিন সময়কে কঠিন রূপে আমরা পেয়েছি। দুই, তাঁর প্রযুক্ত উপমা ও পরাবাস্তববাদের সন্নিবেশ। তাঁর উপমাকে একাধিক অর্থে অনুধাবন করা যায়। যেমন- ূপাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে- এটি আপাতদৃষ্টিতে নান্দনিক সুন্দর চোখ অর্থে, অথবা নীড়ে যেমন পাখি আশ্রয় খোঁজে, তেমন করে কবি বিভ্রান্ত হয়ে দীর্ঘপথের ক্লান্তি শেষে এখানেই আশ্রয় খোঁজেন অর্থে অনুধাবন করা যেতে পারে। উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে’- এরূপ ক্ষেত্রে অর্থ উদ্ধার করাটা দুরূহ ব্যাপার পাঠকের জন্য। এমন আরও অনেক উপমা দেয়া যেতে পারে। অন্যদিকে, পরাবাস্তববাদে যেহেতু অবচেতন মনের চৈতন্যকে অবাস্তব ও উদ্ভট চিত্রকল্পের রূপ দান করা হয়, ফলে কবির চিন্তার সাথে পাঠকের নিজের চিন্তা মিলিয়ে নিতে বেগ পেতে হয়। উল্লেখ্য, পরাবাস্তববাদের সুস্পষ্ট উদাহরণ দেখা যায় ূবোধ, সুচেতনা, ‘নগ্ন নির্জন হাত’, হায় চিল, সিন্ধুসারস ইত্যাদি কবিতাসমূহে। কবিতায় দুর্বোধ্যতা একটি বৈশিষ্ট্যও বটে; গদ্যের মতো সরল নয়। কিংবা ঘটনার ঘনঘটা অনুপস্থিত। কবিতায় ছন্দের গাঁথুনির কারণে ভাব সংকুচিত হয়ে যায়। ভাব-সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তখনই। তাইতো কবিতা মানুষকে ভাবায়। জীবনানন্দের কবিতা বারংবার পাঠে অর্থ উদ্ধার করতে হয়। চিত্রকল্প উদ্ধার করতে পারলে বিষয়বস্তু উদ্ধারও সহজ হয়ে যায় স্বাভাবিক নিয়মে।
কবিতার ক্যানভাসে চিত্রকল্পের অনবদ্য উপস্থাপন লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, চিত্রকল্পময়’ কবিতা। মানসপটে দারুণ চিত্রকল্প এঁকেছেন এভাবে হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,/ সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/ অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে/ সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;/ আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,। মনে হয় যেন, কবি মানব সভ্যতার হাজার বছরের সুদীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিয়ে আজ ক্লান্ত অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
তাঁর কাব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অক্ষরবৃত্তেও শব্দালঙ্কারের ব্যবহার নিয়মিত ছিল। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার- এতটুকুতেই কী সুন্দর মুন্সিয়ানা! অর্থালঙ্কারও প্রায় প্রতিটি স্তবকেই প্রয়োগ করেছেন, যা বিরল। উপমা-উৎপ্রেক্ষা যেন তাঁর মস্তিষ্কের সহজাত সৃজন। ূশিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল, বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে’, ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়, পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ- এমন অনিন্দ্য উপমা কে বা দিতে পারেন!
গোধূলি, সূর্য, নদী, নক্ষত্র, কাঁচের গুড়ি, বরফের কুঁচি, পেঁচার পাখা, মোরগ ফুল, লেবুর পাতা, কমলালেবুর রঙ, নাশপাতির গন্ধ, শালিক, শঙ্খচিল ইত্যাদি প্রকৃতির কোনো অনুষঙ্গ বাদ রাখেননি উপমার নান্দনিকতায় কবিতা সাজাতে। নদী ও বৃক্ষের কথা বহুবার এসেছে তাঁর কবিতার উপকরণ হিসেবে। আকাশের কোমল নীল, টিয়ার পালকের সবুজ, লাল আগুন, কুমকুমের রঙ, বাদামি হরিণ- রঙে রঙে রাঙিয়েছেন আমাদের মনোজগতের বারান্দা। বিচিত্র ফুলের প্রসঙ্গ এনে কবিতাকে করেছেন পুষ্পশোভিত। তাই তিনি হয়েছেন প্রকৃতির কবি।
এভাবেই তিনি নিপুণ কারিগরের মতো নির্মাণ করেছেন কবিতার অভূতপূর্ব ধারা। প্রকৃতির অনুষঙ্গের উপমা ব্যবহার ও পরাবাস্তববাদী চিত্রকল্প নির্মাণে সিদ্ধহস্ত এই কারিগর বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হয়ে আছেন, থাকবেন চিরকাল। তাই স্বল্প পরিসরে দার্শনিক এই কবিকে বিশ্লেষণ করা তাঁর কবিতার মতোই দুরূহ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন