বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেলাধুলা

তাকে ছাড়া প্রথম বিশ্বকাপ ‘মিস ইউ ম্যারাডোনা’

ইমরান মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২০ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ফুটবলের রেণু বোনা তা একজন পেলে কিংবা ম্যারাডোনারই জাদুকরি ফসল। সাত-সমুদ্দুর তের নীর ওপারে বসে লাল-সবুজের হাডুডুপিয় ভেতো বাঙালির রক্তে ৯০ মিনিটের গোলক রোমাঞ্চ দিতে পারা তো কোনো জাদুকরের দ্বারাই সম্ভব! সেই কাজটিই করেছিলেন এই দুই কিংবদন্তি। একজন, এই বাসা এই হাসপাতালের চৌহদ্দিতে বন্দী, আরেকজন সব মায়া ত্যাগ দিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তা-ও প্রায় এক বছর হতে চলল। আসছে ২৫ নভেম্বর তার না থাকার দুই বছর। গত বছরটি কোনো মতে কেটেকুটে গেলেও এই বছরটি যে তাকে মনে পড়ছে খুব করে! এটি যে তার বছর, ফুটবল বিশ্বকাপের বছর। আজ থেকে কাতারে শুরু হচ্ছে ফুটবল রোমাঞ্চের সবচাইতে বড় আসর ফিফা বিশ্বকাপ। তবে যার জন্য এই বাংলাদেশে উড়ছে আকাশী-নীল পতাকা, সেই তিনিই যে নেই। মিস ইউ ম্যারাডোনা।
মাঠে জমজমাট খেলা, উন্মাদ দর্শক আর সাবেকদের বিশ্লেষণ-ভবিষ্যদ্বাণী- এসব মিলিয়ে পৃথিবীর অসুখবিসুখ যা-ই হোক না কেন, বিশ্বকাপের আমেজ ঠিকই উপচে পড়েছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু এবারের বাতাসটা একটু আলাদা। উৎসবের আবির-মাখা সে বাতাসেও কাকে যেন হারানোর বিউগল বাজছে। আর কাতার বিশ্বকাপ তার মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ছে। খিড়কি খুলে সবাই মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম বিশ্বকাপকে বরণও করে নিচ্ছেন। শুধু একটি দরজা বন্ধ। তা আর কখনোই খুলবে না। সে এমন এক দরজা- যার চৌকাঠে ফুটবলের ভক্ত থেকে বিপ্লবী, এমনকি দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ মানুষটিও হয়তো পড়ে থাকতে চাইবেন। আর তিনি হয়তো দরজা খুলে সেই পোড়ামুখোকে বুকে টেনে হাতে বলটা দিয়ে বলবেন, এই নাও ওষুধ! পৃথিবীর সমস্ত জরা-ব্যাধি, দুঃখ-শোক আর পাপ-তাপ ভোলার ওষুধ! এই দৃশ্যপট আসলে কল্পনার।
কিন্তু কল্পনায় তাঁকে নিয়ে এই ছবিটা আঁকার সাহস তিনি নিজেই দিয়েছেন। ফুটবল নিয়ে যাঁর আবেগের উচ্চতা এভারেস্টকেও পেছনে ফেলবে, যাঁর চোখে বলে লাথি মারাটাই জন্ম নেওয়ার সার্থকতা আর পৃথিবীর আপামর দুঃখী জনতার পাশে দাঁড়িয়ে যিনি অহর্নিশ ‘এস্টাবলিশমেন্ট’কে প্রশ্ন করে গেছেন, খুঁচিয়েছেন- সেই দরজায় যে আজ মৃত্যুর তালা! ২০২০ সালে বুয়েনোস আইরেসের হাসপাতালের আইসোলেশনে থেকে ৬০তম জন্মদিন পালন করেন ‘এল দিয়াগো’। তবে কে জানত, তার এক মাসের মধ্যেই না-ফেরার দেশে পাড়ি জমাবেন বিশ্বকাপজয়ী এ কিংবদন্তি। ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর মাত্র ৬০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ম্যারাডোনা।
অথচ, বিশ্বকাপ ফুটবল কিংবা আর্জেন্টিনার খেলা মানেই গ্যালারিতে ম্যারাডোনার সরব উপস্থিতি। এটা নিয়মিত দৃশ্য। মাঠে যে যতই প্রেরণা দিক, গ্যালারিতে ম্যারাডোনা গলা ফাটাচ্ছেন- এটাই যেন আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের জন্য অনেক বড় এক অনুপ্রেরণার নাম। ২০১৪ এবং ২০১৮ বিশ্বকাপেও ছিলেন গ্যালারিতে। আর্জেন্টিনার প্রতিটি খেলা তিনি মাতিয়ে রাখতেন গ্যালারি থেকে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে মাস্ট উইন ম্যাচে তিনি এতটাই উত্তেজিত হয়ে যান যে, দুই পাশে দুজন তাকে ধরে রেখেছিলেন- এই বুঝি তিনি হার্ট অ্যাটাক করেন, এমন অবস্থা।
১৯৬০ সালে তার জন্মের আগে হয়েছে ৬টি বিশ্বকাপ। ‘এল পিবে দে ওরো (গোল্ডেন বয়)’, এই বিশ্ব-সংসারে আসার পর আরও ১৫টি বিশ্বকাপ হয়েছে। ১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকে হিসেব করলে এ পর্যন্ত ১০টি বিশ্বকাপে সবকিছু ঠিকই ছিল। প্রতিটি বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন অন্যতম আলোচনার বিষয়। কখনো মাঠে, কখনো ডাগ আউটে বা কখনো গ্যালারিতে। কিন্তু ২০২২ বিশ্বকাপে তাকে কোথাও দেখা যাবে না। ১৯৬০ সালের (এই সালে তার জন্ম) যতগুলো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তিনি ছিলেন পৃথিবীতে। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে নিজ দেশে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন মারিও ক্যাম্পেসরা। বিতর্কিত হলেও ম্যারাডোনা গলা ফাটাতে পেরেছিলেন তরুণ বয়সে। পরেরবার পরিণত হয়েই বিশ্বকাপ মাতাতে আসেন। এর পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। ৬০টি বছর ম্যারাডোনাময় ছিল বিশ্ব ফুটবল। যেভাবেই হোক তার শারীরিক উপস্থিতি ছিল ফুটবলে।
আর ক’দিন বাদেই ২৫ নভেম্বর, তিনি নেই দুই বছর হয়ে গেলো। দিনটি ভুলে যেতে চাইলেও যে দেবেনা এবারের বিশ্বকাপ! থাকলে হয়তো কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামের একটি আসন নির্দিষ্ট হতো তার জন্য। হয়তো মেসিরা মাঠ থেকে অনুপ্রেরণা নিতেন, গ্যালারিতে আনন্দ-উল্লাসে বিভোর থাকা কিংবা খারাপ খেললে হতাশায় মুষড়ে যাওয়া ম্যারাডোনা দেখে। কিন্তু দু’বছর হয়ে গেলো ম্যারাডোনা নেই। হয়তো ওপারে বসে তিনি খেলা দেখবেন। হয়তো উত্তেজিত হবেন মেসিদের ব্যর্থতায়, আনন্দিত হবেন অনুজদের সাফল্যে...। হাজার কিলোমিটার দূরে, এই বাংলাদেশ থেকে আমরা মিস করবো ফুটবল জাদুকরকে।
ম্যারাডোনার ‘সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছিলেন তাকে গোটা ক্যারিয়ারে কড়া মার্কিংয়ে রাখা লোথার ম্যাথাউস। কথাটা আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি নিজেই বলে গেছেন। ২৫ বছর বয়সে এই ম্যাথাউস খেলতেন বায়ার্ন মিউনিখে। ম্যারাডোনা তখন নাপোলিতে। দূরে থাকলেও বন্ধুত্ব ছিল দুজনের। কাছের মানুষ। বিচ্ছেদের ব্যথাটা আর সহ্য করতে না পেরেই বুঝি ক’দিন আগে জার্মান কিংবদন্তি ফেসবুকে স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন এক বাক্যে- যেন বাক্য যত বড় হবে ব্যথাও বাড়বে! কিন্তু সেই একটি বাক্যের মধ্যেই সব ব্যথা লেখা আছে, ‘তোমাকে ছাড়া প্রথম বিশ্বকাপ।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন