একজন নারী। পেশায় শিক্ষক। লেখালেখি করেন আগ্রহ নিয়ে। কিন্তু তাঁর স্বামী কিছুতেই তাতে সায় দিচ্ছেন না বরং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। এখন উপায়? লেখালেখি যে তাঁকে করতেই হবে! এবং সেটার জন্য কিছুটা নির্জনতা দরকার, দরকার কিছুটা সুযোগ। তখন পিএইচডি গবেষণার অজুহাতে স্বামীর কাছ থেকে কিছুটা সুযোগ বের করে নিলেন এবং গোপনেই লিখে ফেললেন একটা উপন্যাস। ঘটনা ১৯৭৪ সালের। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর স্বামী ঐ স্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও প্রতারণার অভিযোগ আনলেন। এমন বিশ্রি সংশয়ভরা সংসার কিছু বছর চললেও ঐ নারীর তৃতীয় উপন্যাস আ ফ্রোজেন ঔমেন (১৯৮১) প্রকাশিত হওয়ার পর আর তা টিকলো না। হয়ে গেল বিচ্ছেদ! সেই বিচ্ছেদের পর তিনি আর পুনঃবিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি।
তারও আগে কলেজে পড়ার সময়ই তিনি লেখা শুরু করেন। কিন্তু প্রকাশক তাঁর লেখাকে ‘অতি উচ্চাকাঙ্খী’ বলে প্রত্যাখান করেন। এরপর ত্রিশ বছর পর্যন্ত আর লেখননি। ততদিনে তাঁর বিয়েও হয়েছে। হয়েছেন ২ সন্তানের জননীও। এবং একজন শিক্ষক হিসাবে কাজ করছিলেন।
কথা বলছি আনি এরনো নামের এক বিশিষ্ট ফরাসি সাহিত্যিকের। তাঁর সমস্যা জর্জরিত জীবনের নানা সাফল্যের কথা। এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে তাঁর নোবেল সাহিত্য জয়ের কথা। প্রথম নারী ফরাসি হিসাবে তিনি এ পুরষ্কার লাভ করেন।
স্টকহোমের সুইডিশ একাডেমি বলছে, তিনি যে আপোষহীনতা এবং চরম তীক্ষèতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্মৃতির শিকড়, বিচ্ছিন্নতা এবং সামাজিক বৈষম্যের উন্মোচন করেছেন এর জন্য তাঁকে নোবেল সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে খুব সহজ ও সাবলীলভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শ্রেনি ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের মতো বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।
এরনোর জন্ম ১৯৪০ সালে। উত্তর ফ্রান্সের নরম্যাণ্ডির এক ছোট্ট শহরে। এক শ্রমজীবী ক্যাথলিক পরিবারে। তাদের একটা মুদি দোকান ও ক্যাফে ছিল। তাঁর বাবা ছিল খুবই উচ্ছৃঙ্খল ও ইতর ধাঁচের মানুষ। ১২ বছর বয়সে তিনি দেখেছিলেন তাঁর মাকে তাঁর বাবা কীভাবে হত্যার চেষ্টা করে। কোনো রাখঢাক ছাড়াই এ ঘটনাটি তিনি লিখেছেন তাঁর শেইম উপন্যাসে। বইয়ের প্রথম বাক্যটাই ছিল এমন, ‘ জুন মাসের এক রোববারে, খুব সকালে, আমার বাবা আমার মাকে হত্যা করার চেষ্টা করে।’
তিনি যেহেতু শ্রমজীবী সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছেন, তাই তাঁর ব্যক্তি জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোসহ ঐ ধরনের বিভিন্ন নারীদের অভিজ্ঞতা তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন। লিখেছেন শ্রমজীবী পরিবারের হওয়ায় মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা কীভাবে তাঁর সাথে নানা রকম টিটকারি করত।
বিশেষ করে, ১৯৬০ এর দশকে তাঁর অবৈধ গর্ভপাত, পারিবারিক জীবনের প্রতি অসন্তোষ, এক রুশ কূটনীতিকের সাথে তাঁর উথাল-পাতাল বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, তাঁর বাবা-মায়ের মৃত্যু, ব্রেস্ট ক্যান্সার ইত্যাদির বর্ণনা তিনি দিয়েছেন।
তাঁর লেখা অতীব ব্যক্তিগত এবং দৈনন্দিন যাপিত জীবনের একেবারেই মামুলি অভিজ্ঞতায় ভরপুর। এমন একজন লেখককে এবারের নোবেল সাহিত্য পুরষ্কারের জন্য নির্বাচন করাটা নোবেল কমিটির জন্য সত্যিই চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল। ৮২ বছর বয়সী এরনো নোবেল জয়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘নোবেল জয় তাঁর জন্য আসলে একটা বিশাল দায়িত্ব বটে।’ কাজেই তিনি লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন।
সমাজে নারীদের অসমতা ও সংগ্রামের বিষয়ে লিখতে তিনি এক ধরনের বাধ্যবাধকতা বোধ করেন। ‘একজন নারী হিসাবে আমার যা মনে হয় তা হলো আমরা নারীরা স্বাধীনতা ও ক্ষমতার দিক থেকে বৈষম্যের শিকার,’ বলে মনে করেন তিনি।
৫০ বছর ধরে লেখালেখি করছেন এরনো। লিঙ্গ, ভাষা ও শ্রেনিবৈষম্য উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। এরনো বলেন, ‘লেখালেখি একটা রাজনৈতিক কাজ। এটা সামাজিক অসমতা ও বৈষম্যের ব্যাপারে আমাদের চোখ খুলে দেয়। আর এই কাজে তাঁর ব্যবহৃত ভাষাকে তিনি ‘ছুরি’র সাথে তুলনা করেছেন।
তিনি আত্মজৈবনিক উপাদান দিয়েই লেখা শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে ১৯৮০ ও ৯০ এর দশকে তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তুগুলো যেমন অপ্রার্থিত গর্ভধারণ ও গর্ভপাত, তাঁর প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে ও মাতৃত্ব সম্পর্কে তাঁর দোলাচল প্রভৃতি বিষয়গুলো ফরাসি রক্ষণশীল সমাজকে বেশ আঘাত করেছিল। কিন্তু প্রশংসিত হয়েছিল বিশাল এক পাঠকশ্রেণি কর্তৃক। ৩১ বছর ধরে এরনোর বই প্রকাশ করা সেভেন স্টোরিজ প্রেস এর কর্ণধার ডান সিমন বলেন: ‘তিনি যা কিছু লেখেন তার প্রতিটি শব্দই আক্ষরিক অর্থেই সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ।’
এরনো সিমন ডি বোয়েভার ও সমাজতাত্ত্বিক পিয়েরে বোরর্দু কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিলেন। এবং ফ্রান্সের ১৯৬৮ সালের সামাজিক অস্থিরতাও তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি বলেছেন ‘তাঁর গদ্য একদম সোজাসাপ্টা এবং শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে লিখিত এবং কখনো কখনো অশালীন ঠেকে পাঠকদের কাছে।’
ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এরনো তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিগুলো নিয়ে লিখলেও সেগুলো হয়ে ওঠে নারী ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রামের সার্বজনীন এক চিত্র। তাঁর লেখায় ফ্রান্সের নজিরবিহীন সব সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র উঠে আসে। উঠে আসে প্রচলিত ক্যাথলিক ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সরে গিয়ে অধিকতর সেকিউলার, সহনশীল ও লৈঙ্গিক স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো।
১৯৯২ সাল। ফ্রান্সে প্রকাশিত হলো তাঁর সিম্পল প্যাশন নামের একটি উপন্যাস। এ বইয়ে এক বিবাহিত রুশ কূটনীতিকের সাথে আনি এরনোর পরকীয়ার সবিস্তর বিবরণ রয়েছে। এক নারীর এত খোলামেলা বর্ণনায় ক্ষিপ্ত হয়ে গেল সমাজের রক্ষণশীলরা। কিন্তু নীতি-নৈতিকতাহীন যৌন বাসনার এমন দিলখোলা কথনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো পাঠকরা। প্রকাশের ২ মাসের মধ্যেই বিক্রি হলো ২০০০০০ কপি বই!
আ গার্ল’স স্টোরি স্মৃতিকথায় এরনো তাঁর জীবনের অন্যতম চরম মর্মান্তিক একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। বইটি লিখতে লেগেছে কয়েক দশক। ঘটনাটি হলো যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর তখন অর্থাৎ ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মে এক উদ্ভট যৌন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তিনি। ফলাফল দাঁড়ায়, এরনো প্রচণ্ড লজ্জিত হন এবং অনেকেই তাঁকে বর্জন করে। তিনি তখন বিষণ্নতা ও ক্ষুধামন্দায় ভোগেন।
এরনো তাঁর জীবনের একই ঘটনাসমূহ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী হ্যাপেনিং। এ বইয়ে ১৯৬৩ সালে কলেজে পড়াকালীন তাঁর একটা গর্ভপাতের চড়া বর্ণনা আমরা পাই। প্রতিষ্ঠিত ধারার বাইরে গিয়ে এমন বর্ণনার উদাহরণ তাঁরই লেখায় প্রথম পাওয়া যায়।
এরনোর বইয়ের রিভিউ লেখক দ্যা টাইমস এর ওয়াইট গারনার বলেন, ‘কোনো রাখঢাক ছাড়াই এত সোজাসাপ্টাভাবে তিনি লিখেছেন, মনে হয় যেন একেকটি বাক্যকে কোনো শক্ত টেবিলের উপরে ছুরি দিয়ে খোদাই করছেন।’
প্রকাশক জ্যাক টেসার্দ এরনোর লেখা দ্যা ইয়ার্স বইটি পড়ে বলেছিলেন, ‘এরনো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন নারীবাদী লেখক। তাঁর লেখা অসাধারণ ও নিঃসন্দেহে মাস্টারপিস।’
অংকিতা চক্রবর্তী লিখেছেন, তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য লেখকের থেকে যৌনতার ব্যাপারে এরনোর লেখায় যে ফারাকটা দেখা যায় তা হলো মেকি লাজুকতা। তিনি কোনো কপটতা ছাড়াই তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়ে চক্রবর্তী এরনোর গেটিং লস্ট উপন্যাসের উদাহরণ টানেন। উপন্যাসে দেখা যায় এরনো ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন। সফরের শেষ দিনে, লেলিনগ্রাদে, বিবাহিত এক রুশ কূটনীতিক এর সাথে শুরু হয় তাঁর প্রেম। প্রেমিকের বয়স ৩৫; এরনোর ৪৮। এবং তাঁদের ১৮ মাসের দূরন্ত প্রেম ও কামের গল্প তুলে ধরেন অবলীলায়, বিদ্যমান রীতি রেওয়াজের বাইরে গিয়ে।
ফরাসি আরেক সাহিত্যিক এডওয়ার্ড লুইও তাঁর শ্রমজীবী শিকড়ের গল্প লেখেন। তিনি এরনোর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘কোনো রুপক, কোনো সুন্দর বাক্য কিংবা চরিত্রের ব্যবহার না করেই এরনো ফরাসি সাহিত্যে ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়েছেন। অর্জন করেছেন বিশাল সাফল্য।’ লুই আরও বলেন, ‘সাহিত্যের প্রচলিত এবং গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা-বিষয়-বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি নিজেই একটা ধারা দাঁড় করেছেন।’
আনি এরনোর প্রাপ্ত অসংখ্য পুরষ্কারের মধ্যে রয়েছে ২০০৮ সালে দ্যা ইয়ার্স বইয়ের জন্য ফ্রান্সের প্রিক্স রেনোদো পুরষ্কার, ২০১৬ সালে ইতালির প্রেমিও স্ট্রেগা পুরষ্কার এবং পরের বছর তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যকর্মের জন্য মারগারিট ইয়োরচেনার পুরষ্কার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন