আজ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ইংল্যান্ড দলের ঐতিহাসিক পাকিস্তান সফর। জস বাটলারের অনুপস্থিতিতে ৭ ম্যাচ টি-টোয়েন্টির এই সফরে ইংলিশদের নেতৃত্ব মঈন আলীর কাঁধে। যার শরীরে বইছে পাকিস্তানী রক্ত। ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম পিতৃভূমে সফরের অনিভূতি জানিয়ে যিনি কলাম লিখেছেন ইংল্যান্ডের পত্রিকা ডেইলি মেইলে। সেটিই ভাষান্তর করে দৈনিক ইনকিলাবের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমার দাদা শাফায়াত যখন পাকিস্তান থেকে ইংল্যান্ডে চলে আসেন, কোনো একদিন তার নাতি পেশাদার খেলোয়াড় হয়ে আশ্রিত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে পিতৃপুরুষের দেশে ফিরবে বলে তিনি ভাবতে পেরেছিলেন কি না আমার সন্দেহ আছে। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার হিসেবে অনেকবার অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে ক্যারিবিয়ানে সফর করেছি আমি। তবে এবারের পাকিস্তান সফরটি সবচেয়ে ‘বিশেষ’। পাকিস্তানের মানুষের সামনে খেলতে পারাটা আমার জন্য স্মরণীয় কিছু হতে যাচ্ছে, একই সঙ্গে জশ বাটলারের অনুপস্থিতিতে ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেওয়াটাও খুব সম্মানের।
অনেকেই জানেন না যে আমার পরিবারে ইংলিশ, পাকিস্তানি দুই রক্তই আছে। আমার প্রয়াত নানি বেটি কক্স একজন ইংলিশ। তবে আমার ক্রিকেটীয় দিকটি এসেছে পাকিস্তানি দিক থেকে। আমি টেপ টেনিস বলে ক্রিকেট খেলে বেড়ে উঠেছি, যেমনটা পাকিস্তানে হয়ে থাকে। আমার বাবা সব সময় বলতেন, আমার খেলার মধ্যে ভয়ডরহীন এশিয়ান স্টাইল আছে।
প্রকৃতপক্ষে ২০০৫ সালের পর এবারই প্রথম পাকিস্তানে এসেছে ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের সর্বশেষ সফরের সময় আমার বয়স ছিল ১৮ বছর, এখন ৩৫। বলতে দ্বিধা নেই, সফরটির জন্য আমি দীর্ঘদিন অপেক্ষায় ছিলাম। বিশেষ করে ইংল্যান্ড দলের এখানে আসাটা বড় ব্যাপার বলে। আমিসহ দলের বেশ কয়েকজন পিএসএলে (পাকিস্তান সুপার লিগ) খেলেছি এবং বিশ্বাস করুন, বিশ্বের এই অঞ্চলে খেলাটির প্রতি যে ভালোবাসা আর আবেগ, তা আর কোথাও নেই। আমি আগেও বেশ কয়েকবার এখানে এসেছি, কিন্তু এই যাত্রাটা আদিল রশিদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারাটা গর্বের, কারণ ওর ধমনিতেও পাকিস্তানের রক্ত বইছে।
আমরা যখন করাচির জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান থেকে নামছিলাম, সত্যিকার অর্থেই মনে হচ্ছিল চিমটি কেটে দেখি, আসলেই এসেছি কি না। পাকিস্তান আমার হৃদয়ে বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে। কারণ, এখানেই আমার মা জন্ম নিয়েছিলেন। করাচিতে আমার বাবা এবং তার যমজ ভাইয়ের জীবন বাঁচিয়েছিলেন একজন চিকিৎসক, যখন তাঁদের সাত মাস বয়স ছিল। তখন তারা ছিলেন কাশ্মীরের দাদাল গ্রামে। ওই সময় দাদাল ছিল প্রান্তিক এলাকা, চিকিৎসার জন্য আমার বাবা ও চাচাকে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আমরা আশা করছি, ভয়াবহ বন্যা যখন পাকিস্তানের জীবনযাপনকে দুঃখজনকভাবে কঠিন করে তুলেছে, তখন ক্রিকেট খেলে এ দেশের মানুষের মনোবল বাড়াতে পারব। খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের দেওয়া অনুদানকে দুর্যোগ সহায়তায় কাজে লাগানোটা ইসিবির একটি চমৎকার উদ্যোগ। আমরা বৃহস্পতিবার সকালে করাচিতে পৌঁছেছি একটি কোলাহলময় পরিবেশের মধ্যে। এখানে তারা আমাদের ভিভিআইপি সুরক্ষা দিয়েছেন, যেটা রাষ্ট্রপ্রধানদের দেওয়া হয়। বিমান থেকে নামার পর আমাদের সরাসরি বুলেটপ্রুফ বাসে করে সশস্ত্র বাহিনীর একটি বহরের নিরাপত্তায় টিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
অবশ্যই এ সফর ক্রিকেটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি আমাদের জন্যও। এই কন্ডিশনে সাতটি টি-টোয়েন্টি একটি কঠিন পরীক্ষা হবে এবং আগামী মাসে অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপের আগে আমরা কোথায় আছি, সেটিও ভালোভাবে বোঝা যাবে। গত বছর বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের কাছে বেদনাদায়ক হার এবং এউইন মরগানের অবসর আর জনি বেয়ারস্টোর বিস্ময়কর চোটের পর থেকে আমাদের দলে কিছু পরিবর্তন এসেছে। যে কারণে সিনিয়র হিসেবে আমার কাঁধে কিছু বাড়তি দায়িত্ব আছে। তবে এমন কিছুর জন্যই আমি উন্মুখ হয়ে আছি।
আমাদের দল পূর্ণ শক্তির নয়, তবে অভিজ্ঞতা আর প্রতিভার সমন্বয়ে খুব রোমাঞ্চকর দল। সিরিজে ম্যাচের সংখ্যা সাতটি হওয়ায় জ্বলে ওঠার জন্য প্রচুর সুযোগ রয়েছে। আমি টম হেলসকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত, যে কিনা দ্য হান্ড্রেডে দুর্দান্ত ছিল। অলি স্টোনও ফিট হয়ে ফিরেছে। কিছু নতুন মুখের সঙ্গে ক্রিস ওকস এবং মার্ক উডের মতো পুরোনো মুখগুলোর দলে ফিরে আসাটাও দারুণ ব্যাপার। আমি তাকিয়ে আছি অ্যালেক্স হেলসের দিকেও। তার পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ায় দারুণ খেলার অভিজ্ঞতা আছে।
এই সফরে আমাদের জীবন কঠিন হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে যখন হোটেল আর মাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়, তখন এটা হতেই পারে। পরিবার থেকে দূরে থাকাটাও চ্যালেঞ্জিং। সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার ছিল আমার পরিবার এবং আমার দুই সন্তান—আবু বকর ও হাদিয়াকে বিদায় জানানো। তাদের এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে এবং বুঝতে পারে, কেন তাদের বাবাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। কিন্তু এই কাজ আমরা যতবারই করি না কেন, এটি কখনোই সহজ নয়।
ডিসেম্বরে পাকিস্তানে টেস্ট সফর নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু কথাবার্তা হয়েছে। বাজ (ব্রেন্ডন ম্যাককালাম) ও স্টোকসি (বেন স্টোকস) যেভাবে খেলাটার গতি পরিবর্তন করেছে, তাতে টেস্ট দলের খেলা দেখতে দারুণ লাগবে। ওটা ছিল বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেওয়ার মতো। বাইরে থেকে দেখলে এ ধরনের ক্রিকেট দেখাটা ভেতরে উত্তেজনা তৈরি করে, আর আমিও এভাবে স্বাধীনতা ও আগ্রাসন নিয়ে খেলতে পছন্দ করি।
ম্যাককালামের সঙ্গে আমার কয়েকবার কথা হয়েছে। তিনি এমন একজন, যাঁকে না বলা খুব কঠিন! কিন্তু আমার নিজের কাছে সৎ থাকতে হবে। আমি বিভিন্ন কারণে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছিলাম। আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি, দেখা যাক কী হয়। এখনো তো কয়েক মাস বাকি। তবে এ মুহূর্তে আমার মনোযোগ ইংল্যান্ডের হয়ে আরেকটি বিশ্বকাপ জেতার জন্য প্রস্তুত হওয়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন