মো. ওয়াহিদ হোসেন ইংল্যান্ডের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির অনুমোদন পত্র (ক্যাচ লেটার) হাতে এসেছে। এখন ভর্তির পালা। ভর্তির পর ভিসার জন্য দূতাবাসে আবেদন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে তাকে এক মাস আগে ব্যাংকে ৩০ লাখ টাকা জমা রয়েছে প্রত্যায়ণপত্র দেখাতে হবে। একই সঙ্গে তাকে নিজের যাবতীয় কাজপত্রসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি পাঠানো সংক্রান্ত ফাইল দিয়ে একাউন্ট খুলতে হবে। বাংলাদেশের বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে। টাকা উত্তোলন করা যাবে না এমন শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রত্যায়ণপত্র এবং ব্যাংকের মাধ্যমে ‘সুইফ’ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি ডলার পাঠানো হয়। কিন্তু ডলার সঙ্কটের কারণে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ব্যাংকে ফাইল খুলতে পারছেন না বলে জানা গেছে। ওয়াহিদ হোসেনের মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বিপাকে পড়ে গেছেন। আগামী জানুয়ারি সেশনের জন্য যারা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মানিসহ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তাদের অনেকেই ব্যাংকে ফাইল খুলতে পারছেন না বলে জানা গেছে। এতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার আকাক্সক্ষা। বিগত তিন মাস থেকে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ডলার পাঠাতে না পারায় অনেকেরই ভর্তি বাতিল হয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, সার্বিকভাবে ডলার সঙ্কটের কারণে সবাই আসলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার মধ্যে উচ্চশিক্ষায় বিদেশে যেতে বাধা একটা অন্যতম বিষয়। আধুনিক ও উন্নতমানের শিক্ষার জন্য অনেক শিক্ষার্থীকেই বাইরে যেতে হয়। এর প্রয়োজন আছে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াশোনার সুব্যবস্থা করাও আমাদের দায়িত্ব। এখন উদ্ভূত ডলার সঙ্কটের পরিস্থিতিতে এসব শিক্ষার্থীরা নিঃসন্দেহে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময় যে শিক্ষার্থীরা বাইরের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পেয়েছে তারা এখন ডলার সঙ্কটের কারণে বিদেশে যেতে পারছে না। তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সার্বিকভাবে ডলার সঙ্কট হলেও শিক্ষাখাতে একটু ছাড় দেয়ার বা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
সুত্র জানায়, বেসরকারি প্রথম সারির কয়েকটি ব্যাংক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের ফাইল খোলে। এক্ষেত্রে অগ্রগামী ব্যাংকগুলো হলো প্রিমিয়ার, ইস্টার্ন, ব্র্যাক, দ্য সিটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট (এমটিবি), ব্যাংক এশিয়া, প্রাইম উল্লেখযোগ্য। তবে ডলার সঙ্কটের কারণে সম্প্রতি প্রায় সব ব্যাংকই এসব ফাইল খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে বিদেশে উচ্চশিক্ষার নিতে যাওয়ার সুযোগ।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যে শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছেন তার একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। সংস্থাটির ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার (৪৯ হাজার ১৫১ জন) শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। ২০২১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮ হাজার ৬৬৫, মালয়েশিয়ায় ৭ হাজার ৫৪৮, অস্ট্রেলিয়ায় ৫ হাজার ৬৪৭, কানাডায় ৫ হাজার ১৩৬, জার্মানিতে ৩ হাজার ৯৩০, যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৯৪, ভারতে ২ হাজার ৭৫০, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ১৭৬ ও সউদী আরবে ১ হাজার ১৬৮ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েছেন। এ ছাড়াও জাপান, চীন ও ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা নিতে যান।
এদিকে উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্যে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রতিবছর বেড়ে যাচ্ছে। সারাবিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছনে পড়ে থাকায় শিক্ষার্থীদের ভালোমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগ্রহ বাড়ছে। চলতি বছরে করা সারাবিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ের তালিকায় দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এক হাজারের মধ্যে রয়েছে। আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও খুলনা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টেকনোলজী (কুয়েট) ১৫শ তালিকার মধ্যে রয়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিম্ন এবং দেশে চাকরির বাজার মন্দার কারণে ছাত্রছাত্রীরা বিদেশমুখি হচ্ছেন। দায়িত্বশীলরা জানান, উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়া অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও এটা উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই সেপ্টেম্বর) উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানো ডলারের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তা ১৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য দেশ থেকে ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাঠানো হয়। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে পাঠানো হয় ২৪ কোটি ৩১ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৩২ কোটি ১০ লাখ ডলার পাঠানো হয়েছে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা বাবদ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
কাডানা, অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ভর্তির সুযোগ পাওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, স্টুডেন্ট ফাইল খোলার জন্য ইস্টার্ন, ব্র্যাক, ব্যাংক এশিয়া ও প্রাইম ব্যাংকে তারা যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু কেউই রাজি হয়নি। এ অবস্থায় বিকল্প হিসেবে তাদের অনেকে হুণ্ডির পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে যারা ব্যাংকের ঋণের উপর নির্ভরশীল তারা ভর্তির সুযোগ পেলে বিদেশে যেতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের জন্য গত বছর প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ফাইল খুলেছিল। এ বছর জানুয়ারী ও সেপ্টেম্বর সেশনে ৪ হাজার ফাইল খুলেছে। অন্য একটি ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারী, মে ও সেপ্টেম্বর মাসের জন্য চার হাজার ফাইল খুলেছেন। এর মধ্যে অর্ধেক বিদেশগামী শিক্ষার্থীর জন্য ঋণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তবে এখন ডলার সঙ্কটের কারণে নতুন ফাইল খোলা বন্ধ রেখেছেন।
বিদেশে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি বিদেশ যেতে শিক্ষার্থীদের ফাইল খোলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে তাহলে তা ভালোই করেছে। কারণ এই শিক্ষার্থীদের কেউই বাইরে গিয়ে আর দেশে ফিরে না। দেশের ডলার নষ্ট হয় এভাবে। স্কলারশিপে বিদেশ যেতে কোনো অসুবিধা নেই কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে, যখন সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক দিক থেকে হিমসিম খাচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে যখন বিধ্বস্ত সারা বিশ্ব, যখন আমাদের দেশের ভবিষ্যতই অন্ধকারে তখন ডলার খরচ করে বিদেশ যাওয়ার কোনো মানে হয় না। দেশেই উচ্চশিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার এই অবস্থার জন্য তিনি দায়ী করেন দেশের এলিট শ্রেণীকে, যারা দেশের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার কিন্তু নিজেদের সন্তানদের পড়াশোনা করার জন্য ডলার খরচ করে বিদেশ পাঠায়। এই ব্যাবস্থাটাই বন্ধ করে দেয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. সেলিম রায়হান বলেন, আসলে এটা শুধু শিক্ষার ব্যাপার নয়। চিকিৎসার জন্যও তো বাইরে যেতে হয়, যেখানে ডলারের প্রয়োজন পড়ে। এখন অনেক ব্যাংকই ডলার দিচ্ছে না। ফলে এরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এবং যতদিন না ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক হবে ততদিন পর্যন্তই এর প্রভাব পড়বে। এবং এটা যদি দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে তাহলে দেখা যাবে এই বিষয়গুলো (উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমন) সঙ্কুচিত হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন