শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

কালো সূর্য

মোরশেদুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০১ এএম

আমাদের দ্বিতল ভবন ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে একটা বৃদ্ধ বটগাছ। গাছটা আমার দাদা লাগিয়েছিলেন। সেটা বৃটিশ আমলের কথা। পরে স্কুলের জন্যে জায়গাটা অধিগ্রহণ করা হলে গাছটাও ধীরে ধীরে বড় হতে হতে একদিন সরকারি হয়ে যায়। দিনের বেলা স্কুলের বাচ্চাসহ পাড়ার বাচ্চারা এর নিচে খেলা করলেও রাতের বেলা গাছের ধারেকাছেও কেউ আসে না। কেউ কেউ নাকি বহু বছর আগে আত্মহত্যা করা এক নারীর কান্নার আওয়াজ শোনে। আবার নৃত্যরত আগুনের দলা দেখে কেউ কেউ। আমার চোখে কোনোদিন কিছু পড়েনি। না আমি কিছু শুনেছি কোনোদিন।

আমি শুনি নানান পাখির চিৎকার; তাদের হাসির আওয়াজ; তাদের কান্নার আওয়াজ; কখনোবা শুনি তাদের অট্টহাসি! ঢাকা শহরের অলি-গলি, স্ট্রিট-লেনর মতো গাছটার সহস্র ডালপালা। কোনটার সাথে কোনটা গিয়ে প্যাঁচ খেয়েছে বোঝা মুশকিল। সেখানেই ঠিক বস্তির মতো অসংখ্য পাখির বাসা। আবার অনেক উপরের ডালে মনে হয় যেন খয়েরী কিংবা ধূসর রঙের পলিথিনের বহু ঠোঙা ঝুলে আছে; আসলে বাদুড় সেগুলো।
আমাদের ছাদের উপরের দক্ষিণ দিকটায় উন্মুক্ত ছাতার মতো কয়েকটা ডাল ছায়া দিয়ে যায়। আমি আর আমার ছোট্ট মেয়ে প্রায়ই হাওয়া খাই এখানে এসে। আমার ছোট্ট মেয়ের নানাবিধ প্রশ্ন।
বাবা, এটার নাম কী? বাবা, ওটার নাম কী?
অনেক সময় জবাব দিতে দিতে যদি ক্লান্ত হয়ে যাই উল্টো দম ধরে ওকেই সওয়াল করি:
তুমিই বলো, কী নাম ওটার।
সে অত্যন্ত সাবলীলভাবে জবাব দেয়: কাক!
ওটা?
বুলবুলি।
আর ঐ যে ওটা?
সারস!
না, মা। ওটা সারস নয়। ওটা বক। আমি বলি।
আসলে সারস আর বকের খুব বেশি তফাৎ না থাকায় মাঝে মাঝে গুলায় ফেলে সে। ছোট মানুষ, আমার কথায় মন ভরে না তার। আরো ব্যাখ্যা চায়। শেষমেশ যখন বলি সারস তো পরিযায়ী পাখি, এই ভরা গ্রীষ্মে ওরা আর এখানে থাকে না। ঠাণ্ডা কোনো অঞ্চলে চলে গেছে। গ্রীষ্ম গেলে আবার চলে আসবে। মেয়ে আমার চুপচাপ শুনে। হয়তো বোঝে, হয়তোবা মেমোরিতে সেভ করে রাখে একদিন বড় হয়ে বুঝতে পারবে বলে! হঠাৎ মেয়ে নাক সিটকে বলে
বাবা, গন্ধ! কিসের গন্ধ?
পাচ্ছ না তুমি? উহ্! থু!
আমি টের পাই। একটা চিল অদূরেই বসে তার ব্লেডের মতো ধারালো ঠোঁটে একটা মরা ইঁদুর ছিঁড়ে খায়। চিলের নাক থাকলেও সে দুর্গন্ধ টের পায় না। অথচ বাতাসের গায়ে সে গন্ধ লাগার সাথে সাথেই, গা ঝারা দেয় বাতাস। গন্ধ ভেঙে ভেঙে চলে আসে আমাদের নাকে। ধীরে ধীরে দু’একটা কাক জুটে যায়। ভাগ বসাতে চায় কিন্তু চিল উড়ে যায়। অন্য একটা ডালে। তারপর আকাশে হারায়। মেয়ের মনযোগ ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্যে বলি:
মা, বলো দেখি, চিল ওড়ে কেমন করে?
সে দু হাত তুলে দেখায়। কিন্তু দুর্গন্ধের কথা ভোলে না। আমি সান্ত্বনা দিই, বাতাস উঠলে কিংবা বৃষ্টি আসলে এই গন্ধ আর থাকবে না, মা। আচ্ছা, চলো তাহলে এখন যাই এখান থেকে। পরে আসবো আবার। আমার ডান হাতের তর্জনি ধরে সে। সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসি নিচে।
সূর্যটাও নামে, বিকেলের পিছনে গোধূলি। তার পিছনে নামে রাত। আঁধার রাত। আম-কাঁঠাল পাকা গরম। প্রচণ্ড গরম, মনে হয় যেন খামছে ধরে আছে পৃথিবীটাকে। তাই হয়তো আঁধারও নড়াচড়া করতে পারে না।
হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভাঙে আমার। বুঝলাম দমকা শুরু হয়েছে। তড়িঘড়ি উঠে খোলা জানালা বন্ধ করি। মনের গহীনেও ঝড় বয়ে যায়। পেঁচাটা ভিজছে। বাদুড়েরা ভিজছে। কাক, শালিক সবাই ভিজছে। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের সুরে চাপা পড়ে পাখিদের কান্নার শব্দ। আর চাপা পড়ে ঘুমে আমার বিলাসী অনুভূতিরা।
ঝড়ের কারণে শীতল হওয়াবশত একটু বেশিই ঘুমাই। তাছাড়া আজ শুক্রবারও, বন্ধের দিন। আমার মেয়ে এসে – বাবা, ওঠো; বাবা, ওঠো– সরবে ডাকে। জেগে দেখি বেলা ন’টা বাজে। কোনো বৃষ্টি নেই, কোনো ঝড় নেই। জানালার থাই গ্লাস ভেদ করে তেজস্বী সূর্যের আলোয় আলোকিত আমাদের মুখ। হঠাৎ একটা কাকের গোঙানির শব্দে আমার চোখে চোখ রাখে মেয়ে।
কোথায়?
মনে হচ্ছে, ছাদে। আমি বলি।
জলদি ছাদে উঠি আমরা। খুঁজে ফিরি কাকটাকে। ছাঁদে নয়, স্কুল মাঠের এক প্রান্তে। রাতভর বৃষ্টিভেজা কাকটাকে কুকুরে ধরেছে। কামড়াচ্ছে, হাতাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে। একদম জেরবার কাক। মাঠে একটা কুকুর খেলে। আর দুই-তিনটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, হাসে, লেজ নাড়ে।
সূর্যের আলোয় ঝলমলে এই দিনে সব কিছু দেখা যায়। শুধু দেখা যায় না অন্য কোনো কাককে।
সাধারণ দিনের মতো এক কাকের বিপদে অন্য কাকেরা নেই। শালিক, ফিঙে কিংবা অন্য কোনো পাখি চিৎকার-চেঁচামেচি করছে না। কেমন গুমোট এক আবহে ডুবে আছে সবকিছু। স্কুলের বারান্দায় কিছু উঠতি বয়সের পোলাপান দেখতে পাচ্ছি। তাদের সব ক’টা মাথা একসাথে বৃত্তাকারে অবনত। খুব সম্ভব মোবাইলে গেমস খেলছে। পাবজি অথবা ফ্রি ফায়ার। আমি হাঁক ছাড়ি। – এয় জাফর, এয় জয়, এয়...!
বার তিনেক ডাকার পরে মাথা তোলে জাফর। আমি ইশারা করে তাদেরকে কাকটাকে বাঁচাতে বলি। জাফর হিশ হিশ শব্দ করে তাড়াতে চেষ্টা করে কুকুরদের। জয় মোবাইলে ভিডিও ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ততক্ষণে পরাজিত হয় কাকটা!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন