টি-টোয়েন্টিতেও বিশ্বসেরা ইংল্যান্ড। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানকে হারিয়ে এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপাও জিতে নিলো ইংলিশরা। গতকাল অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহাসিক মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের (এমসিজি) ফাইনালে পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষুদ্র সংস্করণের শিরোপা ঘরে তুলল জস বাটলারের দল। টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তান নির্ধারিত ২০ ওভারে ৮ উইকেটে করে ১৩৭ রান। জবাবে জয়ের জন্য ১৩৮ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে অলরাউন্ডার বেন স্টোকসের হার না মানা হাফসেঞ্চুরিতে ৬ বল হাতে রেখেই সহজে ম্যাচ জিতে নেয় ইংল্যান্ড। এই জয়ে ২০১০ সালের পর দ্বিতীয়বার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি ঘরে তুলল জশ বাটলার বাহিনী। অন্যদিকে ম্যাচ হেরে তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠে দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হলেন বাবর আজমরা। এর আগে ২০০৭ সালে টুর্নামেন্টের প্রথম আসরের ফাইনালে খেলে ব্যর্থ হলেও ২০০৯ সালে দ্বিতীয় আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাকিস্তান।
২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতার পর নিজেদের শোকেসে সংক্ষিপ্ত ভার্সনের ট্রফিটাও সাজাতে মরিয়া ছিল ইংলিশরা। লক্ষ্যপূরণে নিজেদের সেরাটা দিয়েই শতভাগ সাফল্য তুলে নিয়েছেন বাটলাররা। অন্যদিকে ১৯৯২ ওয়ানডে বিশ্বকাপকে স্মৃতিতে রেখেই এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছিল পাকিস্তান। আজ থেকে ৩০ বছর আগে ওয়ানডে বিশ্বকাপে অনেকটা খোড়াতে খোড়াতেই ফাইনালে উঠে বাজিমাত করেছিল ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান। এই মেলবোর্নেই ৯২’ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইমরান বাহিনী। ওই আসরের চিত্রও ছিল অনেকটা এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতোই। বর্তমান অধিনায়ক বাবরের সামনে ছিল ইমরানকে স্পর্শ করার হাতছানি। কিন্তু ইমরান হতে পারলেন না বাবর। যথারীতি হার দিয়েই শেষ করলেন বিশ্বকাপ মিশন। যে হারে শিরোপা বঞ্চিত হলেন তারা।
৮০ হাজার ৪৬২ দর্শকের উপস্থিতিতে কাল মেলবোর্নের ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে প্রথম তিন ওভারে বল বাউন্ডারির বাইরে পাঠাতে পারেননি পাকিস্তানের দুই ওপেনার মোহাম্মদ রিজওয়ান ও অধিনায়ক বাবর আজম। ইনিংসের চতুর্থ ওভারের প্রথম বলে ছক্কা হাঁকান রিজওয়ান। পঞ্চম ওভারের দ্বিতীয় বলে দলীয় ২৯ রানে রিজওয়ানকে বোল্ড করেন ইংল্যান্ডের বাঁ হাতি পেসার স্যাম কারান। ১৪ বলে ১৫ রান করেন রিজওয়ান।
রিজওয়ানকে হারিয়ে পাওয়ার প্লে’তে ৩৯ রান করে পাকিস্তান। এসময় ২টি চার ও ১ ছয় মারতে পারেন পাকিস্তানি ব্যাটাররা। অষ্টম ওভারে প্রথমবারের মত আক্রমণে এসেই উইকেট তুলে নেন ইংলিশ স্পিনার আদিল রশিদ। ১২ বলে এ চারের মারে ৮ রান করা মোহাম্মদ হারিসকে ফিরিয়ে দলীয় ৪৫ রানে পাকিস্তানের দ্বিতীয় উইকেটের পতন ঘটান রশিদ। তৃতীয় উইকেটে জুটি বেঁধে পাকিস্তানের রানের গতি বাড়ান অধিনায়ক বাবর আজম ও চার নম্বরে নামা শান মাসুদ। ইনিংসের ১২তম ওভারের প্রথম বলে পাকিস্তানকে ফের বড় ধাক্কা দেন রশিদ। তার গুগলি বুঝতেও না পেরে বোলারকে ফিরতি ক্যাচ দেন বাবর। দলীয় ৮৪ রানে ফেরার আগে ২ চারের মারে ২৮ বলে ৩২ রান করেন পাক অধিনায়ক। তৃতীয় উইকেটে মাসুদ-বাবর দলীয় সংগ্রহে ২৪ বলে ৩৯ রান যোগ করেন। বাবর ফেরার পরের ওভারে শূন্য রানে ইফতেখার আহমেদকে ফেরান বেন স্টোকস। ইফতেখার আউট হলে ক্রিজে মাসুদের সঙ্গী হন শাদাব খান। এই জুটি ১৫ ওভারে দলের রান ১০০’তে পৌঁছান। ১৬তম ওভারে ১৩ রান তুলেন মাসুদ-শাদাব। ইনিংসের ১৭তম ওভারে এই জুটি ভাঙ্গেন কারান। দলীয় ১২১ রানে পাকিস্তানের পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে আউট হন শান মাসুদ। কারানের বলে আউট হওয়ার আগে ২ চার ও ১ ছক্কায় ২৮ বলে ৩৮ রান করেন তিনি।
মাসুদকে শিকারের পর ডেথ ওভারে পাকিস্তানের ব্যাটারদের মারমুখী হতে দেননি ইংল্যান্ডের দুই পেসার ক্রিস জর্ডান ও স্যাম কারান। ১৭ থেকে ২০- শেষ চার ওভারে ১৮ রান তুলতেই ৪ উইকেট হারায় পাকিস্তান। ১৭.২ ওভারে দলীয় ১২৩ রানে আউট হন শাদাব খান। জর্ডানের বলে আউট হওয়ার আগে শাদাব ১৪ বলে ২ চারে ২০ রান করেন তিনি। বাকিদের রান ছিল এক অঙ্কের ঘরে। ফলে নির্ধারিত ওভার শেষে মামুলি সংগ্রহ পায় পাকিস্তান। চার ওভারে ১২ রান দিয়ে ৩ উইকেট শিকার করে ইংল্যান্ডের সফল বোলার স্যাম কারান। আদিল রশিদ ২২ রানে ও জর্ডান ২৭ রানে পান ২টি করে উইকেট। ৩২ রানে ১ উইকেট শিকার করেন স্টোকস। ফিল্ডিংয়ে লিয়াম লিভিংস্টোন একাই ধরেন তিন ক্যাচ।
জয়ের জন্য ১৩৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালো করেনি ইংল্যান্ডও। সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে উদ্বোধনী জুটিতে বিনা উইকেটে ১৭০ রান করেছিলেন ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার অ্যালেক্স হেলস ও অধিনায়ক জশ বাটলার। কিন্তু ফাইনালে দলীয় ৭ রানে বিচ্ছিন্ন হন তারা। প্রথম ওভারের শেষ বলে হেলসকে বোল্ড করেন পেসার শাহিন শাহ আফ্রিদি। সেমিতে অপরাজিত ৮৬ রান করে ম্যাচ সেরা হওয়া হেলস এ ম্যাচে করেন মাত্র ১ রান। প্রথম ওভারে দলীয় মাত্র ৭ রানে হেলস ফিরলেও মারমুখী মেজাজে ছিলেন বাটলার। তবে চতুর্থ ওভারেই দ্বিতীয় ধাক্কা খায় ইংল্যান্ড। তিন নম্বরে নেমে ৯ বলে ঝড়ো গতিতে ২০ রান করা সল্টকে বিদায় করেন পেসার হারিস রউফ। পাওয়ার প্লে’র শেষ ওভারে ইংল্যান্ড শিবিরে দ্বিতীয় আঘাত হানেন রউফ। বাটলারকে থামিয়ে পাকিস্তানকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যান তিনি। ভারতের বিপক্ষে অনবদ্য ৮০ রান করা বাটলার এবার ১৭ বলে ২৬ রানে আউট হন। ৫.৩ ওভারে দলীয় ৪৫ রানে আউট হওয়ার আগে ৩ চার ও ১টি ছক্কা হাঁকান তিনি।
৫০ রানের আগেই তিন ব্যাটারকে হারিয়ে চাপে পড়ে ইংলিশরা। তবে চতুর্থ উইকেটে সাবধানে খেলে দলকে চাপমুক্ত রাখার চেষ্টার করেন বেন স্টোকস ও হ্যারি ব্রুক। দলীয় সংগ্রহে ৪২ বলে ৩৯ রান যোগ করেন তারা। কিন্তু ১২.৩ ওভারে দলীয় ৮৪ রানে ২৩ বলে ২০ রান করা ব্রুককে আউট করে জুটি ভাঙেন স্পিনার শাদাব খান। এ সময় জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৪৫ বলে ৫৪ রান। শেষ ৫ ওভারে জয়ের জন্য ৪১ রান দরকার পড়ে ইংলিশদের। ১৬তম ওভারের প্রথম ডেলিভারির পর পায়ের ব্যথায় মাঠ ছাড়েন আফ্রিদি। তার ওভার শেষ করতে বোলিংয়ে আসেন ইফতেখার। ইফতেখারের শেষ পাঁচ বলে ১৩ রান নেন স্টোকস ও মঈন আলি। ১৬তম ওভার শেষে স্টোকসের রান গিয়ে দাঁড়ায় ৩৮ বলে ৩৯। ১৭তম ওভারে মঈনের ৩ চারে ১৬ রান পায় ইংল্যান্ড। এতেই ম্যাচের লাগাম হাতে নেয় তারা। ১৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ১২ বলে ১৯ রান করে মঈন ফিরলেও লিভিংস্টোনকে নিয়ে ৬ বল হাতে রেখেই ইংল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করেন স্টোকস। ৪৩ ম্যাচের ক্যারিয়ারের প্রথম হাফসেঞ্চুরির স্বাদ পাওয়া স্টোকস শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ৪৯ বলে ৫২ রানে। তার ইনিংসে ছিল ১ ছক্কা ও ৫ বাউন্ডারির মার। ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে কখনো মারমুখি হয়ে, কখনো ডিফেন্স করে খেলাকে ধরে রাখা এবং দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে স্টোকসের জুড়ি মেলা ভার। তার এই ক্যালকুলেটিভ ব্যাটিংই ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর এবার টি-টোয়েন্টিতেও বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট পড়লো ইংলিশরা। লিভিংস্টোন অপরাজিত থাকেন ১ রানে। পাকিস্তানের হারিস রউফ চার ওভারে ২৩ রানে ২ উইকেট নেন। মাত্র ১২ রানে ৩ উইকেট শিকার করে ম্যাচ সেরার পাশাপাশি মোট ১৩ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরাও ইংল্যান্ডের স্যাম কারান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন