অতিরিক্ত মুনাফার জন্য খাদ্যে ভেজাল ও মানহীন খাদ্য সামগ্রি উৎপাদন ও বিপণন বেড়ে চলেছে। খাদ্যে ভেজাল নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভোক্তা অধিকার সংস্থা, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমে জোরালো প্রতিক্রিয়া হলেও ভেজাল বন্ধ করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিবেদনে খাদ্যে বিষক্রিয়ায় ২০১৩ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ সংসদের অধিবেষন চলাকালে গুরুত্বর অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তির তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময় ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি উঠলে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ পাস করা হয়। আশা করা হয়েছিল, আইন কঠোর হলে খাদ্যে ভেজাল দেয়া বা মানহীন ও অননুমোদিত খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন কমে আসবে। আদতে তা হয়নি। গত এক দশকে খাদ্যে ভেজালের হার কমেনি বরং ভিন্ন আঙ্গিকে আগের চেয়ে বেড়েছে। সেই সাথে ভেজাল বিরোধী অভিযানও আগের চেয়ে কমেছে। আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা এবং খাদ্য উৎপাদনকারি কারখানাগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের মান সুষ্ঠু তদারকি না থাকায় খাদ্যপণ্য উৎপাদক ও বিক্রেতারা জনস্বাস্থ্য ও আইনগত শাস্তির কোনো তোয়াক্কা করছেনা।
গতমাসে রাজধানীর টঙ্গিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এক ভেজাল বিরোধী অভিযানে স্থানীয় বাজারে জনপ্রিয় কয়েকটি ফ্রুট ড্রিঙ্কস উৎপাদনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অনুমোদনহীনতা, মানহীনতা এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি থাকায় একটি কারখানাকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমান আদালত। ফ্রুটড্রিঙ্কসের নামে ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশ্রিত এসব পানীয় মূলত শিশুখাদ্য হিসেবেই বিক্রি হয়ে থাকে। না জেনে না বুঝে শিশুরা এসব ড্রিঙ্ক পান করে নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হচ্ছে। মাছ-মাংস, ফল, সব্জি, চাল-ডাল, তেল, আটা-ময়দা, পাউডার দুধ, কেক-পেস্ট্রি, আইসক্রিম, মিষ্টান্ন, দধি থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্তোরা ও বাজারে বিক্রি হওয়া এমন কোনো পণ্য নেই, যা ভেজাল ও নকলের শিকার হচ্ছে না। দেশের কোটি কোটি মানুষ নতুন নতুন স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হওয়ার মূল কারণই হচ্ছে ভেজাল ও রাসায়নিক মিশ্রিত মানহীন খাদ্য। উপরন্তু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে অসুস্থ্য হয়ে ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে যাওয়া সাধারণ মানুষ নকল, মানহীন ওষুধের কারণে আরো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ভেজাল, নকল, মানহীন ও অননুমোদিত ও ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যপণ্যের ব্যবসা দেশে একটি সামাজিক মহামারি আকার ধারণ করেছে, যা দেশের কোটি কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ঠেলে দিয়েছে। ফর্মালিন, কার্বাইড, ডিডিটিসহ ক্ষতিকর ক্যামিকেল ও রং মিশ্রিত খাদ্যপণ্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
এক সময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকা ক্ষমতাধর ব্যক্তিটিও যখন খাদ্যের বিষক্রিয়ার শিকার হয়ে চরম পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তখন সাধারণ দরিদ্র মানুষের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি ভেজাল-নকলের মাত্রা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রেও অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। স্বল্প আয়ের দরিদ্র মানুষ অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে ভেজাল-নকল পণ্য কিনে প্রকারান্তরে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভেজাল বিরোধী অভিযানকে সফল করতে হলে দেশের সব বাজারে, খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিটি কারখানায় পণ্যের মান নিশ্চিতে নিয়মিত তদারকি ও অভিযান অব্যাহত রাখা জরুরি হলেও বিদ্যমান ব্যবস্থায় মাঝেমধ্যে নাম কা ওয়াস্তে অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়। লাখ লাখ শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টিকারী কারখানার মালিককে দু-চার লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে ছেড়ে দেয়ার পর তারা পুনরায় একই ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা বানাচ্ছে। ভেজাল বিরোধী অভিযানের ম্যাজিস্ট্রেটরা ফুটপাথের ব্যবসায়ী, দোকানদার ও ছোট হোটেল-রেস্তোরাকে ১০-২০ হাজার টাকা জরিমানা করেই দায় সারছেন। এতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানির বিভিন্ন পণ্যের ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর, অননুমোদিত, ক্ষতিকর উপাদান ও রাসায়নিক মিশ্রিত পণ্যের তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝে মধ্যে ফাঁস হলেও ওসব কর্পোরেট কোম্পানির পণ্যের মানহীনতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ভেজাল ও মানহীন খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করতে প্রতিটি বাজারে নজরদারি, নিরাপদ খাদ্য আইনের কঠোর প্রয়োগ বাড়াতে হবে। দোষি কোম্পানির বিরুদ্ধে মোটা অংকের জরিমানা ছাড়াও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অনৈতিক পন্থায় অধিক মুনাফা করার মাইন্ডসেট বা সাধারণ মানসিক প্রবণতা দূর করতে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন