অনেক দিন থেকেই মনের গহীনে ভ্রমণের ইচ্ছাটা লুকায়িত ছিল কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে তা হয়ে ওঠেনি। সুযোগটা পেলাম ১০ দিনের ছুটি পাবার পর। আমাদের কলেজের কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর বাংলাদেশের পার্বত্য জেলার ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থানগুলোতে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত হলো। তো ১ অক্টোবর আমরা ৮ জন যাত্রা করলাম খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার উপলক্ষ্যে।
পাবনার বেড়া থেকে দুপুর আড়াইটায় ঢাকাগামী কোচে উঠলাম। ওখান থেকে গাড়ি বদল করে রাত ৯টায় উঠলাম খাখড়াছড়ির শান্তি পরিবহনে। খাগড়াছড়ির পাহাড়ি অঞ্চলের আঁকাবাঁকা রাস্তা আর একটু পর পরই মোড়; গাড়ির ঝাঁকুনিতে আমার মাথা ধরে গেল। সারারাত্রি ধরে একটানা দীর্ঘভ্রমণ আমার জীবনে এই প্রথম। আমি জার্নিতে খুব দুর্বল; কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর মনোবল দৃঢ়। যাহোক, ভোর ৬টার দিকে আমরা খাগড়াছড়ি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেলাম। ওখান থেকে চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে।
সাজেক ভ্যালি রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের একটি বিখ্যাত পর্যটন স্থল। এটি রাঙামাটি জেলার সর্বউত্তরে ভারতের মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত। কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ভূত সাজেক নদী থেকে সাজেক ভ্যালির নামকরণ হয়েছে। সাজেক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন, যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। এর উত্তরে ভারতের ত্রিপুড়া, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম ও পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা অবস্থিত। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। আর দীঘিনালা থেকে প্রায় ৪৯ কিলোমিটার। সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও খাগড়াছড়ি থেকে এখানে যাতায়াত সুবিধাজনক। খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালায় নাস্তা সেরে সেনাবাহিনীর গাড়ির প্রহরায় আমাদের গাড়ি ১১টার দিকে ছেড়ে দিলো। চারিদিকে মনোরম নৈসর্গিক দৃশ্য। উঁচু উঁচু পাহাড়, পাশেই গভীর খাদ; মাঝখান দিয়ে উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা (আদিবাসীসন্তান) হাত নেড়ে টা টা জানাচ্ছে।
ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উচ্চতার সাজেক ভ্যালি যেন এক প্রাকৃতিক ভূ-স্বর্গ। প্রকৃতি এখানে সকাল বিকাল রঙ বদলায়। চারপাশে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সারি, আর তুলোর মতো মেঘ, এরই মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে নৈসর্গিক এ উপত্যকা। কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি এক মনোরম রিসোর্টে আমরা আগে থেকেই সিট বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে বিকেলে বেড়ালাম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য।
সাজেক রুইলুইপাড়া, হামারিপাড়া এবং কংলাকপাড়া, এই তিনটি পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুইপাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১,৭২০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত আর কংলাকপাড়া ১,৮০০ ফুট উচ্চতায় কংলাক পাহাড়-এ অবস্থিত। সাজেকে মূলত লুসাই, পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা উপজাতি বসবাস করে। রাঙামাটির অনেকটা অংশই দেখে যায় সাজেক ভ্যালি থেকে। এই জন্য সাজেক ভ্যালিকে রাঙামাটির ছাদও বলা হয়। আমাদের রিসোর্ট যেখানে অবস্থিত তার কাছেই কংলাক পাহাড়। এখানে দাঁড়িয়ে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পাহাড়গুলোও দেখা যায়।
সাজেকের আদি বাসিন্দারা বিশেষ করে চাকমা, লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা আদিকাল থেকে বসবাস করে আসছে। তাদর বাড়িঘর বাঁশের মাচাংয়ের উপর তৈরি করা। কিছু বাঙালি রয়েছে যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত; জীবিকার তাগিতে এখানে এসে স্থায়ী হয়েছে। পাাহাড়ী মানুষেরা বেশ সহজ-সরল এবং প্রায় এক কথার মানুষ। কোনো কিছু কেনার সময় বেশি দামাদামি করলেও তার কথায় অটুট থাকে। এখানে রয়েছে বাঁশের বহুবিধ ব্যবহার। ঘর-বাড়ি বাঁশ দিয়ে তৈরি ছাড়াও চা-কফি খেতে বাঁশের কাপের ব্যবহার রয়েছে; রয়েছে ‘ব্যাম্বু চিকেন’ যা বাঁশের চোঙের মধ্যে দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হয়। আদিবাসীদের হুকাও বাঁশের চোঙ দ্বারা তৈরি। আমাদের মধ্যে রওশন সাহেব (হিসাব বিজ্ঞানের স্যার) খুব ভ্রমণ প্রিয়লোক। কাকডাকা ভোরে রওশন সাহেব সবাইকে ডেকে তুললেন পাহাড়ি-মেঘের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। বাংলোর পিছনের দরজা খুলে বেলকুনিতে দাঁড়তেই অভিভূত হয়ে গেলাম। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! সাদকালো মেঘ পাহাড় ছেয়ে আছে। এ যে মেঘের রাজ্য! আস্তে আস্তে মেঘগুলো যেন রং বদলাচ্ছে। একটু পর পর দৃশ্যান্তর হচ্ছে। রোদ বাড়ার সাথে সাথে পাহাড়ের গাছের কোথাও সোনালি রোদ্দুরের ঝিলিমিলি আবার কোথাও মেঘের ছায়ার মিতালি। খাগড়াছড়ি ফিরে আমরা বিকেলে যাত্রা করলাম ‘আলুটিলা গুহা’ ও ‘রিসাং ঝর্ণা’-এর উদ্দেশে। আলুটিলা গুহা খাগড়াছড়ি জেলায় আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক গুহার নাম। স্থানীয়দের কাছে আলুটিলা গুহা ‘মাতাই হাকড়’ নামে পরিচিত। আলুটিলা গুহার দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুট। গুহার ভেতরে সব সময় অন্ধকার থাকে এজন্য গুহায় প্রবেশ করতে হলে মশালের প্রয়োজন হয়। গুহার বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, ভিতরে ঝর্ণার মতো পানি গড়িয়ে আসছে (তবে তা অল্প পরিমাণে)। পানির মৃদু স্রোতে পাথরের পথ মানুষের জুতো-স্যান্ডেলের পায়ের কাদায় তা পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। গুহার ভিতরে মশাল না নিয়ে ঢোকার কারণে এক মহাবিপদে পড়ে গেলাম। ভিতরে নিকষ কালো অন্ধকার। মোবাইল টর্সের মৃদু আলোয় গুহার দেয়ালে পড়ে এক ভূতরে পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দলের ্সবাই বিশেষ করে তরুণ শিক্ষক মেহেদী, আমিরুল সবার আগে চলে গেছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষক জমিন ভাই বয়সে প্রবীণ হলেও তিনি নবীনদের মতো উদ্যমী। তিনিও তাদের সঙ্গে আগে চলে গেছেন। সবার পিছনে পড়েছি আমি এবং আমার আগে আছেন উপাধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান। আমার ভয় হচ্ছে গুহার পাথরে ফাঁকে কখন যেন আমার পা আটকে যায়। আমার অসহায় দৃশ্য দেখে আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক নুর ইসলাম মোবইলের টর্সধরে আমাকে রাস্তা পার করে দিলো। গুহার শেষ মাথায় পৌঁছে আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে এ যেন এক ভয়ংকর-সুন্দর দৃশ্যের অবলোকন এবং বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন। আলুটিলা গুহার একটু দূরে ‘রিসাং ঝর্ণা’। আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র হতে এই ঝর্ণার দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। মাটিরাঙা উপজেলার সাপমারা গ্রামে অপূর্ব সুন্দর রিসাং ঝর্ণার অবস্থান। স্থানীয়দের কাছে রিসাং ঝর্ণা ‘সাপ মারা রিসাং ঝর্ণা’ নামে পরিচিত। মারমা শব্দ ‘রিসাং’-এর অর্থ কোনো উঁচু স্থান হতে জলরাশি গড়িয়ে পড়া। রিছাং ঝর্ণার অপর নাম ‘তেরাং তৈকালাই’। প্রায় ৩০ মিটার উচ্চতার পাহাড় থেকে পানি আছড়ে পড়ার এ ঝর্ণার মনোরম দৃশ্য ঘন্টার পর ঘন্টা উপভোগ করার মতো। শুধু দেখে নয়, এ ঝর্ণার পানিতে গোসল করে অনেকে মজা উপভোগ করছে। আমারও মন চাইছিল ঝর্ণার পানিতে গা ভেজাতে কিন্তু বিধিবাম! আমাদের সে প্রস্তুতি ছিল না।
পরের দিন সকালে আমরা রওনা দিলাম খাগড়াছড়ি হয়ে রাঙামাটির কাপ্তাই লেকের উদ্দেশ্যে। সকাল ১১টার দিকে রাঙামাটি পৌঁছানোর পর আমরা একটি ইঞ্জিনচালিত বোট ভাড়া করলাম। কাপ্তাই লেকের অথই জলরাশিতে চলছে আমাদের বোট, চারপাশ ঘিরে রয়েছে ছোট বড় পাহাড়, ঝর্ণা আর চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহে। যেখানে সবসময় চলে জলের সাথে সবুজের মিতালি। একদিকে যেমন পাহাড়ে রয়েছে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্ভার তেমনি লেকের অথই জলে রয়েছে বহু প্রজাতির মাছ ও অফুরন্ত জীববৈচিত্র্য। ১১,০০০ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই কৃত্রিম হ্রদ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আয়তনে সর্ববৃহৎ। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমেরিকার অর্থায়নে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কর্ণফুলি নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করে, ফলে রাঙামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি প্লাবিত হয়ে এই কাপ্তাই লেকের সৃষ্টি হয়। কাপ্তাই হ্রদের চারপাশে রয়েছে জুম পাহাড়, নির্বাণনগর মন্দির (বৌদ্ধ আদিবাসীদের মন্দির), আদিবাসী বাজার ইত্যাদি। যাদের জীবনযাত্রা একেবারেই সাধারণ। পাহাড়ি মার্কেটে (আবিাসী পল্লী) যাবার পর তাদের সদয় ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করল।
আমরা অনেকেই তাদের দোকান থেকে বেডশিট, ঝিনুক বা পুতির মালা, বাঁশের তৈরি বিভিন্ন খেলনা, চায়ের কাপ ইত্যাদি কেনাকাটা করলাম।
ভ্রমণ শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু সময়-সুযোগ ও অর্থের অভাবে অনেক সময় তা হয়ে ওঠে না। আমরা ১ অক্টোবর- ’২২ থেকে ৫ অক্টোবর- ’২২ পর্যন্ত ভ্রমণে ছিলাম। আরো অনেক দর্শনীয় ও ঐতিহ্যবাহী স্থানে যাবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই বাড়িতে জরুরী কাজ ফেলে ভ্রমণে এসেছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আবার সময়-সুযোগ পেলে বাংলাদেশের দর্শনীয় ও ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোতে ভ্রমণে বের হবো এবং তা পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা করব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন