শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

এবার মূল প্রজননকালে ৮৪ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে, যুক্ত হয়েছে ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি জাটকা

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০২২, ১:৫৬ পিএম

নির্বিঘ্ন প্রজনন নিশ্চিত করণে এবার ২২দিনের ইলিশ আহরণ,পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা কালে উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে সম্পূর্ণ ডিম ছাড়ে। অপর ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল। যা ছিল গত বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী। এবার প্রজননকালে প্রায় ৮ লাখ ৫ হাজার কেজি ডিম ছেড়েছে মা ইলিশ । যার প্রস্ফুটনে দেশে এবার ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানিয়েছেন। ফলে চলতি অর্থ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৬ লাখ টনে পৌছতে পারে বলে আশাবাদী মৎস্য বিজ্ঞানীগন।

এমনকি এবার ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে যে ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে, তার ৩৪%-ই ছিল বড় সাইজের। মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর নমুনায়ন ও জরিপে দেশে বড় সাইজের ইলিশের সংখ্যা বাড়ছে বলেও জানিয়েছেন মহাপরিচালক ড. মাহমুদ।
প্রতি বছরই আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পরে সাগর থেকে ঝাকে ঝাকে ইলিশ উপক’লে ছুটে এসে ডিম ছেড়ে আবার সাগরে ফিরে যায়। আমাদের মৎস্য বিজ্ঞানীগন ভোলার পশ্চিম আউলিয়া পয়েন্টÑতজুমদ্দিন, মনপুরা দ্বীপ, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতাচাপলি পয়েন্ট-এর ধলচর দ্বীপ, মৌলভীরচর দ্বীপ, কালিরচর দ্বীপ এবং মায়ানী পয়েন্টÑমীরসরাই ছাড়াও কুতুবদিয়া পয়েন্ট এলাকায় মা ইলিশের অত্যাধীক প্রচুর্য লক্ষ্য করে ঐ ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারকে ‘প্রধান প্রজননস্থল’ হিসেবে চিঞ্হিত করেছেন। এ বিবেচনায় গত ৬ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহর থেকে ২৮ অক্টোবর মধ্যরাত পর্যন্ত ২২ দিন মূল প্রজনন এলকায় সব ধরনের মৎস্য আহরন সহ সারা দেশেই ইলিশ আহরন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।

২২ দিনের এ নিষেধাজ্ঞার সময় দক্ষিণাঞ্চলের জেলে পল্লীগুলোতে নিস্তদ্ধতা বিরাজ করলেও এবারো ইলিশ আহরনে নির্ভরশীল জেলেদের খাদ্য নিরাপত্তায় সরকার ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮৭ জেলে পরিবারকে ২৫ কেজি করে ১৩ হাজার ৮৭২ টন চাল বিনামূল্যে বিতরন করেছে। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার ৪১টি উপজেলার ৩ লাখ ৬ হাজার ১২০ জেলে পরিবারের মাধ্যে ৯ হাজার ১৮২ টন চাল বিতরন করা হয়। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, দেশে উৎপাদিত ইলিশের ৬৮Ñ৭০ ভাগই দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও উপক’লীয় এলাকায় উৎপাদন ও আহরিত হয়। দেশের মৎস্য সেক্টরে ইলিশের একক অবদান ১২ ভাগেরও বেশী। তবে আজ পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চল সহ দেশের কোথাও একান্তভাবে ইলিশ নিয়ে কোন গবেষনা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠনি।
গত বছরের মত এবারের আহরন নিষিদ্ধকালীন সময়েও জেলেদের মধ্যে আইন ভঙ্গের প্রবনতা বেশী করে লক্ষ্য করা গেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, ২২ দিনে দক্ষিণাঞ্চল সহ উপক’লীয় এলাকায় ইলিশ আহরন বিরোধী প্রায় সাড়ে ১০ হাজার অভিযান সহ প্রায় দু হাজার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এসময় আটককৃত ৩০ টন ইলিশ বাজেয়াপ্ত করে বিভিন্ন এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং-এ বিতরন করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ২ হাজার ১শ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডাদেশ প্রদান করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। এসব অভিযানে প্রায় ৯ কোটি ৫ লাখ ঘন মিটার অবৈধ জাল আটক করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকা। ইলিশ আহরন বিরোধী অভিযানকালে ভ্রাম্যমান আদালত জাল ও নৌকা সহ মৎস্য আহরন সরঞ্জামসমুহ বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রীর মাধ্যমে সরকারী কোষাগাড়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকা জমা করেছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তর।

মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, ২০১৮-এর ৭Ñ২৮ অক্টোবর আহরন বন্ধকালে উপকূলের প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীন মূক্ত জলাশয়ে ৪৮% মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পায়। মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর মতে প্রজননক্ষম মা ইলিশের হার ২০১৭ সালে ৭৩% থেকে ’১৮ সালে ৯৩%-এ উন্নীত হয়। পাশাপাশি এসময়ে প্রজনন সাফল্য ৮০%-উন্নীত হয়। যা এবার ৮৪%-এ উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালে ইলিশের মূল প্রজননকালীন সময়ে দেশে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি উৎপাদিত ডিমের ৫০%-এর সাফল্যজনক পরিস্ফুটন সম্ভব হয়। ২০১৯ সালে মূল প্রজনকালীন সময়ে দেশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র সমুহে পরিক্ষামূলক নমুনায়নে ৮৩% ইলিশের রেনুর পাশাপাশি ১৭% অন্যান্য মাছেরও রেনু পোনা পাওয়া যায়। ফলে ইলিশ আহরন নিষদ্ধকালীন সময়ে উপক’লে অন্যান্য মাছেরও নিরাপদ প্রজনন সাফল্যজনক ভাবে স¤পন্ন হচ্ছে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীগন নিশ্চিত হয়েছেন ।
‘হিলসা ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্লান’এর আওতায় ২০০৫ সালে প্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে দেশে ১০দিন ইলিশ আহরন বন্ধ রাখা হয়। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিনে ও ২০১৬ সালে থেকে ২২ দিনে উন্নীত করা হয়। এমনকি জাটকার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে পূর্বের ৯ ইঞ্চি থেকে ১০ ইঞ্চিতে বর্ধিত করা হয়েছে।

অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ প্রতিদিন শ্রোতের বিপরিতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলে জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়ান করে। ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র এবং মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুত ও জীব বৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করতে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা’ বা ‘মেরিন রিজর্ভ এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে।

মূল প্রজনন মৌসুমে ২২দিন, জাটকা আহরনে ৮ মাস এবং সাগরে ৬৫ দিনের আহরন নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশে গত দুই দশকে ইলিশের উৎপাদন ২ লাখ টন থেকে গত অর্থ বছরে প্রায় ৫.৬৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। যা চলতি বছরে পায় ৬ লাখ টন উন্নীত হতে পারে বলে মৎস্য অধিদপ্তর ও গবেষনা ইনস্টিটিউটের দায়িত্বশীল মহল আশাবাদী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন