শিক্ষার ভিত্তি ধরা হয় প্রাথমিক শিক্ষাকে। আর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে যারা পাঠদান করেন তাদের তত্তাবধানের সার্বিক দায়িত্ব থাকে সহকারী উপজেলা/থান শিক্ষা অফিসারদের (এইউইও/এটিইও) উপর। অথচ মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মকর্তারা ২৮ বছর ধরে চাকরি করছেন একই পদে। সীমিত করে দেয়া হয়েছে পদোন্নতির সুযোগও। ফলে হতাশায় ভুগছেন ২ হাজার ৬০১ জন শিক্ষা কর্মকর্তা। এটিকে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে অন্তরায় বলেও মনে করছেন তারা। তাই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সহকারী শিক্ষা অফিসারদের দশম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডে উন্নীত করা, ১০০ ভাগ পদোন্নতির সুযোগ প্রদানের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার এসোসিয়েশন। সম্প্রতি তারা এই দুটি দাবিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে স্মারকলিপি ও চিঠি দিয়েছে। একইসাথে সম্প্রতি সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসারদের নিজ জেলার বাইরে বদলির মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তও বাতিলের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
জানা যায়, ১৯৮৫ সালে নিয়োগ বিধিমালার পরে ১৯৯৪ সালে এইউইও পদটি ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয় এবং সে সময়ে তার অধস্তন প্রধান শিক্ষক পদটি ১৪তম গ্রেডে এবং সহকারী শিক্ষক পদটি ১৮তম গ্রেডে ছিল। প্রধান শিক্ষক পদটি তিন দফায় উন্নীত করার ফলে ২০১৪ সালে ১১তম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষক পদটি চার দফায় ২০২০ সালে ১৩তম গ্রেডভুক্ত হয়। একই সময়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদটি ৯ম গ্রেড থেকে ৬ষ্ঠ গ্রেডে, পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট পদটি ৯ম গ্রেড থেকে ৬ষ্ঠ গ্রেডে এবং পিটিআই ইন্সট্রাক্টর পদটি ৩য় শ্রেণি থেকে ৯ম গ্রেডে উন্নীতকরণ করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ২৮ বছর পর্যন্ত সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার পদটি ১০ম গ্রেডেই রয়েছে।
এদিকে ১৯৮৫ সালের নিয়োগবিধি অনুযায়ী উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার পদ থেকে উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতির সুযোগ ছিল ৫০ শতাংশ। কিন্তু ১৯৯৪ সালে সেটি কমিয়ে করা হয়েছে ২০ শতাংশ। অথচ সহকারী শিক্ষা অফিসার ও শিক্ষা অফিসার পদে নিয়োগের যোগ্যতা ও পদ্ধতি একই।
শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার তৃণমূলের নিকটতম কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার (এইউইও/এটিইও) প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক এবং বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যবৃন্দের সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। একই সাথে তাদের তত্ত¡াবধান ও সহযোগিতা করে থাকেন। এছাড়া মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালুকরণ, ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীতকরণ, শতভাগ শিশু ভর্তির কারণে শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি, সকল শিক্ষকের গ্রেড উন্নীতকরণ ইত্যাদিও যুক্ত হয়েছে তাদের কাজে। প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান, শিক্ষার মান নিয়েও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয় এসব কর্মকর্তাকে।
তবে সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে পরিদর্শন করেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবসহ বেশি কিছু কর্মকর্তা। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও শিক্ষার মান নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তারা। এরপরই সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের নিজ জেলা থেকে বদলীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
যদিও শিক্ষক ও শিক্ষার মান নিয়ে এককভাবে শুধু শিক্ষা কর্মকর্তাদের দায়ী করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা। তারা বলেন, জাতীয়করণের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে জাতীয়করণ করা হয়েছে তাদের মান এমনিতেই প্রত্যাশিত নয়। ফলে এসব স্কুলে পড়াশুনার ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেশিরভাগ দরিদ্র শ্রেণির মানুষের ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করে। এজন্য প্রত্যাশিত মান অর্জন চ্যালেঞ্জ। তারপরও নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে, শিক্ষকদের মানোন্নয়নে এবং শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করতে চাপ দেয়া হচ্ছে। এতোকিছুর পরও শুধু শিক্ষা কর্মকর্তাদের দায়ী করা অমানবিক।
বাংলাদেশ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, একজন সহকারী শিক্ষা অফিসারের অধীন প্রায় ৩০ জন প্রধান শিক্ষক এবং ১৬০-২০০ জন সহকারী শিক্ষক রয়েছে, যাদের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন প্রদান, ছুটি মঞ্জুর, অ্যাকাডেমিক তত্ত¡াবধান, মনিটরিং ও মেন্টরিং সার্বিক সহযোগিতা করে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এছাড়াও প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, শিক্ষক-অভিভাবক সমিতির সদস্যসহ বিশাল অংশিয়ানদের সমন্বয় ও নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে উপজেলা পর্যায়ে। তাই এ পদটি ৯ম গ্রেডে উন্নীত করার যৌক্তিকতা অপরিসীম।
মন্ত্রণালয় নিজ জেলার বাইরে বদলীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার এসোসিয়েশনের সভাপতি এমএএস রবিউল ইসলাম বলেন, ৯ম গ্রেড দিলে দেশের কোথাও যেতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, নিজ জেলার বাইরে দিলেই কি শিক্ষার মান রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাবে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে অন্যত্র চাকরি করে কি তাদের শতভাগ সেবা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করতে পারবে। বরং নিজ জেলায় পরিবারের সাথে থেকেই এখন যেভাবে এইউইও/এটিইও’র কাজ করছেন সেটিই বহাল রাখলে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি সম্ভব।
সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশুনার মান সন্তোষজনক নয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী যার যার শ্রেণির সাধারণ পড়াশুনাগুলো পারার কথা সেগুলোও পাড়ছে না। অনেক শিক্ষক অনুপস্থিত থাকছেন, বেশিরভাগই উপজেলা বা জেলা শহরে বাস করছেন। ফলে শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। আর এ সুযোগটি নিচ্ছে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সাহায্যে। এজন্য মন্ত্রণালয় তাদের নিজ জেলার বাইরে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন