শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

বিবাহ বার্ষিকী

মোহাম্মদ আবদুর রহমান

| প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:১৪ এএম


আজ রহমত আলীর অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।অন্যান্য দিন সন্ধ্যার আগেই বাড়ি পৌঁছে যান।তিনি বাড়ি পৌঁছালে বাড়ির ভেতর সুখের উৎসব শুরু হয়ে যায়।তার ছয় বছরের ছেলে আসিফ ও চার বছরের মেয়ে আফ্রিদা বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার শুরু করে দেয়।তারা দুজন বাবাকে কাছে পেয়ে যেন পরম সুখ পায়।তাদের এরকম অনুভূতি দেখে রহমত আলীর হৃদয়ে জমে থাকা দুশ্চিন্তা ও শরীরের ক্লান্তি অপসারিত হয়।তাছাড়াও তার স্ত্রী ইসমেতারা বেগম আগে থেকেই তৈরি থাকেন স্বামীর সেবা করার জন্য ।তিনি ছেলে মেয়েদের মত আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান স্বামীকে কাছে পেয়ে।স্বামী আসার সাথে সাথে তার সেবা করতে শুরু করে দেন।তার কাছে রহমত যেনো সুখের ভান্ডার।জীবনে বেচেঁ থাকার অনুভুতি।এ সব কিছু অনুভব করার পর রহমত আলীর মনে হয় পৃথিবীতে তার মত কেউ সুখী নয়।
কিন্তু আজ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করার আগে দেখতে পেলেন তার সেই সুখের ছোটো বাড়িটি অন্ধকারের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে রেখে নীরবতা পালন করছে।যেন স্বজন হারানোর বিষাদে পাথর হয় আছে।বাইরের বাল্ব গুলো জ্বলে না।অথচ এর আগে কোন দিনই এরকম অন্ধকারের মধ্যে তার বাড়িটিকে দেখেননি।তাই তার হৃদয়ে আশঙ্কার ঝড় সৃষ্টি হল।সকল সুখের অনুভুতি গুলো দ্রুত হতাশায় পরিণত হয়।তিনি মনে মনে ভাবছেন নিশ্চয় কোন না কোন অঘটন ঘটেছে।তাই তিনি তাড়াতাড়ি কলিং বেল বাজালেন।আসিফ দরজা খুলে দৌড়ে ঘরের দিকে ছুটে পালালো। আগের মত কোন উচ্ছ্বাস দেখতে পেলেন না।তিনি ভাবছেন ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন।বাড়ির কোথাও আলো জ্বলে না।অথচ বাড়ির ভেতর আলো না জ্বললে ইমেতারা অস্থির হয়ে যেত।সে কোন দিন অন্ধকারে থাকতে পারে না।তাই তো অনেক খরচ করে বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। যাতে বৃষ্টির সময়ও বাড়িটিকে দিনের মত আলোকিত মনে হয়। আজ বিদ্যুৎ আছে তবুও বাড়ি অন্ধকার হয়ে আছে। বাড়িতে প্রবেশ করার পর বাইরের বাল্ব গুলো জ্বালিয়ে দেন।আসতে আসতে বাড়ির ভেতরে অন্যান্য আলো গুলো জ্বালিয়ে দেন ।তার পর ঘরের আলো জ্বেলে দ্যাখেন ইসমেতারা আসিফ ও আফ্রীদাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে।তিনি ইসমেতারার হাত ধরে বলেন - বলো তো কেন নরকে পরিণত হয়েছে!
ইসমেতারা সে তার হাতটি দ্রুত গতিতে সরিয়ে নেয় ।আর কোন কথা বলে না। তা দেখে রহমত বুঝতে পারেন তার স্ত্রী রাগ করেছে।কিন্তু কেন রাগ করেছে তিনি বুঝতে পারেন না।তাই আবারও বললেন - দ্যাখো সোনা আমার যদি কিছু ভুল হয় তাহলে পরিষ্কার করে বলো।আর আমার ভুল হলে তুমি যে শাস্তি দেবে তা মাথা পেতে নেব। ইসমেতারা রাগে ফোস ফোস করতে বলে- আমদের কথা কি তোমার মনে থাকে? তুমি তো বড় অফিসার।
রহমত এমন কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যায়!তার স্ত্রী কোন দিন এমন ভাবে কথা বলেনি।যে মুখে সারাক্ষন মিষ্টি হাসি লেগে থাকে সেই মুখে ঘৃণার প্রতিচ্ছবি উদ্ভাসিত হচ্ছে।তাই তিনি নম্র হয়ে বললেন - আমি কোন দিন ভাবতে পারিনি যে তুমি এমন কথা বলবে!তোমাকে দেখলেই আনন্দের সাগরে সাঁতার কাটতে থাকি।তোমার আর আমার একই আদর্শ।টাকা নয়, ভালোবাসায় আমাদের মূল মন্ত্র ।অথচ আজ তোমার আমার মধ্যে অফিসকে এনে উপস্থিত করলে!
ইসমেতারা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে সরে গেল। তা দেখে তিনি খুব কষ্ট পেলেন।তিনি বুঝতে পারেন না কি করবেন।
রহমত আলী তার মেয়ে আফ্রিদাকে বুকে জড়িয়ে বলেন - বল তো সোনামুনি তোমার আম্মুর কি হয়েছে?
আফ্রিদা রেগে বলে - তুমি আম্মুকে ভালোবাসো না তাই রাগ করেছে।আজ তুমি একবারও ফোন করনি।আম্মু তোমাকে অনেক বার ফোন করেছিল তুমি কেনো রিসিভ করনি?
এই কথা শুনার পর রহমতের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে অফিসে থাকাকালীন অবস্থার কথা।আজই কাজ শেষ করে ফাইল জমা দেওয়ার কথা ছিল।তাই তিনি কাজটি তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা করছিলেন।কিন্তু আজ তাকে সবার প্রয়োজন পড়ছে।যে কোন দিন ফোন করে না সেও ফোন করছে।আজ সে যেন কোন কাস্টমার কেয়ারে কাজ করছেন।শুধু ফোন আর ফোন ।ফোন থেকে দূরে থাকতে চাইলেও মোবাইলটা যখন তখন ডাকছে। হঠাৎ করে তার স্কুলে পড়ার সময়ের এক বন্ধু ইলিয়াস ফোন করে।সে অনেক সময় ধরে কথা বলে।রহমত খুব তাড়াতাড়ি কথা শেষ করতে চাইলেও আধ ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয় যায়। এতে তার কাজ করতে ভীষণ অসুবিধা হয়।চাপ সৃষ্টি হয় মাথায় ।তাই ফোনটাকে সাইলেন্ট করে টেবিলের পকেটেরর ভেতর রেখে দেন।কাজ শেষ করে বের হওয়ার কিছু পথ আসার পর মনে পড়ে ফোনের কথা। যেহেতু আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে তাই তিনি ফিরে গিয়ে ফোনটা না নিয়ে এসে বাড়ির চলে আসেন ।অন্যান্য দিন একটু সময় পেলেই সে তার স্ত্রীকে ফোন করতেন।কিন্তু তিনি এক বারও ফোন করেনি।
রহমতকে নীরব দেখে আসিফ বলে - বুঝতে পেরেছি আসলে তুমিই অপরাধী।না হলে কেনো নীরব হয়ে আছো?
রহমত কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বলেন - আসলে আমি অপরাধী।আসলেই তোমার আম্মুকে আমি ভালোবাসি না।তবে তোমার আম্মুও আমাকে ভালোবাসে না।যদি ভালোবাসতো তাহলে আমার কি অবস্থায় দিন অতিবাহিত হয়েছে তা বুঝতে পারত।যে মানুষটা দিনে দশ বার ফোন করে ।ভাবা উচিত ছিল কেন সে আজ ফোন করতে পারেনি নিশ্চয় কোন না কোন দুর্ঘটনায় পড়েছে । তা না ভেবে উল্টে রাগ করে বসে আছে ।তোমার আম্মুর প্রতি যে বিশ্বাস ছিল তা আজ নষ্ট হয়ে গেলো। আমি তোমার আম্মুকে নিয়ে গর্ব করতাম।ভাবতাম আমি সৌভাগ্যবান বলে এমন স্ত্রী পেয়েছি।কিন্তু আমার ভাবনা এক্কে বারে মিথ্যে।
তবে শুনো আজ কি হয়েছিল ।রহমত পুরো দিনের কাহিনী তুলে ধরে। তা খুব মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে আফ্রিদা ও আসিফ।তারা বুঝতে পারে তার আম্মু ভুল ভাবছে।মানুষের জীবনে সব দিন একই রকম যায় না।আসিফ তার আম্মুকে বলে অনেক ভুল করেছ।ভুল করেছি আমরাও । আমাদের উচিত ছিল আব্বুর পরিস্থিতি বুঝার।আব্বুর পাশে দাড়ানো উচিত ছিল । তা না করে আমরা আব্বুকে ভুল বুঝেছি।তাই সে তার আব্বুর হাত ধরে ক্ষমা চাই। আফ্রিদাও তার আব্বুর কাছে ক্ষমা চাই।রহমত তাদের বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন - তোমরা কোন ভুল করনি।ভুল করেছে তোমাদের মা।
ইসমেতারা রহমতের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে -আমি সব ভুল করেছি।তুমি কি জানো আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী।তোমার অফিসের সকল স্টাফরা বিবাহ বার্ষিকীতে কত উৎসব পালন করে। কিন্তু তুমি কোন দিন বিবাহ বার্ষিকী পালন করেছ?আসলে তুমি তো জানো না কোন তারিখে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। বিয়ে করতে হয় করে নিয়েছ।আর কি?
ইসমেতারার এমন কথা শুনে সে হতবাক হয়ে যায়!তিনিও বলেন - শুনো আসলেই আমি বিবাহ বার্ষিকীর কথা কোন দিন মনে রাখি না।আর কোন দিনও রাখব না।আমার কাছে প্রতিদিনই বিবাহ বার্ষিকী।তাই আমি প্রতিদিনই তোমাকে বেশি বেশি ভালোবাসি।আমি লোককে দেখিয়ে ভালোবাসতে পারবো না। যেই দিন থেকে বিভিন্ন দিবস বেশি বেশি পালন হতে শুরু করেছে সেই দিন থেকেই সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।মাদার ডে যারা পালন করে তারাই এক সময় তাদের মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে।যারা বিবাহ বার্ষিকী পালন তাদের স্বামী স্ত্রীর অধিকাংশের মধ্যে ভালো সম্পর্ক নেই।তুমি কি চাও বিবাহ বার্ষিকী পালন করি।আর তোমাকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করি।
বলে সে অন্য রুমে চলে গেলো।ইসমেতারা বুঝতে পারে নিজের ভুল ।সেও তার পিছন পিছন হাটতে শুরু করে।রহমত আলমারি থেকে একটি দলিল বের করে ইসমেতারাকে দেয় আর বলেন- দ্যাখো আমার টাকায় কেনা বাড়িটি দুজনের নামে সমান ভাগে ভাগ করে রেজিস্ট্রি করেছি।যদিও কোন দিন ভাবোনি যে এই বাড়ির অর্ধেক তোমার নামে রয়েছে।আমি নীরবে হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে তোমার জন্য কত কি করি তা তুমি বুঝতে পারলে এমন আকৃতজ্ঞর মত কথা বলতে পারতে না।পারলে মিলিয়ে নিও আমার কাছে তুমি কি? বলে তিনি পোশাক পরিবর্তন করে ঘরের বাইরে চলে গেলেন চোখ মুখ জল দিয়ে পরিষ্কার করার জন্য। ইসমেতারার হৃদয়ে ভেসে উঠতে শুরু করল পূর্বের প্রতিচ্ছবি গুলো। কি ভাবে তার স্বামী তার জন্য নীরবে ত্যাগ করেছে ।তার একবার বসন্ত রোগ হয়ে ছিল তবুও সে তাকে দূরে না রেখে বুকে করে রেখে ছিল।অথচ তার দিদির সামান্যতম অসুখ হলে জামাইদা দিদিকে রেখে চলে আসে বাপের বাড়িতে।তার ছোটো বোন ফারিআর ছেলে রাতের সময় দারুন বিরক্ত করে। চিৎকার করে কাঁদে।তাই ফারিয়াকে অনেক রাত একাই ঘরের বারান্দায় পায়চারি করে কাটাতে হয়।যাতে তার ছেলের শব্দ ঘরের ভেতর প্রবেশ না করে।আর যদি কাঁদার শব্দ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে তাহলে তার স্বামী তার উপর নির্যাতন করে।অথচ রহমত তাকে কোন সময় কোনো রকম নির্যাতন করেনি। বরং সব সময় পাশে থেকেছে।সে সকল কষ্ট গুলকে নিজের কাঁধে চাপিয়ে তাকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছে।কোনদিন বুঝতেই দেয়নি নিঃসঙ্গ হওয়ার অনুভুতি।তার মেয়ে আফ্রীদা হওয়ার পর থেকেই সে প্রায় সময় রাতে জেগে থাকত আর দিনে ঘুমাতো ।রহমত রাতের অধিকাংশ সময় জেগে থাকতো আর তাকে ঘুমানোর সুযোগ করে দিতো।এই সব ভাবতে ভাবতে তার হৃদয়ে অনুশোচনার পারদ গলতে শুরু করে।বুঝতে পারে সে আজ কি ভুল করেছে অন্যের কথা শুনে।এমন কর্তব্যপরায়ণ মানুষটাকে অপমান করা তার ঠিক হয়নি।সে আর চাইনা একটি নির্দিষ্ট দিনে বিবাহ বার্ষিকী পালন করতে।সে রহমতের মত করে তাকেও ভালোবাসবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন