ত্রিভান্দ্রাম (ইদানীং তিরুবন্তপুরম) কেরালার রাজধানী থেকে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের প্লেনটি উড়াল দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিগন্তহীন এক মহা জলরাশির উপর আমরা চললাম। নাকি ভাসলাম! আমরা ইন্ডিয়া থেকে হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মালদ্বীপ যাবো। পোর্ট এন্ট্রি সুবিধার কারণে মালদ্বীপ লোভনীয় হয়ে উঠেছিল। পাসপোর্টে আরেকটা সীল পড়ুক না!
আমার কেন যেন ত্রিভান্দ্রাম ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছিল। বিশেষত,যে হোটেলে ছিলাম মাত্র একটি রাত,সেই হোটেল ‘সমাগমাম’– এর জন্য মনটা কী-রকম হু হু করে উঠল। খারাপ লাগল। সস্তায় এতো সুন্দর আরামদায়ক আবাসিক হোটেল সর্বত্র পাওয়া মুশকিল। খুব বেশি পাওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, ত্রিভান্দ্রাম থেকে নিকটেই এখানকার কোভালাম (কোয়ালাম) সী বীচ আর ভারতের সর্ব দক্ষিণের রূপকথার রহস্যে মোড়ানো কন্যাকুমারীর কথা ভুলবার নয়,ভুলতে পারছি না স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিবিজড়িত কন্যাকুমারী। ছিমছাম পাহাড়ী শহর তিরুবন্তপুরম আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সে কথা পরে।
কেরালাকে আমি নাম দিয়েছি নারকেল বৃক্ষের দেশ। সত্যি,এখানে যেদিকে চোখ যায়,শুধুই নারকেল আর নারকেল বৃক্ষে সবুজ হয়ে আছে আকাশ– দৃষ্টির সীমানা। নদী,লেক জলাশয়গুলোতে, আমাদের দেশে যেমন পাটজাগ দেয়া হয়,তেমনি নারিকেল-এর স্তূপ জাগ দেয়া। সম্ভবত, সহজে ‘ছিলা’ বার করার জন্য এই ব্যবস্থা।
সেক্ষেত্রে ভারতের অপর অঙ্গরাজ্য তামিলনাড়ুকে কি বলব! তালবৃক্ষের দেশ! তালগাছ আর তামিলনাড়ু নামের মধ্যে কোনো সংযোগ আছে কি-না কে জানে? থাকলেও থাকতে পারে। সে যাক গে। কলকাতা-হাওড়া থেকে কোচিন-পাটনা এক্সপ্রেসে টানা তিপ্পন্ন ঘন্টা ট্রেন ভ্রমণ করে কেলালায় এসেছিলাম। সেই অপরূপ ভ্রমণ ও পৃথিবীর পথে চলতে চলতে এক ভিন্ন অনুভূতির গল্প হয়তো কোনো এক সময় লিখব।
ত্রিভান্দ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনটি ওড়া মাত্রই আমরা,মূলত ভাসলাম আরব মহাসাগরের নীল জলরাশির উপর দিয়ে। তখন দুপুর। আকাশে দগদগে দিবাজ্যোৎস্নার মতো সাদা আলো। বন্ধু বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সিট বদল করে আমি জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। বাসুদেব তার ঘন কালো গোঁফের নিচ দিয়ে খানিক হেসে চোখ পিটপিট করে এক সময় ঘুমে তলিয়ে গেল। সে মূলত কুম্ভকর্ণ শ্রেণীর প্রাণী। বাইরে তাকিয়ে আছি আমি। ধবল মেঘের বনরাজি– বৃক্ষ-মেঘের অরণ্য যেন আকাশে নিথর হয়ে আছে! মাঝে মাঝে সেই মেঘারণ্যের আড়াল থেকে সূর্যের সোনালি আলো-রোদের ঝিকিমিকি সে এক আশ্চর্য আর বর্ণনাতীত দৃশ্য। তখন মনে হয়,জন্মই বৃথা– এই অপরূপ পৃথিবীর কোনও রূপই আমার দেখা হল না। কিছু না দেখেই একদিন চলে যেতে হবে– অতলে অন্ধকারে।
প্লেন থেকে ভারত মহাসাগর,আরব সাগরের উপরে নিঃসীম আকাশের সৌন্দর্য্য দেখছি আর অন্তরে বেজে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ– “আকাশে ধায় রবি-তারা ইন্দুতেৃ/তোমার বিরামহারা নদীরা ধায় সিন্ধুতেৃ/তেমনি করে সুধাসাগর সন্ধানেৃ/আমার জীবনধারা নিত্য কেন ধাওয়াও না!”
আমার বড়ো বোনকে পরে,চিঠিতে এই আকাশ-দৃশ্যের কথা লিখেছিলাম। বেচারার ভোম্ভলমার্কা জামাইটা ওকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায় না! আফসোস!
প্লেনের জানালা দিয়ে,নিচে ভারত মহাসাগর-ত্রিভান্দ্রাম ঘেঁষে তার বিশাল প্রলয় নাচন দেখছি। কিন্তু আকাশের এতো ওপর থেকে সমুদ্রের নীলাভ-সাদা আভা-ঢেউ শুধুমাত্র চিক্ চ্কি করছিল। সে এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা।
আমার খুবই ভয় করছিল,যদি প্লেন ভেঙে পড়ে ওই অনন্ত জলরাশির অতলে! মানসিকভাবে আমার কিছুটা দুর্বলতা আমি নিজেই টের পাই। অকারণেই আমি মাঝে মাঝে মৃত্যুশংকায় ব্যস্ত হয়ে উঠি। এ-কথা বাসুদেবকে জানাতেই,সে ভ্রু-কুঞ্চিত করে চোখ কুঁতকুঁতিয়ে একটু তাকালো,তারপর সামনে রাখা একটা ইংরেজি ম্যাগাজিনে নাক-মুখ ঢেকে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে ভাসমান শূন্যযানের ভেতরে,হৃদপিণ্ডে তীব্র চাপ অনুভব করছি আমি। বিশেষ করে কানের ভিতরটা মারাত্মক ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে অক্সিজেনের অভাবে দমও বন্ধ হয়ে আসছে। অস্বস্তিকর অবস্থা। চকলেট চিবুতে লাগলাম। তাতে নাকি বুক-কান-মস্তিষ্কে চাপ কম অনুভূত হয়। এ-দেখছি– হাওয়ায় ভাসার জ্বালাও কম না!
তিরুবন্তপুরম থেকে মালে অর্থাৎ মালদ্বীপের রাজধানীতে পৌঁছতে সময় লাগবে এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট। এতো লম্বা সময় শূন্যে ভাসিনি কখনও,এর আগে। তাই ভয় পাচ্ছিলাম। তবে তুলো-মেঘের অপার সৌন্দর্য্য আমাকে মুগ্ধ-বিহ্বল করে রেখেছে। এর আগে ঢাকা-কলকাতা ফ্লাইট ছিল গভীর রাতে। রাতের অন্ধকারে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মিনিটের ঢাকা টু কলকাতা যাত্রায় একমাত্র বিস্ময় ছিল লাল নিয়নে হঠাৎ জ্বলে-ওঠা বাংলা অক্ষরমালাঃ ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর,দমদম’– এই জাতীয় একটা সাইনবোর্ড! বিদেশে সে-ই ছিল প্রথম মাতৃভাষার সঙ্গে আলিঙ্গন। দমদমে নামছি,বাংলা সাইনবোর্ড দেখছি– ওই ভাষা আমার,ওই দেশ আমার ছিল না!
মালদ্বীপের রাজধানীতে পৌঁছতে সময় লাগবে এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট– এই ঘোষণা পূর্বেই দিয়েছে কিন্নরকণ্ঠী বিমানবালা বা এয়ারহোস্টেস। হিন্দি ও ইংরেজি– উভয় ভাষাতেই।
প্লেন মালে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার পূর্ব পর্যন্ত নীচে অনন্ত জলরাশি,ওপরে আকাশের শূন্যতায় ভাসমান সফেদ রঙের তুলো মেঘ ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। ছিল মায়াবী রোদের নরম ছোঁয়া। আর আমার আত্মায় জেগে-ওঠা নববিস্ময়। প্লেন ল্যান্ড করার সময়ের পূর্ব থেকেই মহাসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তলে দোয়লায়মান বিশাল শ্যাওলার মতো,আকারে গোল গোল বর্ণিল স্থাপনা চোখ জুড়িয়ে দিল। পরে দেখলাম,জানলাম– ওই ভাসমান শ্যাওলাগুলো আসলে একেকটি আলাদা দ্বীপ! অনেক উপর থেকে প্লেন নিচে নামার সময় দ্বীপের এই শ্যাওলা-রূপ আমাকে পাগল করে তুলল। নীল সাগরের বুকে এ যেন মুক্তোর মালা! এরকম প্রায় বারো’শ দ্বীপ নিয়ে এক জলে-ভাসা দেশ – মালদ্বীপ। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন