ন্যূনতম লড়াই জমাতেও পারল না বাংলাদেশ। অনেক আশা নিয়ে সিডনির গ্যালারিতে আসা হাজার হাজার দর্শকের উচ্ছ্বাস ক্রমে স্তিমিত হয়ে গেল সাকিব আল হাসানের দলের অসহায় আত্মসমপর্ণে। পরাজয়ের ব্যবধান ১০৪ রানের। রেকর্ড বই বলছে, এই সংস্করণে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরাজয়। তবে পরিসংখ্যানের বাইরে পারফরম্যান্সের বাস্তবতা বলছে, ব্যবধান আসলে আরও বড়।
বাংলাদেশ দলকে গতকাল ম্যাচ থেকে একরকম ছিটকে দেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিচিত এক মুখ। বিপিএলের দ্বিতীয় সফলতম বিদেশি ব্যাটসম্যান রাইলি রুশো তার বাংলাদেশ অভিজ্ঞতার সবটুকু কাজে লাগিয়ে উপহার দেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। এবারের বিশ্বকাপের যা প্রথম সেঞ্চুরি, তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের টানা দ্বিতীয়। রুশোর ৫৬ বলে ১০৯ রানের ইনিংস দক্ষিণ আফ্রিকাকে পৌঁছে দেয় ২০৫ রানের পাহাড়ে। ওই রান তাড়া করার শক্তি বাংলাদেশের এমনিতেও নেই। যেটুকু সামর্থ্য আছে, ব্যাটসম্যানরা পারেননি ততটুকুর ধারেকাছেও যেতে। ১৬.৩ ওভারেই তারা অলআউট ১০১ রানে।
দুর্দান্ত শুরুর পর এমন হারে হতাশা স্বাভাবিক, তবে তার চাইতেও বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত! বাংলাদেশের অধিনায়কই শুধু নন, সাকিব দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ বোলারও। নেতা হিসেবে যেমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির গুরুত্ব তার দ্রুত অনুধাবন করার কথা, তেমনি বোলিংয়ের বড় ভরসা হিসেবেও দলের প্রয়োজনে তার সামনে এগিয়ে আসাই দায়িত্ব। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিডনিতে এদিন সাকিব যখন বোলিংয়ে এলেন, ততক্ষণে ইনিংসের অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে।
১০ ওভার শেষে বোলিংয়ে তিনি আসতেই পারেন অনেক সময়। কিন্তু এই ম্যাচের প্রেক্ষাপট সাকিবকে বল হাতে দেখতে চাওয়ার দাবি করছিল আরও আগে। প্রথম ওভারের পর দীর্ঘ সময় আর উইকেট পায়নি বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকা রান তুলেছে জোয়ারের পানির মতো। কিন্তু সেই স্রোত থামানোর চেষ্টা না করে সাকিব নিজেকে রেখেছেন দূরে।
কারণটা বোধগম্যই, ‘ম্যাচ-আপ!’ উইকেটে ছিলেন দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ডি কক ও রুশো। বাঁহাতি স্পিনার সাকিবের তাই বোলিংয়ে আসা ছিল যেন ‘নিষিদ্ধ।’ ডি কক, রুশো ও ডেভিড মিলারদের কথা ভাবনায় রেখেই এই ম্যাচে মেহেদী হাসান মিরাজকে একাদশে আনা হয়। পেসার তাসকিন আহমেদের সঙ্গে এই অফ স্পিনার বোলিং শুরু করেন নতুন বলে। এই পর্যন্ত খুব বেশি আপত্তি বা প্রশ্নের কিছু ছিল না। কিন্তু ডি কক ও রুশো যখন বাংলাদেশের বোলারদের গুঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে রান তুলছেন, তখনও সাকিব নিজেকে আড়ালে রাখেন দীর্ঘসময়। ‘ম্যাচ-আপ’ অনুসরণের ভাবনা এতটাই প্রবল যে ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে পরিকল্পনায় বদল আনার কোনো তাগিদই দেখা যায় না। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন বল হাতে নিলেন বা বাধ্য হলেন, স্কোরবোর্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার রান তখন ১০ ওভারে ১ উইকেটে ৯১। দুই ব্যাটসম্যানই থিতু এবং ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভুত হয়েছেন ততক্ষণে। অমন বিধ্বংসী চেহারায় থাকা দুই ব্যাটসম্যানের সামনে শুধু সাকিব কেন, বিশ্বের যে কোনো বোলারকেই কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হয়। হলোও তা-ই। সাকিবের প্রথম ওভারে রান আসে ২১।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন ‘ম্যাচ-আপ’ তুমুল আলোচিত। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও চলছে এই শব্দ কিংবা এই কৌশলের সগর্ব বিচরণ। শ্রীধরণ শ্রীরাম টেকনিক্যাল কানসালটেন্ট হয়ে আসার পর এটির দাপট বেড়েছে আরও। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটির ব্যবহার নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে, বোলিংয়ের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে অধিনায়কের ভাবনায়। সেই মাশরাফি বিন মুর্তজা থেকে শুরু করে মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ ও সাকিব, সবাইকেই দেখা গেছে এই ভাবনায় বশ। এখনকার মতো প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘ম্যাচ-আপ’ এতটা গুরুত্ব তখন পায়নি বটে। তবে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের সামনে বাঁহাতি স্পিনার, ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য অফ স্পিনারকে বোলিংয়ে আনায় অনাগ্রহ দেখা গেছে বাংলাদেশের এই সব অধিনায়কেরই।
সাকিবের একটি ঘটনার উদাহরণ তো প্রায়ই উঠে আসে এই ‘ম্যাচ-আপ’ নিয়ে আলোচনায়। ২০১৭ বিপিএলের ফাইনালে নিজের প্রথম ২ ওভারে স্রেফ ৭ রান দিয়ে ১ উইকেট নেন ঢাকা ডায়নামাইটস অধিনায়ক সাকিব। কিন্তু পরে শেষ ওভারের আগে নিজেকে আর বোলিংয়েই আনেননি তিনি। কারণ, বাঁহাতি ক্রিস গেইল ব্যাট করছিলেন! পরে ইনিংসের একদম শেষ ওভারে এসে হজম করেন তিন ছক্কা।
ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হোক বা বড় টুর্নামেন্ট, এভাবেই ‘ম্যাচ-আপ’ ভাবনায় বুঁদ থেকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণই হাত থেকে ছেড়ে দেওয়ার নজির বাংলাদেশের ক্রিকেটে কম নেই। এই সময়ের বাস্তবতায় ‘ম্যাচ-আপ’ গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই। কিন্তু এটিই কি শেষ কথা? পরিস্থিতি দাবি করলেও কি এই বৃত্ত ভাঙার সুযোগ নেই! দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের পর এই প্রশ্ন ছুটে গেল সাকিবের দিকে। বাংলাদেশ অধিনায়ক ম্যাচ-আপের বাস্তবতার কথা বললেন, পাশাপাশি তুলে ধরলেন তার ভাবনায় অন্য কিছু কারণও, ‘এগুলো (ম্যাচ-আপ) নিয়ে তো চিন্তা একটু করতেই হয়। কোনোদিন সফল হব, কোনোদিন হব না। সাইডের বাউন্ডারি একটু ছোট ছিল, আমাদের অনেক কিছু চিন্তা করতে হচ্ছিল...। যেহেতু মুস্তাফিজ ও আমার বোলিংয়ের প্যাটার্নটা একইরকম, তাই দুজন এক পাশ থেকে করতে পারাটা কঠিন। আমাদের ওখানেও মানিয়ে নিতে হয়। এমন নয় যে ওরা ছিল বলেই বোলিং করিনি। এমনও পরিস্থিতি ছিল, যখন আমার ৭ম কিংবা ৮ম ওভারে আসার কথা ছিল না। কিন্তু পাশাপাশি বাউন্ডারি বা সবকিছু চিন্তা করার পরে মনে হয়েছে, না আরেকটু পরে আসলে ভালো হয় বা একটি উইকেট পড়লে ভালো হয়। দূর্ভাগ্যবশত হয়নি। আমাদের পরিকল্পনায় খুব একটা ভুল ছিল না, কিন্তু বাস্তবায়নে বেশ কিছু ভুল করেছি। ওই জায়গাগুলোয় উন্নতি করার অনেক সুযোগ আছে।’
এটিই শেষ নয়, ২০৬ রানের লক্ষ্য তাড়ায় বাংলাদেশের ইনিংসের পঞ্চম ওভারের ঘটনা সেটি। নরকিয়ার আগের ওভারেই দুই ওপেনার সৌম্য সরকার ও নাজমুল হোসেন শান্তর বিদায়ে দল তখন চাপে। গতিময় পেসারের পরের ওভারে সাকিব এলবিডব্লিউ হন ১ রান করে। উইকেটের সঙ্গী লিটন দাসের সঙ্গে কথা বলেও শেষ পর্যন্ত রিভিউ নেননি সাকিব। একটু পর টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, বল পিচ করেছিল লেগ সাইডের বাইরে। ডাগআউটে তখন সাকিবের অভিব্যক্তিতেও ফুটে ওঠে রিভিউ না নেওয়ার হতাশা। অধিনায়ক বলেছেন, রিভিউ নিতে চেয়েও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করেন তিনি, ‘রিভিউটার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল, আমি প্রায় নিয়েই নিয়েছিলাম। পরে আবার ওটা বাতিল করে দেই। অবশ্যই একটু তো হতাশাজনক ব্যাপার যে, আমি একবার নিতে গিয়েও কিংবা নিয়ে ফেলেও ওটা বদল করেছি। যখন দেখেছি যে, পিচড আউট সাইড লেগ, তখন অবশ্যই হতাশ ছিলাম।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন