নেপালের কাঠমান্ডুতে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশ নারী দলের শ্রেষ্ঠত্ব এবারই প্রথম। এই দলের দুই গর্বিত সদস্য উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের দুই নারী ফুটবলার সোহাগী কিসকু ও স্বপ্না রানী। তাদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ চাম্পিয়ান হওয়ায় পুরো জেলাসহ উপজেলাজুড়ে আনন্দের বন্যা বইছে। খেলা শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। স্বপ্না আর সোহাগীকে নিয়ে গর্বিত রাণীশংকৈলসহ ঠাকুরগাঁও জেলাবাসী। ফাইনাল জয়ের পরই গ্রামবাসীরা সোহাগী-স্বপ্নার পরিবারকে মিষ্টিমুখ করান, জানান অভিনন্দন।
এই তো সেদিনের কথা। যে গ্রামবাসী সবসময় বলত মেয়েরা ফুটবল খেলবে এ নিয়ে কত কথা, কত কটূক্তি! সেসব উপেক্ষা করে খেলা চালিয়ে গেছেন সোহাগী কিসকু আর স্বপ্না রানীরা। এখন তাঁরা বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের নিয়মিত মুখ। দুজনের বাড়িই ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলায়। সেখানে তাঁদের পরিববারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় ইনকিলাব প্রতিবেদকের। কথায় কথায় উঠে আসে সোহাগী-স্বপ্নাদের ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য সোহাগী কিসকু। বাবা গুলজার কিসকু পেশায় কৃষিশ্রমিক। সোহাগীরা তিন বোন, দুই ভাই। বড় বোন ইপিনা কিসকুর বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি চার ভাই-বোনই ফুটবল খেলে। ছোট বোন কোহাতি কিসকু অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় নারী দলের খেলোয়াড়। জাতীয় নারী দলের সদস্য সোহাগীর ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প বলতে গিয়ে গুলজার কিসকু জানান, ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি সোহাগীর টান ছিল। প্রাইমারি স্কুলে থাকা অবস্থায় বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট দিয়ে ফুটবল খেলা শুরু তাঁর। এরপর যখন রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি করে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন, তখন সোহাগী সেখানে যোগ দেন। এটা দেখে ‘মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে মাঠে খেলে, লজ্জা-শরম নেই, এদের কখনো বিয়ে হবে না’- এমন সব কটূক্তি করতেন গ্রামের অনেকে। রেগে গিয়ে তিনি মেয়েকে ঘরে আটকে রাখতেন। তবে সুযোগ পেলেই মাঠে চলে যেতেন সোহাগী।
নিয়মিত অনুশীলনে অনূর্ধ্ব-১৪ ঠাকুরগাঁও জেলা দলে জায়গা করে নেন সোহাগী। ২০১৭ সালে ঠাকুরগাঁও জেলা ফুটবল দল বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়। সেবার সোহাগী অসাধারণ পারফর্ম করেন। সে সময় সোহাগী বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) এক কর্মকর্তার নজরে পড়েন। ওই কর্মকর্তা নারী ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনকে সোহাগীর ব্যাপারে জানান। তিনি তাজুল ইসলামকে ফোন করে সোহাগীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে বলেন। এরপর সোহাগী অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব–১৮ পেরিয়ে এখন জাতীয় দলে।
সোহাগীর বাবা জানান, মেয়ের খেলা হলে পরিবারের সবাই মিলে দেখেন। গত সোমবারেও বাংলাদেশ ও নেপালের ফাইনাল খেলাটিও তিনি দেখেছেন। সোহাগী কিসকুর বোন ইপিনা কিসকো বলেন, ‘বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল ফাইনালে জয়ী হয়েছে। এই দলে আমার বোনও রয়েছে। আমরা সবাই খুশি আর সেই সাথে ঠাকুরগাঁও জেলাবাসী তাদের জন্য আজ গর্ববোধ করছে।’
পাশের বনগাঁও শিয়ালডাঙ্গী গ্রামে স্বপ্নাদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল স্বপ্নার মা সাবিলা রানী তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত। স্বপ্নার কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘ফুটবল খেলতে গিয়ে মেয়েটা কতই না কষ্ট করিছে। মেয়েটার জন্য আজ ভালো লাগছে।’ স্বপ্নার বাবা নীরেন হৃদরোগে ভুগছেন। খুব একটা কাজ করতে পারেন না। স্বপ্নার বড় বোন কৃষ্ণা রানীর সেলাইয়ের আয়ে সংসার চলে। আরেক ভাই ও বোন লেখাপড়া করছে। স্বপ্নার বাবা জানান, স্বপ্না ২০১৬ সালের দিকে স্থানীয় নারী ফুটবল দলে সুযোগ পান। সেখান থেকে ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলার পর ২০১৯ সালে জাতীয় নারী ফুটবল দলে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলা শুরু করেন। স্বপ্নার বাবা বলেন, ‘বাড়ি রানীশংকৈল শুনলে অনেকেই বলেন, ফুটবল খেলে স্বপ্নাকে চেনেন? তাঁদের যখন বলি, আমিই স্বপ্নার বাবা, তখন তাঁরা আমাকে খুব সম্মান করেন। মেয়ের জন্য গর্বে বুকটা ভরে যায়। তবে মেয়ে ফাইনালে খেলার সুযোগ পেলে আরও ভালো লাগত। তবে মেয়ে খেলেনি, তাতে কী হয়েছে? আমরা তো জিতেছি! যে মেয়েরা আমাদের জন্য এত সম্মান এনে দিল, সেই দলে আমার মেয়েও আছে, ভাবতেই ভালো লাগছে।’
রাণীশংকৈল রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির পরিচালক সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম বলেন, ফুটবলের প্রতি সোহাগী আর স্বপ্নার প্রবল আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহ থেকেই একের পর এক সীমানা পেরিয়ে গেছেন তাঁরা। তাঁদের দেখে আরও কিশোরী ফুটবল খেলায় মনোযোগী হচ্ছে। একাডেমির কাকলি আকতার ও ঈশিতা পর্তুগালে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছে। কবিতা, প্রতিকা, অনিকা, মৈত্রীসহ কয়েকজন জাতীয় পর্যায়ে খেলার স্বপ্ন দেখছে। তাদের অনুপ্রেরণা এখন সোহাগী আর স্বপ্না। উপজেলার হোসেনগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান মতি বলেন, ‘স্বপ্না ও সোহাগী দুই নারী খেলোয়াড় আমার ইউনিয়নের। তারা দুজনে নিম্নবৃত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে। তারা জাতীয় দলের হয়ে খেলায় অংশগ্রহণ করেছে, নারী ফুটবল দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাদের জন্য আমরা আজ গর্বিত। আজ পুরো জেলাবাসী অনেক আনন্দিত তাদের এমন সাফল্যে।’
রাণীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির স্টিভ বলেন, ‘প্রথমত বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলকে অভিনন্দন জানাই। এ উপজেলার দুজন নারী খেলোয়ার জাতীয় দলের হয়ে খেলায় অংশগ্রহন করায় তাদের জন্য আমরা গর্বিত। সোহাগী কিসকু ও স্বপ্না রানী আগামী ৫ অক্টোবর ছুটিতে আসলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। স্বপ্না ও সোহাগীকে অভিনন্দন জানিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী জাতীয় নারী ফুটবল দলে আমাদের রাণীশংকৈলের দুজন খেলোয়াড় প্রতিনিধিত্ব করেছে, এতে আমরা গর্বিত। আমরা আশা করছি যেভাবে আমাদের নারী ফুটবলাররা এগিয়ে যাচ্ছে। সামনের দিনে আমাদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন