শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মানবজটে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা

| প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০২ এএম

ঢাকা শহরের যানজট ও নানাবিধ নাগরিক বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে মানবজট। দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় এসে ভীড় করছে। নদীভাঙ্গনসহ নানা কারণে গৃহহীন ও কর্মহীন মানুষ যেমন আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকায় আসছে, আবার স্থানীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব ও সবকিছু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে স্বচ্ছল ও নব্যধনী পরিবারগুলোও ঢাকামুখী হয়ে থাকে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মেগাসিটি ঢাকা ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশী জনসংখ্যার চাপে এখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। গত এক দশকে ঢাকার বাসযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক ধারণা ভিত্তি লাভ করেছে। বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরগুলোর র‌্যাংকিং নিয়ে লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক প্রতিবেদনে ঢাকার অবস্থান বরাবরই নিচের দিকের ১০টি শহরের মধ্যে থাকছে। চলতি ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৭৩ টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৬৬তম। অর্থাৎ ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে ৭ম। একদিনে বা হঠাৎ করেই ঢাকা নগরীর এই বিপর্যয় ঘটেনি। পর্যাপ্ত রাস্তা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রতি লক্ষ্য না রেখে বছরের পর বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার কারণেই ঢাকা আজকের বেহাল দশায় উপনীত হয়েছে।

সর্বশেষ জনশুমারী অনুসারে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের লোকসংখ্যা এককোটি ২ লাখের কিছু বেশি বলে পরিসংখ্যান পাওয়া গেলেও আদতে ঢাকার জনসংখ্যা এই সংখ্যার অনেক বেশি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের ১১তম জনবহুল সিটি হিসেবে উঠে এসেছে। গেøাবাল সিটিজ ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫২ লাখে দাঁড়াবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে স্থায়ী-অস্থায়ী ও ভাসমান জনসংখ্যার হিসাব এবং বর্তমানের ক্রমবর্ধমান হার বিবেচনা করলে ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা আরো অনেক বেশিই হবে। ততদিনে ঢাকা তার বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভ‚ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স ঢাকার বহুমাত্রিক সংকটের চিত্র তুলে ধরে এ বছরের জানুয়ারীতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে বলে গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়। সেখানে বলা হয়, বিশ্বের মেগাসিটিগুলোতে জনঘনত্বের সর্বোচ্চ সংখ্যা ধরা হয় প্রতি একরে ১২০জন, সেখানে ঢাকার ৬৩ শতাংশ এলাকায় জনবসতি প্রতি একরে ৩০০ জনের বেশি। পুরনো ঢাকার লালবাগ, বংশাল, গেন্ডারিয়া, খিলগাঁওয়ের মত এলাকায় প্রতি একরে জনবসতি ৭০০ থেকে ৮০০ জনের বেশি বলে জানা যায়। সবচেয়ে বেশি জনঘনত্বের এলাকাগুলো অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়ার চিত্রও বেরিয়ে এসেছে। ঢাকা নগরীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে জনঘনত্ব কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা জানিয়েছেন। জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত ঢাকার রাজপথের ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা ও ফুটপাথে অবৈধ দখলবাজি-চাঁদাবাজি বন্ধ করতে সরকারকে আরো কঠোর ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

ঢাকার নাগরিক বিড়ম্বনার অন্যতম কারণ হচ্ছে যানজট। যানজট নিরসনে গত তিন দশকে প্রতিটি সরকার নানামুখী উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যানজট কমাতে গত দুই দশকে শহরের দুই প্রান্তে বেশকিছু ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। বর্তমান সরকার এমআরটি প্রকল্পের আওতায় এক দশক ধরে বিআরটি ও মেট্টোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে প্রকল্প এলাকায় যানজটসহ নাগরিক বিড়ম্বনা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেলেও আদতে এসব প্রকল্প যানজট ও নাগরিক বিড়ম্বনা কমিয়ে আনতে কতটুকু ভ‚মিকা রাখবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ ও সন্দেহ আছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন বিআরটি প্রকল্পের অংশবিশেষ খুলে দেয়ার পর সেখানে নতুন মাত্রায় যানজট ও যাত্রী বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে। ঢাকার যানজটে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে বলে এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। অপরিকল্পিত নগরায়ন, যত্রতত্র শিল্প কারখানা গড়ে তোলা, এবং অধিক জনসংখ্যার চাপে ঢাকার চারপাশের নদনদী, খাল-জলাভ‚মি, বায়ু ও মাটি দূষণের পাশাপাশি শব্দদূষণের মাত্রা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরণের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূষণের কারণে কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্তি¡ক ক্ষতির হিসাব ধরলে সেটা প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়ে বেশি। পঞ্চাশের দশকের প্রাদেশিক সরকারের রাজধানী ঢাকাকে ভবিষ্যতের কোটি মানুষের মেগা সিটি হিসেবে সঠিক পরিকল্পনার আওতায় গড়ে তোলা হয়নি। আমরা এখন একটি অপরিকল্পিত অতিজনবহুল নগরীর বাসযোগ্যতা, বাস্তুনিরাপত্তাসহ ইকোলজিক্যাল বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। এ থেকে ঢাকা নগরীকে বাঁচাতে হলে ঢাকার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ডিসেন্ট্রালাইজেশন নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে ঢাকার ভেতরে ও চারপাশ থেকে কলকারখানা সরিয়ে নিতে হবে। দেশের বিভাগীয় ও জেলাশহরগুলোর নাগরিক সুযোগ সুবিধাসহ স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বহুমুখী উদ্যোগ ছাড়া ঢাকামুখী জনস্রোত কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। রাজধানী শহরকে বসবাসের অযোগ্য, দূষিত, বিড়ম্বনা-দুর্ভোগের মধ্যে রেখে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন