করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে খালি হচ্ছে ক্রেতার পকেট। এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে তুলে নিয়েছে বাড়তি মুনাফা। বিষয়টি বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের নজরে আসার পর চাল, আটা, ডিম, মুরগি, সাবান-শ্যাম্পুসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহকারী ৪৪ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কমিশন মামলা করে গত ২১ সেপ্টেম্বর। এরপর পার হয়ে গেছে এক মাস। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল সেগুলো এই এক মাসে ওইসব পণ্যের দাম কয়েক দফা বাড়িয়েছে লাগামছাড়াভাবে।
সেই লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির খেসারত গুণছেন সাধারণ ভোক্তারা। কারণ মামলা করার পর থেকে গত এক মাসে বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে বাড়ানো হয়েছে ২০-৪০ টাকা, সোনালি মুরগির দাম বাড়ানো হয়েছে কেজিতে ৫০ টাকা, ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে ডজনে ২০ টাকা। আর খাদ্যবহির্ভ‚ত পণ্যের দাম কোনোটির তিনবার, কোনোটির দু’বার বাড়ানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ানো হয়েছে কাপড় কাঁচার সাবান-পাউডার এবং প্যাকেটজাত মসলার দাম।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি কোনো সংস্থা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও সেটাকে পাত্তা দিচ্ছে না। তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, আমরা সাধারণত মনে করি, রাষ্ট্র বা সরকারের চেয়ে বড় কেউ হতে পারে না। অথচ এখন দেখছি আমাদের দেশের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা যেন রাষ্ট্রের চেয়েও অনেক শক্তিশালী। তা না হলে তারা কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে, কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছেন না-এমনটি তো হওয়ার কথা না। তাদের নামে প্রতিযোগিতা কমিশন মামলা করেছে, শুনানিতে ডেকেছে। এরপর তো তাদের নমনীয় হওয়ার কথা। তিনি বলেন, অথচ আমরা দেখছি, তারা পণ্যের দাম বাড়াতে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। আমরা ক্যাবের পক্ষ থেকেও বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছি এবং দেখেছি মামলা করার পর গত এক মাসে অনেক পণ্যের দাম দুই থেকে তিনবার বাড়িয়েছে। এতেই প্রমাণ হয়, ব্যবসায়ীরা সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।
ওই ৪৪ প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা করার পর গত এক মাসে প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়েছে। মুরগি ও ডিমের বাজারদরে নজর দিলেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। গত মাস আগে এক ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। এক মাস আগে সোনালি মুরগির কেজি ছিল ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা, এখন হয়েছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা। এক মাস আগে প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল ১৪০ টাকা, এখন ১৫০ টাকা।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক মাসের ব্যবধানে দেশের বাজারে চিকন চালের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ আর মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। গত ২০ সেপ্টেম্বর বাজারে চিকন চালের কেজি ছিল সর্বনিম্ন ৬২, সর্বোচ্চ ৭০। এখন সেটি হয়েছে সর্বনিম্ন ৬৫, সর্বোচ্চ ৭৫ টাকা। এ ছাড়া মোটা চালের কেজি ছিল সর্বনিম্ন ৪৭, সর্বোচ্চ ৫২ টাকা। এখন বেড়ে হয়েছে সর্বনিম্ন ৪৮, সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা।
একইভাবে গত এক মাসের ব্যবধানে আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৪-৭ শতাংশ পর্যন্ত। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ অক্টোবর বাজারে খোলা আটার কেজি ছিল ৫০-৫৫ টাকা, এখন হয়েছে ৫৫-৫৮ টাকা। প্যাকেটজাত আটার কেজি ছিল ৫৫-৫৮ টাকা, এখন হয়েছে ৫৮-৬০ টাকা। খোলা ময়দার কেজি ছিল ৬০-৬২ টাকা, এখন হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা। প্যাকেটজাত ময়দা এক মাস আগে ছিল ৬৫-৭৫ টাকা, এখন ৭০-৭৫ টাকা।
খাদ্যবহির্ভ‚ত পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া। গত এক মাসে এক কেজি হুইল পাউডারের দাম তিন দফা বাড়িয়ে ১১৫ টাকা থেকে ১৪০ টাকা করা হয়েছে। সার্ফ এক্সেলের দাম ১৫০ থেকে বাড়িয়ে ১৮০ টাকা করা হয়েছে। রিন পাউডারের দাম ১৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রথমে ১৫০ টাকা, এক সপ্তাহ আগে আরেক দফা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮০ টাকা। তিব্বত বল সাবান এক মাস আগে ছিল ১৮ টাকা। প্রথম দফায় বাড়িয়ে করা হয় ২০ টাকা, আরেক দফা বাড়িয়ে এখন করা হয়েছে ২৪ টাকা। গায়ে মাখা বড় লাক্স সাবান এক মাস আগে ছিল ৬৫ টাকা, এখন করা হয়েছে ৭৫ টাকা। লাইফবয় সাবান ছিল ৪৫ টাকা, এখন হয়েছে ৫৫ টাকা। এ ছাড়া মাঝারি আকারের স্যান্ডালিনা ৫৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৫ টাকা এবং ডাভ ব্র্যান্ডের সাবান ৯৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৫ টাকা করা হয়েছে। কাপড় কাঁচা হুইল সাবান ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন ৩০ টাকা করা হয়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক মাসে সব ধরনের টুথপেস্টেরও দাম বাড়ানো হয়েছে দুই থেকে তিন দফা। এক মাস আগে মাঝারি আকারের পেপসোডেন্ট টুথপেস্টের দাম ছিল ৭৫ টাকা। প্রথম দফায় ১০ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৮৫ টাকা, দ্বিতীয় দফায় বাড়িয়ে করা হয় ৯৫ টাকা, সর্বশেষ এক সপ্তাহ আগে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০০ টাকা। একইভাবে ক্লোজআপ ব্র্যান্ডের মাঝারি আকারের টুথপেস্টের দাম তিন দফা বেড়ে ৭৫ টাকা থেকে এখন ১০০ টাকা হয়েছে।
প্যারাসুট ব্র্যান্ডের নারকেল তেলের মিডিয়াম আকারের বোতলের দাম ১০ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা থেকে ১৪৫ টাকা করা হয়েছে। লাইফবয় হ্যান্ডওয়াশের (১৭০ মি.লি) দাম দুই দফা বাড়িয়ে ১৭০ টাকা থেকে এখন ১৮৫ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউনিলিভারের মিডিয়াম আকারের ডাভ শ্যাম্পুর দাম ছিল ২০০ টাকা, এখন হয়েছে ২৩০ টাকা। চার প্যাকেটের ম্যাগি নুডলসের দাম ছিল ৭৫ টাকা, এখন হয়েছে ৮৫ টাকা।
প্যাকেটজাত মসলা পণ্যের দামও গত এক মাসে কয়েক দফা বাড়িয়েছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। রাঁধুনি ব্র্যান্ডের ১০০ গ্রাম ওজনের মরিচের গুঁড়ার দাম ছিল ৫৩ টাকা, এখন হয়েছে ৬৩ টাকা। রাঁধুনি ব্র্যান্ডের এক লিটার সরিষা তেলের দাম ছিল ৩২০ টাকা, এখন হয়েছে ৩৮০ টাকা। শুধু তাই নয়, ১৫০ গ্রাম ওজনের রুচি ব্র্যান্ডের চানাচুরের দাম ছিল ৪৫ টাকা, এখন হয়েছে ৫০ টাকা, আর ৩৫০ গ্রাম ওজনের চানাচুরের দাম ছিল ৮০ টাকা, এখন হয়েছে ৯০ টাকা।
এই এক মাসে সব ধরনের প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধেরও দাম বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিক। ল্যাকটোজেন-১-এর দাম ছিল ৫০০ টাকা, এখন হয়েছে ৫২০ টাকা, আধা কেজি ডানো গুঁড়া দুধের দাম ছিল ৩৪০ টাকা, এখন হয়েছে ৩৭৫ টাকা। আধা কেজি ডিপ্লোমা গুঁড়া দুধের দাম ছিল ৪০০ টাকা, এখন ৪২৫ টাকা এবং আধা কেজি মার্কস গুঁড়া দুধের দাম এক মাস আগে ছিল ৩৭৫ টাকা, এখন ৪০০ টাকা। এভাবে বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম গত এক মাসে দুই-তিন দফা বাড়ানো হয়েছে।
মামলার পরও পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণেই পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। দাম না বাড়িয়ে কোনো উপায় নেই।
এদিকে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দোকানদাররাও বিপাকে পড়েছেন। দাম বেড়ে যাওয়ায় একদিকে তাদের বিনিয়োগ বেশি লাগছে, অন্যদিকে প্রতিদিনই ক্রেতার সঙ্গে তাদের বাকবিতন্ডা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তারা জানান, সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছি আমরা। আগে এক লাখ টাকায় যে পণ্য কিনতাম এখন সেটি কিনতে হচ্ছে দেড় লাখ টাকায়। অন্যদিকে লাভের পরিমাণও কমে গেছে। কারণ দাম বেশি হওয়ায় কোম্পানিগুলো কমিশন কমিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন কাস্টমারের সঙ্গে ঝগড়া করতে হচ্ছে আমাদের। কারণ দাম বৃদ্ধির জন্য যত ক্ষোভ আমাদের ওপর ঝাড়ছেন ক্রেতারা। কোম্পানির লোকদের তো আর পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন