জয় থেকে বাংলাদেশ দল তখনও ৩২ রান দূরে। গতকালের ম্যাচের প্রেক্ষিতে এতো পাহাড় সমান বড়! ছক্কার চেষ্টায় শার্দুল ঠাকুরের বল আকাশে তুলে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। উইকেটকিপার লোকেশ রাহুল অবিশ্বাস্যভাবে হাতছাড়া করলেন সেই সুযোগ! ব্যাস, ম্যাচটাও ভারতীয়দের হাত ফসকে বেরিয়ে গেল। দশম উইকেটে সে সময় মোস্তাফিজকে নিয়ে জয়ের দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি পায়ে এগুচ্ছিল ১৫ রানে থাকা মিরাজ। এরপর চাহার-শার্দুলদের আর কোনো সুযোগই দিলেন না মিরাজ। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে প্রতিপক্ষের পেসারদের আত্মবিশ্বাসই নাড়িয়ে দিতে লাগলেন। ধীরে ধীরে নাগালে আসতে লাগল ভারতের দেয়া ১৮৭ রানের টার্গেট।
চাহারের বল হাতে নিলেন ৪৬তম ওভার করার জন্য। ভারতীয় কাপ্তান রোহিত শর্মা এমনভাবে অফ সাইডে ফিল্ডিং সাজালেন যেন হিসেবে উনিশ-বিশ হলেই ব্যাটার কাটা পড়েন। তবে প্রথম বলটি ছিল সেøায়ার এবং অফ স্টাম্পে বাইরে। নির্ভিক ভঙ্গিমায় কাট করে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দিলেন মিরাজ। পরের দুই বল ডট দেয়ার পর চতুর্থ বলে স্কয়ার লেগ থেকে সিঙ্গেল। চাহারের সে বলটি ছিল নো, সুতরাং ফ্রি হিট পায় বাংলাদেশ। জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন ছিল ২ রান। তবে ফ্রি হিটটা মিস করলেন মোস্তাফিজ। গোটা শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে তখন টানটান উত্তেজনা। ফিজ কি পারবেন বাকি দুই বলে নিজের উবইকেট আগলে রাখতে? পরের বলেই মিডউইকেট থেকে সিঙ্গেল আদায় করলেন কাটার মাস্টার। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সকল দুশ্চিন্তা। স্ট্রাইকে যে মিরাজ। তাছাড়া ফিজের সে সিঙ্গেলই নিশ্চিত ম্যাচ টাই হয়ে যায়। শেষ বলে এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে মারা শটে বাংলাদেশের ১ উইকেটের অভাবনীয় এক জয় এনে দিলেন মিরাজ। কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপের ডামাডলের মাঝেই বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে পেল স্মরণকালের সেরা জয় গুলোর একটি।
এই জয় কি শুধু ভারতের বিপক্ষে? মোটেই না। এই প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলে টাইগারদের লড়তে হয়ে দ্বাদশ খেলোয়াড়ের বিপক্ষে, যার নাম আম্পায়ার। গতকালের ম্যাচেও ইংলিশ আম্পায়ার মাইকেল গফের দুটি সিদ্ধান্ত গেল বাংলাদেশের বিপক্ষে। আনামুল হক বিজয় তাও রিভিউর জোরে বেঁচে গেলেন। তবে খেলার গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ইংলিশ আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের কারণে দারুণ ভুগতে হলো টাইগারদের। রিভিউ নিয়েও শেষ রক্ষা হলো না রিয়াদের। কারণ আলতো করে ছুঁয়ে যায় বল স্টাম্পকে। আম্পায়ারস কলে সাজঘরে রিয়াদ। দলের রান তখন ৫ উইকেটের বিনিময়ে ১২৮। এরপরই খেয় হারালো বাংলাদেশ। পরের ১২ রানের মাঝে হারালো আরও ৪ উইকেট। শেষ উইকেট জুটিতে মিরাজের সঙ্গে যখন মোস্তাফিজ যোগ দেন, বাংলাদেশের তখনো প্রয়োজন ছিল ৫১ রান। ভাগ্যিস মিরাজ ছিলেন, তা না হলে আরও একবার বাংলাদেশে ক্রিকেটের মাথা নিচু হতো আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারতে।
এর আগে টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন তামিম ইকবালের অনুপস্থিতিতে এই সিরিজের কাপ্তান লিটন দাস। ভারতের ইনিংসে বাংলাদেশের গল্পটা লিখেছেন সাকিব আল হাসান। ৩৬ রানে নিয়েছেন ৫ উইকেট। এই অলরাউন্ডার এখন বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি বয়সে ওয়ানডেতে ৫ উইকেট শিকারি। এই যাত্রায় তিনি পেছনে ফেলেছেন মোহাম্মদ রফিককে। সাকিবের পাশাপাশি ৪৭ রানে ৪ উইকেট এবাদত হোসেনের। এ দুজনের দাপটে প্রথমে ব্যাট করে ৪১.২ ওভারে ১৮৬ রানের বেশি করতে পারেনি ভারত। ভারত ৪৯ রানের মধ্যেই হারিয়ে বসে ৩ উইকেট। দলের ২৩ রানে শিখর ধাওয়ান ফিরে যাওয়ার পর ৪৮ ও ৪৯ রানে বিদায় নেন ভারতীয় ব্যাটিংয়ের দুই মহীরুহ রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি। ৪৩ রানের জুটি গড়ে প্রাথমিক বিপর্যয় সামাল দেন চার ও পাঁচে নামা শ্রেয়াস আয়ার ও লোকেশ রাহুল। ৯২ রানে বিদায় নেন আয়ার। তবে একপ্রান্তে রানের চাকা সচল রেখে ভারতকে এগিয়ে নিতে থাকেন লোকেশ রাহুল। তাকে যোগ্য সঙ্গ দেন ওয়াশিংটন সুন্দর)। তবে ১৫২ থেকে ১৮৬, এই ৩৪ রান তুলতেই শেষ ৬ উইকেট হারায় ভারত। ২০১১ বিশ্বকাপের পরে এত কম রানে ৬ উইকেট ভারত আর একবারই হারিয়েছে। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৭৩ রান আসে রাহুলের ব্যাট থেকে।
ছোট লক্ষ্যে খেলতে নেমে প্রথম বলেয় বিদায় নেন নাজমুল হোসেন শান্ত। ২৬ রানে বিজয়ও ধরেন সাজঘরের পথ। এরপর দলের হাল ধরার চেষ্টা করেন কাপ্তান লিটন ও সাকিব । দুজনে মিলে গড়েন ৪৮ রানের জুটি। তবে ৭৪ রানে লিটন ৪১ করা লিটন এবং ৯৫ রানে সাকিব ২৯ ফিরলে বিপদ বাড়ে বাংলাদেশ দলের। এরপর ধীরে সুস্থে জয়ের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন মুশফিকুর রহিম ও রিয়াদ। এরপরই গফের সেই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। রিয়াদ ফেরেন ১৪ রানে এলবিডব্লিউর ফাঁদে। আর মুশির সংগ্রহ ছিল ১৮ রান।
এবার একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত ২০১১ সালের বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টাইগারদের ম্যাচ দেখতে মাঠে গিয়েছিলেন নন্দিত কথা সাহিত্যিক। আগে ব্যাট করতে নামা টাইগাররা সেই ম্যাচে ১৫৯ রানে ৭ উকেট হারিয়ে ফেললে, মাঠ থেকে বের হয়ে আসেন বাংলা সাহিত্যের দিকপাল। পরে বাংলাদেশ ম্যাচটি জেতে ২৭ রানে। এরপর হুমায়ন স্বীকার করেছিলেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস সেদিন আগেভাগে মাঠ ত্যাগ করা। এবার গতকালের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ফেরা যাক। আফিফ হোসেন আউট হওয়ার পরই প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গ্যালারি ফাঁকা। কিন্তু যারা ছিলেন, তাদের অনেক দিন মনে রাখার মতো এক ম্যাচ উপহার দিল মিরাজ-মোস্তাফিজের শেষ উইকেট জুটি। মিরাজ করেছেন দারুণ আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিং। হলেন ম্যাচ সেরা। মিরাজ অপরাজিত থাকেন ৩৯ বল ৩৮ রান করে এবং মোস্তাফিজ ১১ বলে ১০ রান করে দিয়ে গেল যোগ্য সহায়তা। এই দুইজন গড়লেন ৪১ বলে ৫১ রানের অবিশ্বাস্য জুটি। যা দশম উইকেটে বাংলাদেশের সেরা এবং ওয়ানডে ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ। এই আত্মবিশ্বাসটাই বাংলাদেশের ক্রিকেটে ফিরে আসুক বারবার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন