শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

এলডিসি উত্তরণের বাংলাদেশের প্রস্তুতি জানতে চায় আইএমএফ

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে সুপারিশ নেই তবে অর্থায়ন নিয়ে উদ্বেগ হ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর সংস্থাটির নির্দিষ্ট সময়ে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন হবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চেয়েছে আন্তজার্তিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চলমান সঙ্কট দূরীকরণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে সংস্থাটি। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকির কমানোর ব্যাপারে কোন সুপারিশ বা পরামর্শ দেয়নি আইএমএফ। তবে এ খাতের অর্থায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারাবিশ্বে মন্দার আশঙ্কার কথা জানিয়ে সংস্থাটি জানতে চায়-বিশ্ব মন্দা মোকাবেলা করে কিভাবে বাংলাদেশ রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখবে? পণ্য রফতানিতে সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ট্যারিফ-নন ট্যারিফ বিষয়ে নতুন যে পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে তা কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে আইএমএফের জিজ্ঞাসা ছিল। গতকাল সচিবালয়ে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে পৃথক তিনটি বৈঠকে এসব বিষয়ে জানতে চায়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ইতোমধ্যে আইএমএফের পরামর্শ মেনে ভর্তুকি কমানো হয়েছে। কয়েকদফা ডিজেল ও অন্যান্য জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুতের দামও বাড়িয়েছে সরকার। এ অবস্থায় নতুন করে আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে কোন সুপারিশ দেয়নি সংস্থাটি। বরং বর্তমান বাস্তবতায় ডিজেল, এলএনজি ও গ্যাসের দাম বাড়ায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়েছে আইএমএফ। বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান জানান, এ খাতে ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে আইএমএফ কোন পরামর্শ বা সুপারিশ দেয়নি। তবে সংস্থাটি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। দেশে এখাতে বিনিয়োগ কেমন হচ্ছে, অগ্রগতি কেমন এবং আগামীতে কি ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো হচ্ছে সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তাদের বিস্তারিত জানানো হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হচ্ছে সৌরশক্তি, ভূ-তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, সমুদ্রঢেউ, সমুদ্রতাপ, জোয়ার-ভাটা, বায়োগ্যাস, বায়োফুয়েল, আবর্জনা ইত্যাদি। এসব উৎস কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের অনেক কর্মসূচী রয়েছে। তিনি জানান, বৈঠকে মনে হয়েছে, আইএমএফ বাংলাদেশের কার্যক্রম ও অগ্রগতিতে খুশি। আশা করছি, ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তা ফলপ্রসূ হবে। ঋণ পাবে বাংলাদেশ।

এদিকে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বৈঠক শেষে জানান, আইএমএফ ভর্তুতির অর্থায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে এ খাতের ভর্তুকি বেসরকারি খাতের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেটানো যায় কি না সেই প্রশ্ন ছিল আইএমএফের। এ বিষয়ে বিপিডিবি জানায়, বেসরকারি খাতের ব্যাংক ঋণের সুদ অনেক বেশি। এ কারণে ব্যাংক ঋণ না করে সরাসরি বাজেট থেকে ভর্তুকির অর্থায়ন হয়ে থাকে। ক্যাপাসিটি চার্জ ২০৩০ সালের মধ্যে পরিশোধের বিষয়ে আইএমএফকে জানানো হয়, ওই সময়ের মধ্যে পরিশোধে ব্যর্থ হলে এটা পরবর্তী সময়েও চালিয়ে যাওয়া হবে। তথ্যমতে, বেসরকারি খাত থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করার জন্য পিডিবিকে ঋণ দেয় সরকার। এ ঋণও ভর্তুকি। কারণ, সরকার তা ফেরত পায় না। আইএমএফের প্রতিনিধিদল এ ব্যাপারে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রেখেছে সরকার। ভর্তুকির বেশির ভাগই জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের জন্য রাখা। ভর্তুকিকে ‘ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা’ বলে থাকে আইএমএফ। ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় নগদ ঋণ নামে ঋণ দেয়া হয়ে থাকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবির মতো সংস্থাকে। কিন্তু বিপিসি ও পিডিবি সরকারকে তা ফেরত দেয় না। সারে ভর্তুকি কমানো হবে না বলে ইতোমধ্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় তিনি এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। একইসঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি কমাতে চায় না সরকার। অন্যদিকে আইএমএফের ঋণ পেতে সংস্থাটি এই সফরের আগেই বেশকিছু শর্ত আরোপ করেছে। যার মধ্যে ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে সকাল ৯ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত ঘন্টাব্যাপী বৈঠক করেন আইএমএফ প্রতিনিধিদল। ওই সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য উর্ধতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে প্রতিনিধিদলটি যায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে। সেখানেও ঘন্টাব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে বিপিডিবি’র সঙ্গে তৃতীয় বৈঠক করেন আইএমএফের কর্মকর্তারা। তিনটি বৈঠক করা হলেও আইএমএফ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে মিডিয়াকে কোন বিবৃতি বা বক্তব্য দেয়া হয়নি। এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি।

জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফের বেশি আগ্রহ ছিল এলডিসি উত্তরণ, রফতানি প্রবৃদ্ধি, ট্যারিফ-নন ট্যারিফ বাধা, মুক্ত বাণিজ্য ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে। এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে নিশ্চিত করেছেন, আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এলক্ষ্যে সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট। বিশেষ করে রফতানি বাড়াতে বাজার বহুমুখীকরণ এবং পণ্য বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আঞ্চলিক বাণিজ্যে জোর বিশেষ করে এফটিএ এবং পিটিএ করা হচ্ছে। এছাড়া ভারতের সঙ্গে সিপা এবং চীনের সঙ্গে আরসিইপি চুক্তি করার বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বাণিজ্য সচিব জানান, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে নতুন ট্যারিফ পলিসি কার্যকর করবে সরকার। আমদানি-রফতানিতে শুল্ক আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার কৌশল নেয়া হয়েছে। এছাড়া ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে রফতানিতে ট্যারিফ-নন ট্যারিফ জনিত যে সমস্যা রয়েছে তা দূর করা হবে।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পোন্নত দেশ-এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের নাম সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি-সিডিপি। এর ফলে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ। কিন্তু এই উত্তরণের সুবাদে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে মর্যাদা বাড়লেও বাংলাদেশকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। কারণ, এলডিসি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পাওয়া কিছু সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। ফলে রপ্তানি নিয়ে শঙ্কা দেখার আশঙ্কা রয়েছে। ওষুধ উৎপাদনের খরচ বাড়বে। আরও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ইতোমধ্যে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। বর্তমানে রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। তবে আগামীতে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণের ওপর জোর দিয়ে সফটওয়্যার, তথ্য প্রযুক্তি, প্লাস্টিক ওচামড়াসহ বিভিন্ন শিল্পকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়-চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খাতভিত্তিক সাব-কমিটি গঠন করে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আরেকটি কমিটি রয়েছে যারা এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি সার্বক্ষণিক পর্যালোচনা করছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও তৎপর রয়েছে। এ ছাড়া শুল্ক কাঠামোর সংস্কার চলমান রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিওর আওতায় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউর মতো আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে (যেমন ভারত, চীন) যেসব শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাচ্ছে সেগুলো ২০২৬ সালের পর বন্ধ হয়ে যাবে। তবে ইইউতে জিএসপির আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা আরও তিন বছর থাকবে। তখন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। ডব্লিউটিওর সম্প্রতি প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী নতুন মর্যাদা পাওয়ার পর বাড়তি শুল্কের কারণে বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো কমতে পারে।

উল্লেখ্য, আইএমএফের এশিয়া ও প্রশাস্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতর-অধিদফতরের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছে। আইএমএফের কাছে ৪৫০ কাটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। ডিসেম্বরের মধ্যে ১৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী সরকার, তবে ঋণ পেতে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। তাদের কর্মসূচির আওতায় ৬৮০ কোটি ডলার পর্যন্ত ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। সম্ভাব্য ৯টি কিস্তিতে তারা তিন বছর ধরে ঋণ দিতে পারে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ হতে পারে ২০ বছরের মতো এবং এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর গ্রেস পিরিয়ড থাকবে। আগামী ৯ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠক করে ঋণ প্রাপ্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিবে আইএমএফ। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন