হাসু আর হালিমা দুজন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। তারা দুজন অত্যন্ত কোমলমতি এবং পড়ালেখায় খুব মনোযোগী। একদিন হাসু আর হালিমা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ! তারা দুজন দেখতে পেলো পাড়ার কিছু দুষ্টু ছেলেমেয়ে রাস্তার ধারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে মারামারি করছে। একজন অপর জনের দিকে লক্ষ্য করে ঠিল ছুড়ছে। ঠিলের চোটের ভয়ে কেউ বা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে। পড়ার দুষ্টু ছেলেমেয়েদের মারামারি কাণ্ড দেখে হাসুর স্বাধীনতা দিবসের কথা মনে পড়ে গেল। হাসু তখন হালিমাকে বলছে,‘হালিমা আপা আমরা তো প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে দাদুর কাছে অনেক মজার রূপকথার গল্প শুনে থাকি। এবার কিন্তু ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ নিকষ কালোরাতের মর্মান্তিক কাহিনী দাদুর কাছে শুনতে হবে।’
সেদিন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো রাতের আকাশে তারকা রাজি মিটিমিটি জ্বলছিল। হাসু আর হালিমা রাতের খাবার খেয়ে চুপি চুপি দাদুর রুমে প্রবেশ করল এবং তারা দুজন দাদুর পাশে গিয়ে বসল। প্রথমে হাসু দাদুকে বলছে, ‘দাদু তুমি তো প্রতিদিন আমাদেরকে অনেক মজার রূপকথার গল্প শুনিয়ে থাকো কিন্তু আজকে পঁচিশে মার্চ নিকষ কাল রাতের গল্প শোনাতে হবে।’ হাসুর কথা শুনে দাদু আঁতকে ওঠে,
মুহূর্তের মধ্যে দাদুর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। দুচোখে অশ্রু টলমল করে। দাদুর মুখের মিষ্টি হাসি যেন এক নিমেষে থেমে গেল। হাসু তখন দাদুর মন খারাপ দেখে হাসু বলছে, ‘দাদু তোমার মনটা খারাপ হয়ে গেল কেনে? পঁচিশে মার্চ নিকষ কালোরাত কি ভীষণ বেদনাদায়ক রাত? এই রাতে আমাদের দেশে কি হয়ে ছিল?’ দাদু তখন হাসুকে বলছে,“দাদুভাই ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ নিকষ কালোরাত ছিল মর্মান্তিক বেদনাদায়ক রাত। এই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম অত্যাচার আর অমানুষিক নির্যাতন চালায় নিরীহ বাঙালিদের উপর। রাতের আকাশে সেদিন ফানুস নয় গোলা বারুদের ফুলকি উড়ছিল।চারিদিকে নিরীহ মানুষের আর্তনাদ,হাহাকার আর স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিতে বাংলার আকাশ যেন বিষণ্ণতায় ভারী হয়ে গিয়েছিল। নরপশুদের অগ্নিসংযোগে নিরীহ বাঙালিদের শত শত ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। রাজপথে কিংবা বাড়ির আঙ্গিনায় পড়ে ছিল শত শত প্রিয়জনদের মৃত দেহে।
সেদিন ছিল ভয়াবহ বেদনাদায়ক রাত।আমি আস্তে আস্তে দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি। প্রতিবেশী রহিম ভাইয়ের বাড়ি দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সেই মুহূর্তে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। এই বুঝি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমার বাড়িতেও আগুন লাগিয়ে দেয়। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস রহিম ভাইয়ের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখান থেকে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পর বেদনা ভরা মন নিয়ে রহিম ভাই আমার কাছে ছুটে এলো। সে কান্না ভরা কন্ঠে বলতে লাগল, করিম ভাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আজ আমার সব কেড়ে নিয়েছে। নির্মমভাবে হত্যা করেছে আমার স্ত্রী,সন্তানদের। আমি আজ নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমি এখন কাদের নিয়ে বাঁচব আমার শেষ সম্বল টুকু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কেড়ে নিল। আমি তখন রহিম ভাইকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আমরা তো আছি তুমি আমাদের কাছে থাকবে। এই কথা বলতে বলতে আমি রহিম ভাইকে আমার শয়ন কক্ষে নিয়ে গেলাম এবং রহিম ভাইকে বললাম, রহিম ভাই রাতের খাবার খেয়েছ নাকি? রহিম ভাই তখন মাথা নাড়িয়ে বলল,“হ্যাঁ”, খেয়েছি। রাতের খাবার শেষ করার কিছুক্ষণ পর হানাদার বাহিনীর আমার বাড়িতে হামলার চালায়। কুত্তার বাচ্চারা আমাদেরকে শেষ খাবার টুকু ভালো ভাবে খেতে দিলো না। এই কথা শুনে আমি রহিম ভাইকে ঘুমানোর বিছানাপত্র ঠিক করে দিলাম। রহিম ভাই বেদনা ভরা মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
কিন্তু সেদিন চারিদিকে নিরীহ মানুষের হাহাকার আর আর্তনাদ শুনে আমার দু’চোখে ঘুম আসছিল না। আমি সারারাত বেদনা ভরা মন নিয়ে জেগে থাকলাম। নিস্তব্ধ নিশি রাত যখন অবসান প্রায় পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে সকাল হল। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি এখনো রহিম ভাইয়ের ঘুম ভাঙ্গেনি। আমি গলা হাঁকিয়ে রহিম ভাইকে ঘুম থেকে জেগে তুললাম। তারপর রহিম ভাই তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। দু’জন ফ্রেশ হওয়ার জন্য দরজা খুলে বাইরের দিকে গেলাম।চারিদিকে চেয়ে দেখি মাটিতে পড়ে আছে শত শত প্রিয়জনদের লাশ। রহিম ভাই প্রিয়জনদের লাশ দেখে চমকে উঠল। রহিম ভাই মায়াবী কন্ঠে আমাকে বলছে, ‘করিম ভাই আমাদেরকে প্রিয়জনদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে।’ আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করব। আমিও মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম যুদ্ধের যাওয়ার জন্য। আমরা দু’জন সকালে খাবার খেয়ে কিছু প্রয়োজনীয় পোশাক-আশাক টোপলাই বেঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে দিকে রওনা হলাম। পথের মধ্যে অনেক বন্ধুদের সাথে দেখা হল।তারাও আমাদের মত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধাদের দলে যোগ দেবে
কিছুক্ষণের মধ্যে আমি আর রহিম ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পৌছে গেলাম। আমার সেখানে গিয়ে দেখি অনেক যুবক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তখন আমার মনের ভিতর ভয় কেটে গেল।
একজন অপরিচিত লোক এসে আমার আর রহিম ভাইকে ক্যাম্পের ভিতরে নিয়ে গেল। তিনি আমাদেরকে বলছে,কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন তিনটার দিকে মুক্তিযুদ্ধার কমান্ডার তোমাদেরকে নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করবে। এই কথা বলে তিনি ওখান থেকে চলে গেলেন। আমার দুই জন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। যখন তিনটা বাজল তখন একজন মুক্তসেনা আমাদেরকে প্রশিক্ষণ মাঠে নিয়ে গেল। কমান্ডার সাহেব আমার আর রহিম ভাইয়ের হাতে অস্ত্র তুলে দিল। অস্ত্র হাতে পেয়ে ভয়ে যেন আমার বুকটা দুরু দুরু করছিল। কিন্ত কিছুদিন প্রশিক্ষণ নেয়ার পর মনের ভেতর সাহস ফিরে পেলাম। প্রশিক্ষণ শেষে কমান্ডার আমাদেরকে আট নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করার জন্য মোতায়েন করলেন। আট নম্বর সেক্টরের অধিনায়কের নির্দেশ মোতাবেক আমি আর রহিম ভাই একটি ঝোপের আড়ালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য অবস্থা করি । চারিদিকে গোলা বারুদের আওয়াজ আর আকাশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের যুদ্ধ বিমানের গোলা বারুদের ভয়ংকর শব্দ শুনে মনে ভিতরে ভয় ভয় করছিল। কিন্তু রহিম ভাই আমাকে বলছে,‘করিম ভাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের আত্মীয় স্বজনদের হত্যা করেছে ওদেরকে আমাদের ভয় করলে চলবে না। মন শক্ত করে ওদের সাথে লড়াই করতে হবে।’ তখন রহিম ভাইয়ের কথা শুনে আমার মনের ভিতরে একটু সাহস ফিরে এলো। আমি আর রহিম ভাই সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিয়। আমাদের অদম্য সাহসীকতার রণকৌশলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীদের শত শত ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়। মৃত্যু বরণ করে হাজার হাজার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। দিন যায় মাস যায় বনে জঙ্গলে লুকিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে আমরা যুদ্ধ করি।
একের পরে এক পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীদের ক্যাম্প আমাদের দখলে চলে আসে। কিছুদিন পর শুনতে পেলাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা মুক্তিবাহিনীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। তারা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে বিজয় উল্লাসে বাংলার আকাশ মুখরিত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ শেষে বিজয় নিয়ে আমি আর রহিম ভাই অক্ষত অবস্থায় গ্রামে ফিরে আসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন