বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেলাধুলা

রেকর্ডের মালায় মহাকাব্যিক সেঞ্চুরি

‘রিমেম্বার দ্য নেম, মেহেদী হাসান মিরাজ’

ইমরান মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

আগের ম্যাচে যেখান থেকে শেষ করেছিলেন, গতকাল শুরুটা যেন সেখান থেকেই করলেন। আর যখন থামলেন ততক্ষণে নিজে উঠে গেছেন সাফল্যের চূড়ায়, দলকেও নিয়ে গেছেন স্বপ্নের নতুন ঠিকানা। রূপকথার মতো ব্যাটিংয়ে রেকর্ডে রাঙা এক সেঞ্চুরি জানিয়ে দিলেন- ‘রিমেম্বার দ্য নেম, মেহেদী হাসান মিরাজ’!
সেই একই ভেন্যু- আগের ম্যাচে যেখানে শেষ জুটিতে বিরোচীত ব্যাটিংয়ে দলকে জেতানো দেখেছে বাংলাদেশ। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সেই গ্যালারি এদিন আগের ম্যাচের চেয়েও টইটুম্বুর। আসন তো পরিপূর্ণই, দাঁড়ানো দর্শকও কম নয়। ম্যাচের ঘণ্টা দেড়েক পার না হতেই সেই গ্যালারি মৃতপ্রায়! ২০ ওভারের আগেই যে উধাও বাংলাদেশের ৬ উইকেট! সেই গ্যালারিকেই জাগিয়ে তুললেন মিরাজ। ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে নিয়ে গড়লেন রেকর্ড ১৪৮ রানের জুটি। ভারতের বিপক্ষে যে কোনো উইকেটে যা বাংলাদেশের সেরা জুটি। যা ভারতের বিপক্ষে সপ্তম উইকেট জুটিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। এর আগে এনামুল হককে নিয়ে ২০১৪ সালে সপ্তম উইকেটে সর্বোচ্চ ১৩৩ রানের জুটি গড়েছিলেন মুশফিক।
পরে পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে মিরাজ তুলে নিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। এখানেও আছে এই স্পিনিং অলরাউন্ডারের মাইলফলক ছোঁয়ার গর্ব। আট নম্বরে নেমে ওয়ানডে ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় সেঞ্চুরি এটি। আগের সেঞ্চুরিটি সিমি সিংয়ের, গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আইরিশ অলরাউন্ডার খেলেন ৯১ বলে ঠিক ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস। পাশাপাশি একটি রেকর্ডে ছাড়িয়ে যান নিজেকেও। আটে নেমে বাংলাদেশের হয়ে আগের সর্বোচ্চ ইনিংসটি ছিল মিরাজেরই। গত ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর অপরাজিত ৮১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, আট নম্বরে নেমে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার রেকর্ডও এখন মিরাজের। আর নাসুম আহমেদকে নিয়ে শেষে ৫৪ রান যোগ করেও মিরাজ হয়েছেন রেকর্ডের অংশীদার। ৮ম উইকেটে ভারতের বিপক্ষে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি।
অথচ এই পথটুকু পাড়ি দিতে কি কাঠ-খড়টাই না পোড়াতে হয়েছে মিরাজকে। ৮৩ বলে অপরাজিত ১০০ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটিতে যেমন ছিল দলকে কিছু দেবার তাড়না, ছিল নিজেকে প্রমাণেরও সংকল্প। ছিল ছন্দময় ব্যাটিংয়ের কারিকুরি, ছিল ধৈর্য্যশীলতার ছাপ। শেষদিকে এসে যখন গোটা হোম অব ক্রিকেটে মিরজারে নার্ভাস নাইটির ভয়ে তটস্থ, তখনও অকুতোভয় খেলে গেছেন দু’হাত খুলে। এই যেমন শেষ ওভারের শার্দুল ঠাকুরের খাটো লেংথের পঞ্চম বলটি মিড-অফের ওপর দিয়ে চালিয়ে ছিলেন মিরাজ। সীমানার ঠিক আগে সেটি থামিয়ে ২ রানে আটকে রাখলেন বিরাট কোহলি। মিরাজ নিজে তো বটেই, গ্যালারির প্রায় ২৫ হাজার দর্শকের তখন অধীর অপেক্ষা আর একটি মাত্র রানের! হবে তো, হবে তো একটি গুঞ্জন গোটা মিরপুর জুড়েই। সেখান থেকেও নির্ভার থেকে ইনিংসের শেষ বলটি মিড অনের দিকে আলতো করে ঠেলেই যে আত্মবিশ^াসী দৌঁড় দিলেন মিরাজ, তার শেষটা হলো হেলমেট খুলে বুনো উচ্ছ্বাসে। দুই হাত আকাশে তুলে সারলেন উদযাপন। যেন ডুব দিলেন ওই মুহূর্তটায়। অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ে তিনি প্রথম ম্যাচে জিতিয়েছেন দলকে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে শুধু আগের ম্যাচ নয়, ছাড়িয়ে গেলেন যেন আগের সবকিছু।
মিরাজ এ দিন ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তাকে থামানোর কোনো পথই বের করতে পারেনি ভারত। ১৯ ওভার শেষে যখন উইকেটে যান, দল তখন ধুঁকছে। ৫০ ওভার যখন শেষ হলো, তখন দল উড়ছে। মিরাজ তখন হাসছেন। তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ৮৩ বলে ১০০ রান। ইনিংসটি রাঙান তিনি ৮ চারের সঙ্গে ৪টি দৃষ্টিনন্দন ছয়ে। তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি এটি। আটে নেমে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি।
ঘরের মাঠে ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে পাঁচ ইনিংসে ৪ ফিফটিতে ২৪২ রান করেছিলেন মিরাজ। এর সঙ্গে ১২ উইকেট নিয়ে জিতেছিলেন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। তখনও ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। কিন্তু সে বছর টেস্ট অভিষেকের সিরিজে ১৯ উইকেট নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মূলত বোলার হিসেবেই পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তবু ব্যাট হাতে নিজের সামর্থ্য দেখানোর চেষ্টা প্রায়ই দেখা গেছে তার ব্যাটে। গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পেয়েছেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। এর বাইরে বেশ কিছু ফিফটির পাশাপাশি প্রায় নিয়মিতই কার্যকরী ৩০-৪০ রানের ইনিংস খেলে নিজের ব্যাটিং স্বত্বার জানান দিয়ে আসছেন তিনি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪৫ রানে ৬ উইকেট পড়ার পর আফিফ হোসেনের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ১৭৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে দলকে মনে রাখার মতো জয় এনে দিয়েছিলেন মিরাজ। প্রায় ১০ মাস পর ম্যাচের প্রথম ইনিংসে প্রায় একই পরিস্থিতি থেকে করলেন সেঞ্চুরি।
মিরপুর এই ম্যাচে শুরু থেকে ধুঁকে ধুঁকে এগোতে থাকা বাংলাদেশকে বড় ধাক্কা দেন ওয়াশিংটন সুন্দর। এই অফ স্পিনারের বলে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও আফিফ হোসেনের উইকেট হারিয়ে চোখের পলকে ৩ উইকেটে ৬৬ থেকে বাংলাদেশের রান হয়ে যায় ৬ উইকেটে ৬৯। ব্যাটিংয়ে নেমে সেই ওয়াশিংটনের ওভারেই প্রথম ছক্কা মারেন মিরাজ। উইকেটের চরিত্র বুঝে শুরু থেকেই সাবলিল ছিলেন তিনি। ইনিংসের ২৯তম ওভারে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে ওয়াশিংটনের মাথার ওপর দিয়ে মারেন মেহেদী হাসান মিরাজ। অনেকটা পথ দৌড়েও নাগাল পাননি লং অনে দাঁড়ানো শার্দুল ঠাকুর।
তখনও দলের বিপদ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় নন স্ট্রাইকে থাকা মাহমুদউল্লাহ কাছে গিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন মিরাজকে। কিন্তু মিরাজের চোখেমুখে তখন পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের ছাপ। যেন শট খেলেই পরিণতি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। আগের ম্যাচে যেখানে শেষ করেছিলেন, এদিন যেন সেখান থেকেই খেলছিলেন মিরাজ। অপরপ্রান্তে মাহমুদউল্লাহ ছিলেন দৃঢ়তার মূর্ত প্রতীক হয়ে। ইনিংসের ৩০ ওভার পেরোনোর আগেই দুজনের জুটিতে আসে ৫০ রান। এরপর আর পেছনে তাকানো নয়। প্রথম ছক্কার দুই ওভার পর আকসার প্যাটেলকে সøগ সুইপ করে ডিপ মিড উইকেটের ওপারে আছড়ে ফেলেন মিরাজ।
৩৮তম ওভারে উমরান মালিকের বলে ১ রান নিয়ে তিনি পূরণ করেন ক্যারিয়ারের তৃতীয় ফিফটি। পঞ্চাশ ছোঁয়ার পথে বাংলাদেশের চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২ হাজার রান ও ২০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন মিরাজ। তার আগে এটি করেছেন মোহাম্মদ রফিক, মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান। দলের রান ২০০ পার করে শেষ হয় মাহমুদউল্লাহর লড়াই। তার বিদায়ে ভাঙে ১৪৮ রানের সপ্তম উইকেট জুটি। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে যে কোনো উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি এটি। সপ্তম উইকেটে ওয়ানডে ইতিহাসে এর চেয়ে বড় জুটি রয়েছে স্রেফ দুটি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৫ সালে সপ্তম উইকেটে ১৭৭ রান যোগ করেছিলেন জস বাটলার ও আদিল রশিদ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আফিফ হোসেন ও মিরাজ গড়েন ১৭৪ রানের জুটি।
অভিজ্ঞ সঙ্গী ফেরার পর পুরো দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। অন্য প্রান্তে নাসুম আহমেদ ২ চার ও ১ ছয়ে মিরাজকে দেন নির্ভরতা। উমরান মালিকের করা ৪৯তম ওভারে তিন চারে ৮৫ রানে পৌঁছে যান মিরাজ। ছাড়িয়ে যান তার আগের সর্বোচ্চ ৮১ রানকে। গ্যালারিতে তখন গর্জন, ‘মিরাজ, মিরাজ, মিরাজ।’ শার্দুল ঠাকুরের করা শেষ ওভারের প্রথম বলে নাসুম ১ রান নিতে আরও বাড়ে গ্যালারির আওয়াজ। সবাই তখন অপেক্ষায় মিরাজের সেঞ্চুরির। দ্বিতীয় বলে সেøায়ার ডেলিভারিতে দারুণ সøগ করে নব্বইয়ের ঘরে পা রাখেন মিরাজ। পরের বলে রান না হলেও চতুর্থ বলে আরেকটি ছক্কা। পৌঁছে যান সেঞ্চুরির আরেকটু কাছে। শেষ দুই বলে ৩ রান নিয়ে নিজের ইনিংসকে তিনি দেন পূর্ণতা। সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়ায় লুটিয়ে পড়লেন সেজদায়। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে দুর্দান্ত ব্যাটসম্যানশিপের প্রদর্শনী মেলে ধরে যেন জানিয়ে রাখলেন, পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার হতে তিনি তৈরি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন