বঙ্গোপসাগরের সুবিশাল পানিরাশি এখন সুনীল, শান্ত ও স্বাভাবিক। সমুদ্র বন্দরসমূহে আপাতত নেই কোন সতর্ক সঙ্কেত। তবে কয়েকদিন পরেই বঙ্গোপসাগর ভয়াল রূপ ধারণ করবে। নীল পানিরাশি ঘোলাটে ও প্রলয়-উত্তাল এবং উপকূলকে ভাসিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিতে ধেয়ে আসছে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস। আসন্ন এই ঘূর্ণিঝড়টি শক্তিমত্তায় হতে পারে সুপার সাইক্লোন। সমুদ্রের বুকে অবিরাম তাপমাত্রা বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের আবহ তৈরি হচ্ছে। আসন্ন এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘সিত্রাং’। এটি থাইল্যান্ডের দেয়া নাম। এর অর্থ ‘পাতা’।
আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল ‘গ্লোবাল ফোরকাস্ট সিস্টেম’ (জিএফএস) জানায়, আগামী ১৮ থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে একটি সুপার সাইক্লোন সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাসেও একই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বঙ্গোপসাগরে চলতি মাসে এক বা দু’টি লঘুচাপ-নিম্নচাপ সৃষ্টি এবং এর মধ্য থেকে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার আশঙ্কার কথা জানায়। এসব পূর্বাভাস থেকে অক্টোবর-নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা জেগে উঠছে।
আগামী ২৫ অক্টোবরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়ে যে ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে সেটি সরাসরি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মাঝামাাঝি সুন্দরবন অঞ্চল অতিক্রম করতে পারে। ‘সিত্রাং’-এর গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২১০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। আসন্ন ঘূর্ণিঝড়টি তার শক্তিমত্তায় বিগত ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘সিডরে’র সমান এমনকি এর চেয়েও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি ‘সিডর’ ও ‘আম্পানে’র প্রায় একই গতিপথে অগ্রসর হতে পারে।
অমাবস্যার বর্ধিত প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়ের গতি ও শক্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’-এর আঘাতে লণ্ডভণ্ড হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিস্তীর্ণ উপকূলভাগ। তছনছ হতে পারে সুন্দরবন। ‘সিত্রাং-এর কারণে সমুদ্র উপকূল-চর-দ্বীপাঞ্চলের লাখ লাখ দরিদ্র জনগোষ্ঠি হুমকিতে রয়েছেন। তাছাড়া উপকূলীয় ১৯টি জেলায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ^বিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল জিএফএস-এর বরাত দিয়ে জানান, ১৮ থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে একটি সুপার সাইক্লোন সৃষ্টির আশঙ্কার বিষয়ে জিএফএস পূর্বাভাস দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় তৈরির আগে লঘুচাপ-নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে। এটি পরিণত হবে ঘূর্ণিঝড়ে। আসন্ন ঘূর্ণিঝড়টির নাম ‘সিত্রাং’। প্রাথমিক পূর্বাভাস অনুযায়ী এই ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন উপকূলের উপর দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করতে পারে।
তবে গত ৯ অক্টোবর পূর্বাভাসে বলা হয়, সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করতে পারে। এ অবস্থায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, আসন্ন এই ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন উপকূলের মাঝামাঝি যে কোন স্থান দিয়ে স্থলভাগে আঘাত করতে পারে।
জিএফএস পূর্বাভাস মডেলের বরাত দিয়ে মোস্তফা কামাল আশঙ্কা করেন, আসন্ন ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ সুপার সাইক্লোনের শক্তি অর্জন করতে পারে। অর্থাৎ এর বাতাসের গতিবেগ ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’র মতো ঘণ্টায় ২১০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। অক্টোবরের ২৫ তারিখ অমাবস্যা। এর ফলে ঘূর্ণিঝড়টি জোরদার হয়ে যদি অক্টোবরের ২২ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে স্থলভাগে আঘাত করে, তাহলে যে স্থানে আঘাত করবে সেখানকার উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড করার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া অমাবস্যার বর্ধিত জোর বা শক্তি যদি যোগ হয় তাহলে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সাথে আঘাতের স্থলের সেই উপকূলীয় এলাকায় স্থানভেদে ১০ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানায়, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। যা ঘনীভূত হয়ে পরবর্তী ধাপে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে সুপার সাইক্লোনের মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝামাঝি উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সমুদ্রের বুকে অবিরাম ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিংবা তারও ঊর্ধ্বে তাপমাত্রা বিরাজমান থাকলে সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আবহ তৈরি হয়। যা বর্তমানে বিদ্যমান। আবহাওয়াবিদরা জানান, বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের (বিএমডি) ইতোমধ্যে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দু’টি লঘুচাপ সৃষ্টি, এর মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার আশঙ্কার কথা জানায়।
তবে এর দিনক্ষণ এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। লঘুচাপ-নিম্নচাপ ধাপে ধাপে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে ৩ থেকে ৫ দিন লাগতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের উপর এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে এখনও মৌসুমী বায়ু বিরাজমান। চলতি অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিতে পারে। এর ফলে সাগরে লঘুচাপ-নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে তাতে বৃষ্টিপাত হয়। ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা সাধারণত থাকে না। মৌসুমী বায়ু বিদায় নেয়ার পর যখন সাগরে লঘুচাপ-নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় সেটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার আশঙ্কা থাকে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের উৎপত্তি হয় বঙ্গোপসাগরে। আর, সবচেয়ে বেশি আঘাত আসে বাংলাদেশ এবং এর সংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-উড়িষ্যা-অন্ধ্র উপকূলভাগের এই বেল্ট বা বিশাল তটরেখা বরাবর। ফানেল, চোঙা কিংবা ত্রিকোণাকৃতির অবস্থানের কারণে বঙ্গোপসাগরের বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-উড়িষ্যা-অন্ধ্র উপকূলের দিকে। সেই সাথে ভয়াল জলোচ্ছ্বাস ছোবল হানে। বাংলাদেশসহ এই বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের দুর্যোগ ইতিহাস পর্যায়ক্রমে দেখা যায়, অতীতকাল থেকে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে অনেকগুলো সাইক্লোন আঘাত হেনেছে এ অঞ্চলে। ‘সিডর’সহ ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে বঙ্গোপসাগরীয় দেশসমূহের অঞ্চলের ৫০ কোটি মানুষের।
বঙ্গোপসাগরে আসন্ন ঘূর্ণিঝড়টির নাম দেয়া হয়েছে থাইল্যান্ডের প্রস্তাব অনুসারে ‘সিত্রাং’। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার অধীন জাতিসংঘের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (এসকাপ) সাগর তীরের ১৩টি দেশের (বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, সউদী আরব ও ইয়েমেন) আবহাওয়া সংস্থার সম্মিলিত প্রস্তাব অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া হয়ে থাকে।
টানা খরা-অনাবৃষ্টি, তীব্র তাপদাহ, ঢল-বন্যা, বজ্রপাতের আধিক্যসহ চলতি বছরজুড়ে অস্বাভাবিক ও চরম-ভাবাপন্ন আবহাওয়ার মধ্যেই এবার সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন