শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

নারীসত্তার বিশ্বজনীন কথাশিল্পী অ্যানি এখঁনো

শহিদুল ইসলাম নিরব | প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

গত বছরগুলোর মতো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে আমরা আবার মাতামাতি করব, আলোচনা করব, কেউ কেউ বলবেন তাকে তো চিনি না। কিংবা তারচেয়ে আমাদের অমুক ভালো লিখেন। কিন্তু মোদ্দাকথা হলো, ১৯১৩ সালের পর থেকে ১০৯ বছর হয়ে গেলেও আমাদের বাংলার ঘরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জিত হয়নি।
সাহিত্য জগতে মর্যাদার আসন পেতে পুরস্কারটা কি খুব জরুরি? উত্তর হলো- পুরস্কার পাওয়াটা জরুরি না। তবে পুরস্কার একজন লেখক বা কবিকে আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে উৎসাহিত করে। ২০১২ সালে ওয়াল স্ট্রিট জারনালে প্রকাশিত প্রবন্ধে লেখক জোসেফ এপসটেইন নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াই কি সাহিত্য জগৎ ভালো থাকত?’। যার উত্তর পাঠকমাত্রই জানেন।
১৯০১ সালে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন ফরাসি লেখক সুলি প্রুডওম। ২০১৪-তে নোবেল পান আর এক ফরাসি সাহিত্যিক পাত্রিক মোদিয়ানো। অ্যানি এখঁনোর নোবেল প্রাপ্তির পরে ফরাসিভাষী নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের সংখ্যা দাঁড়াল ১৮। যাদের মধ্যে রয়েছেন, ১৯৬৪ সালের নোবেলজয়ী জঁ পল সার্ত্রে-ও, যিনি পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেছিলেন। ইংরেজভাষী সাহিত্যে নোবেল প্রাপকের সংখ্যা ২৯, জার্মান লেখকের সংখ্যা ১৪। নোবেল পুরস্কার কমিটির বিরুদ্ধে ইউরোকেন্দ্রিকতার অভিযোগ আগেও অনেক বার উঠেছিল। আজ প্রাপকের নাম ঘোষণার পরে সাংবাদিক বৈঠকে সেই প্রশ্ন ফের ওঠে। তবে নোবেল কমিটির দাবি, জাতি-বর্ণ-ভাষা-লিঙ্গ নয়, তাদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় সাহিত্যিক উৎকর্ষ। সেই নিরিখেই এ বছর অ্যানি এখঁনোকে বেছে নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ১১৯ জন সাহিত্যে নোবেল প্রাপকের মধ্যে মাত্র ১৭ জন মহিলা।
এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নিলেন ফরাসি লেখক অ্যানি এখঁনো। গত ৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিকেলে সুইডেনের স্টকহোমে এক সংবাদ সম্মেলনে তার নাম ঘোষণা করেন সুইডিশ একাডেমি। ১৭তম নারী হিসেবে তিনি এই পুরস্কার জিতেছেন। অ্যানি এখঁনো ১৯৪০ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক দরিদ্র ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং নরম্যান্ডির একটি শহরে বেড়ে ওঠেন। এখন তার বয়স ৮২ বছর চলছে। অ্যানি এখঁনোর সাহিত্য মূলত আত্মজীবনীমূলক ও স্মৃতিকথামূলক। তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন তার যাপিত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার ওপর ভর করে। বেদনার দিনগুলোকে এঁকেছেন মেঘ রঙিন রঙে। স্বপ্ন আশাকে বারবার জাগিয়েছেন ফিনিক্স পাখির মতো। এ যেন এক অপ্রতিরোধ্য জীবনকে তিল তিল করে শব্দের সম্ভারে সাজিয়েছেন অ্যানি। অনেকটা দুঃখ বিক্রি করেই অ্যানি এ বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। জীবনের সব অভাব ও অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিয়েছেন সাহিত্যের মাধ্যমে।
অ্যানি এখঁনোর লেখা ‘অ্যা উইমেনস স্টোরি’, ‘সিম্পল প্যাশন’ ও ‘অ্যা মেনস প্লেস’ তাকে অনেক পরিচিত করে তোলে। এ লেখাগুলোর মধ্যেই তার জীবন ও সংগ্রামের কথা ফুটে উঠেছে। তার আত্মজীবনীমূলক লেখা মনে করিয়ে দেয় একজন অভাবগ্রস্ত নারীর জীবনে কত রকমের প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। সেগুলোকে কীভাবে পায়ে দলে একটা একপেশি বিদ্রোহী ষাঁড়ের মতো এগিয়ে যেতে হয়।
নোবেল কমিটি বলেছেন, ‘সাহস ও ব্যবচ্ছেদীয় প্রখরতার সমন্বয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতির শিকড়, বিচ্ছিন্নতা ও সম্মিলিত সংযম উন্মোচন করার জন্য’ তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার বিষয়ে একাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘লিঙ্গ, ভাষা ও শ্রেণি সম্পর্কিত শক্তিশালী বৈষম্য দ্বারা চিহ্নিত একটি জীবন তিনি ধারাবাহিকভাবে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করেছেন।’
অ্যানি মূলত ২০০৮ সালে ‘লে অ্যানি’ প্রকাশ হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পান। এটি ২০১৭ সালে ‘দ্য ইয়ার্স’ নামে ভাষান্তরিত হয়। অ্যানির প্রথম উপন্যাস ‘লে আরমোয়ার বিড’ যা ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি তার সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প, যা তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয় ও একদল ভক্ত তৈরি করতে সক্ষম হন।
২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ ও ২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন আমেরিকান কবি লুইস গ্লিক। এর আগে ১৫ জন নারী সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্য একমাত্র নারী প্রয়াত টনি মরিসন নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
অ্যানি এখঁনোর সাহিত্যকর্ম যেমনি আত্মজীবনীমূলক তেমনি সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গেও রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৭৪ সালে ‘লে জার্মোয়ার ভিদ (শূন্য আলমারি)’ নামের গ্রন্থটি প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে আনি এখঁনোর যাত্রা শুরু হয়। তবে সাহিত্য আকাশে তারকা হিসেবে তার প্রকৃত আবির্ভাব ঘটে ১৯৮৩ সালে চতুর্থ গ্রন্থ ‘লা প্লাস (আপন আলয়)’ প্রকাশের মাধ্যমে। তার এই আত্মজীবনীমূলক কল্পসাহিত্য বইতে মাত্র ১০০ পৃষ্ঠাজুড়ে প্রয়াত বাবার জীবনকর্ম ও যে সামাজিক পরিবেশে তার বাবার চারিত্রিক গঠন লাভ করেছিল তার এক আবেগহীন চিত্র অঙ্কন করেন। অ্যানি এক এক করে আরও অনেক আত্মজীবনীমূলক কল্পসাহিত্যের বই লিখেছেন। তার রচনাশৈলী সহজ-সরল কিন্তু অন্তর্ভেদী, প্রায় প্রতিটি লেখাই সংযম ও নৈতিকতা দ্বারা উদ্বুদ্ধ এবং নান্দনিকতায় চরিত্রায়িত।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো তার লেখনীস্বর স্বতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ। বাবাকে ছাড়াও তিনি তার মাকে উপজীব্য করে একই ঢঙে ‘উ্যন ফাম’ নামে (একজন নারী) ছোট একটি উপন্যাস লিখেন। এই বইয়ে তিনি কল্পকাহিনী, সমাজবিদ্যা, অধিবিদ্যা ও ইতিহাসের মেলবন্ধনের সন্ধান করেছেন। এই দুটি বইয়ে অ্যানি এখঁনো সামাজিক পরিবর্তন ও সামাজিক শ্রেণি আনুগত্যের পরিবর্তনের কারণে তার প্রজন্ম ও তার বাবা-মায়ের প্রজন্মের সম্পর্কের টানাপোড়েনের ব্যাপারটি তুলে ধরেন এবং এভাবে ফরাসি সমাজে শ্রেণিবৈষম্যের ব্যাপারটি পরোক্ষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
২০০০ সালে অ্যানি এখঁনো তার সাহিত্যিক জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম ‘লেভেনমঁ’ (ঘটনা) বইটি লিখে ফরাসি সাহিত্যে তুমুল আলোচনা তৈরি করেন। এই বইয়ে তিনি ডাক্তারি সংযমের সঙ্গে একজন ২৩ বছরের যুবতীর অবৈধ গর্ভপাতের কাহিনির আলোকপাত করেছেন। ২০২১ সালে এই উপন্যাসকে ভিত্তি করে একই নামে একটি ফরাসি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। ২০০৮ সালে অ্যানি এখঁনো তার সাহিত্যিক জীবনের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী কর্মটি প্রকাশ করেন, যার নাম ‘লেজানে’ (বছরগুলো)। এই বইটি তার জন্য আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি ও বহু ভক্ত-অনুরাগী এবং শিষ্যের জন্ম দেয়। লেজানেকে প্রথম সামষ্টিক আত্মজীবনী নামে অভিহিত করা হয়েছে। জার্মান কবি ডুর্স গ্রæ্যনবাইন এই বইটিকে সমসাময়িক পশ্চিমা বিশ্বের একটি নতুন পথ সৃষ্টিকারী ‘সমাজবৈজ্ঞানিক মহাকাহিনী’ হিসেবে প্রশংসা করেছেন।
অ্যানি এখঁনোর কথাসাহিত্যে ঐতিহাসিক ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিলন ঘটেছে। ‘লা প্লাস’ ও ‘লা ওঁত’ বইয়ে তার বাবা-মার সামাজিক আরোহণ, ‘লা ফাম জ্যলে’ বইয়ে তার বিয়ে, ‘পাসিওঁ সাঁপল’, ‘স্য পের্দ্র’ ও ‘লোক্যুপাসিওঁ’ বইয়ে তার যৌনচিন্তা ও প্রেম; ‘জুর্নাল দ্য অর’, ‘লা ভি এক্সতেরিয়’ বইয়ে তার চারপাশের পরিবেশ, ‘লেভেনমঁ’ বইয়ে তার গর্ভপাত, ‘জ্য ন্য সুই পা সর্তি দ্য মা নুই’ রচনাতে তার মায়ের আলৎসহাইমার রোগ, ‘উ্যন ফাম’ বইয়ে তার মায়ের মৃত্যু, ‘ল্যুজাজ দ্য লা ফোতো’ বইয়ে তার নিজের স্তন ক্যানসার, ইত্যাদি ব্যাপার সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ফুটে উঠেছে।
অ্যানি এখঁনো ইতিপূর্বে পেয়েছেন প্রি দি লা লাঙ্গে ফ্রাঁসে-র মতো সম্মান। আন্তর্জাতিক লেখক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচারের সঙ্গে। তার নোবেল প্রাপ্তি এক নারীর ব্যক্তিগত যাপনের, আনন্দ-বেদনা-নির্লিপ্তির স্বীকৃতি। সেই সঙ্গে এ-ও বলা যায় যে, এক নির্জন নারীসত্তার বিশ্বজনীন হয়ে ওঠার এক বিশেষ ঘটনা হয়ে রইল এই পুরস্কার।
অবশেষে তার একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে শেষ করছি। প্রশ্নটি হচ্ছে, লেখালেখির কাজে আপনি থিতু হলেন কীভাবে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘‘দুটো বইয়ের কারণে। প্রথমটা সিমন দ্য বুভয়ার ‘দা সেকেন্ড সেক্স’। এ বইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল এক আশ্চর্য প্রতিভাস! দ্বিতীয় বইটি ছিল সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বদ্যিউর লেখা ‘ডেস্টিংকশন’। বইটা ছিল একটা নির্দিষ্ট শ্রেণিতে বসবাস করা মানুষ, এবং সে শ্রেণি থেকে উন্নততর শ্রেণিতে অগ্রগামী হওয়া মানুষের মধ্যে বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক পার্থক্য নিয়ে। এটা পড়ে আমি প্রথমবারের মতো অনুধাবন করতে পারি, ব্যক্তি আমি আর যে পরিবেশে আমি বড় হয়েছি তাতে কী আকাশ-পাতাল তফাৎ। একই সঙ্গে আমি এটাও টের পাই যে, আমার এই নবঅর্জিত সামাজিক অবস্থানে আমি প্রকৃতপক্ষে কখনোই খাপ খাইয়ে নিতে পারব না। তখনি আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে, আমাকে লিখতে হবে।’’ এই উত্তর থেকে অনুমেয় তিনি কতটা শ্রম ও মেধা দিয়ে নিজেকে শানিত করেছেন।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন