চট্টগ্রামে স্থবিরতা কাটিয়ে মাঠে গড়িয়েছে রাজনীতি। চলতি বছরের শেষ দিকে এসে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে মুখোমুখি হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বিএনপির মিত্ররাও সরব হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগও তাদের বন্ধুদের কাছে টানতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন সামনের দিনগুলোতে আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহ্যের নগরী চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নানা মেরু করণের পাশাপাশি উত্তাপ-উত্তেজনা বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে জাতীয় রাজনীতিতে।
তবে বছরের শুরুতে বড় দুই দলেই ঘর গোছানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। জাতীয় সম্মেলন হয়ে গেলেও চট্টগ্রাম মহানগর এবং উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ তাদের সম্মেলন করতে পারেনি। তৃণমূলে দল গোছানো যায়নি দলীয় কোন্দলসহ নানা কারণে। একই চিত্র বিএনপিতেও। তৃণমূল থেকে দলকে সুসংহত করার উদ্যোগে বছর শেষে সাফল্য আসেনি।
দেড় দশকের বেশি সময় বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। দলটির নেতাকর্মীদের উপর চলেছে সীমাহীন দমন-পীড়ন। হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে গায়েবি মামলা, হামলা হয়েছে। অনেকে বাড়ি ঘর ছাড়া, কারা প্রকোস্টে বন্দি অনেকে। মহানগর থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের ও নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। গুম, খুনের শিকার হয়েছেন অনেক নেতাকর্মী, সমর্থক। তবে তারা মাঠ ছেড়ে যাননি। পুলিশী বাধার মধ্যে দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরব রয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা।
গত জুলাই থেকে শুরু হওয়া বিএনপির লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচিতে ব্যাপক হারে নেতাকর্মী, সমর্থক, এমনকি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও বাড়তে থাকে। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আগের মতো কঠোর বিধি নিষেধ না থাকায় ধীরে ধীরে রাজনীতির মাঠ দখলে নিতে থাকে বিএনপি। টানা কয়েক মাসের বিক্ষোভ কর্মসূচির পর গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে শুরু হওয়া বিভাগীয় গণসমাবেশে মানুষের ঢল নামে। মূলত ঐতিহাসিক পলোগ্রাউন্ডের ওই কর্মসূচিকে ঘিরে নতুন উদ্যোমে ঘুরে দাঁড়ায় বিএনপি।
বিএনপির ওই সফল মহাসমাবেশের পর নড়েচড়ে বসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ওই কর্মসূচির অনেকটা পাল্টা হিসাবে একই ভেন্যুতে জনসভা করে তারা। ৪ ডিসেম্বরের জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই জনসভাকেও সর্বাত্মক সফল মনে করেন দলের নেতারা। পলোগ্রাউন্ডে বিএনপির সমাবেশের বিশালতার পর আওয়ামী লীগ দেশের অন্য কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। প্রায় প্রতিটি বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে টানা পরিবহন ধর্মঘট পালিত হয়। তবে সব বাধা প্রতিবন্ধকতা ঠেলে সমাবেশে জনতার ঢল নামে। তাতে দারুণ উচ্ছ্বসিত দলের নেতা-কর্মীরা।
এদিকে মাঠে বিএনপির অবস্থান সুসংহত হতেই পাল্টা কর্মসূচি দিতে থাকে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠন। বিগত ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সরকারের নানা দমন-পীড়নে বিরোধী দল এতটাই কোণঠাসা ছিল যে রাজনীতির মাঠ ছিল আওয়ামী লীগের অনুকূলে। তবে মাঠের রাজনীতির বদলে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠন ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দিবস ও রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির মধ্যে সীমিত হয়ে যায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি। ফলে চট্টগ্রামের মাঠের রাজনীতিতে নেমে আসে নজিরবিহীন স্থবিরতা। তবে কোণঠাসা বিএনপি মাঠে নামতেই সক্রিয় হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। আর তাতে স্বাভাবিক গতি পায় মাঠের রাজনীতি। সামনের দিনগুলোতে বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির ময়দান আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠবে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন আর আন্দোলনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ে বছরের শুরু থেকে দলকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়। মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিট থেকে শুরু হয় সম্মেলন ও কমিটি গঠন। তবে দলীয় কোন্দলে তা হোঁচট খায়। বার বার উদ্যোগ নিয়েও ওয়ার্ড এবং থানা পর্যায়ে সম্মেলন শেষ করা যায়নি। মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ দিয়েও তা পেছানো হয়। সর্বশেষ ৪ ডিসেম্বরে সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও পলোগ্রাউন্ডে শেখ হাসিনার জনসভার জন্য তা পিছিয়ে ১৮ ডিসেম্বর করা হয়।
তবে শেষ পর্যন্ত সে সম্মেলনও হয়নি। বলা হয়েছে জাতীয় সম্মেলনের পর সুবিধাজনক সময়ে সম্মেলন এবং কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি হবে। মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় বিগত ২০০৯ সালে। এরপর ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর সম্মেলন ছাড়াই কেন্দ্র থেকে চট্টল বীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সভাপতি ও আ জ ম নাছির উদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। বিগত ২০১৭ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ইন্তেকালের পর মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলেও হয়নি উত্তর জেলার। যুবলীগের সম্মেলন হলেও কমিটি হয়নি। ছাত্রলীগেও সম্মেলন কমিটি গঠন আটকে আছে।
মহানগর বিএনপির কমিটি ভেঙে দিয়ে বিগত ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর ডা. শাহাদাত হোসেনকে আহ্বায়ক ও আবুল হাশেম বক্করকে সদস্য সচিব করে ৩৯ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয় কেন্দ্র থেকে। স্বল্প সময়ের মধ্যে ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানা কমিটি করে মহানগীর সম্মেলন ও কাউন্সিল করার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। একই সময়ে গোলাম আকবর খন্দকারকে আহ্বায়ক আর নুরুল আমিনকে সদস্য সচিব করে ৪৩ সদস্য বিশিষ্ট উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। আবু সুফিয়ানকে আহ্বায়ক ও মোস্তাক আহমদ খানকে সদস্য সচিব করে করা হয় দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক কমিটি। কোন কমিটিই এখনও সম্মেলন করতে পারেনি। ঘর গোছানো বাদ দিয়ে মাঠের রাজনীতিতে সরব হয়েছে দলের নেতাকর্মীরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন