২০০৪ সালে যাত্রা শুরু হলেও আইসিসির স্বীকৃতি পেতে লেগেছে আরো দু’বছর। এরপর থেকে যখনই পেয়েছে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম দুহাতে আলিঙ্গণ করেছে ক্রিকেটকে। ক্রিকেটও দু’হাত ভরে দিয়েছে চট্টগ্রামের হাজার বিশেক দর্শক ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়ামটি। শুরুটা হয়েছিল অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ^কাপ দিয়ে। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ২১টি ওয়ানডে, ২৩টি টেস্ট আর ২০টি ক্ষুদ্র ফরম্যাটের ম্যাচ হয়েছে সাগরিকায়। যেখানে আছে চারচারটি বিশ^কাপ আসরের ম্যাচও। খেলাপাগল চট্টলাবাসির গর্জনে প্রতিনিয়তই ম্লান হয়েছে অদূরে থাকা সাগরের গর্জনও। তারপরও রেকর্ড আর কীর্তিতে ভাস্বর ভেন্যুটিকে বিসিবির কাছ থেকে বরাবরই পেতে হয়েছে ‘সৎ’ সন্তানের বঞ্চনা। দেশের সবচাইতে রানপ্রসবা এই স্টেডিয়ামটির এতদিনের দুঃখ হয়ে ছিল একটি মানসম্মত ইনডোরের। দেরীতে হলেও অবশেষে কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে সাগরিকা, পেয়েছে আন্তর্জাতিক মানের ‘নিজস্ব’ এক ইনডোর। সেটিও দৃষ্টিনন্দন ঝিনুক আদলে। যেন সমূদ্র থেকে উঠে আসা এক ঝিনুক ঝকঝকে ‘মুক্তা’ নিয়ে হাজির সাগরিকায়। আজ বেলা ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে যার উদ্বোধন করবেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন। এসময় উপস্থিত থাকবেন বিসিবি পরিচালক ও ভেন্যু চেয়ারম্যান আ জ ম নাছির উদ্দীন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)’র চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষসহ বিসিবি কর্তারা।
আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামে একটি ইনডোর আইসিসির দৃষ্টিতে আবশ্যক। সেটি যদি হয় স্টেডিয়াম চত্বরে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। অথচ চট্টগ্রামের একমাত্র আন্তর্জাতিক এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামটিতে শুরুতে একটি ইনডোর থাকলেও গত দু’বছর ধরে চলছিল সেই সুবিধা ছাড়াই! এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা অন্য কোনো কারণে মাঠে অনুশীলন সম্ভব না হলে ইনডোরে অনুশীলনও করতে পারছে না ক্রিকেটাররা। তাতে প্রভাব পড়ছে মাঠের খেলায়, আইসিসির কাছেও বাংলাদেশকে পড়তে হচ্ছে লজ্জায়। মূলত চট্টগ্রাম আউটার লিংক রোড তৈরি করতে গিয়ে ভাটিয়ারী থেকে শুরু হয়ে সাগরিকার জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম ঘেঁসে পতেঙ্গায় পড়েছে, যা কিনা কর্ণফুলী টানেলের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। টানেলের ভেতর দিয়ে আনোয়ারা হয়ে কক্সবাজারেও যাবে পথটি। এই রাস্তার ফ্লাইওভারের ল্যান্ডিং এক জায়গায় নির্মিত হয়েছিল, যেখানে এক সময়ে জহুর আহমেদের ইনডোরটি ছিল। ফ্লাইওভার তৈরি করতে গিয়ে জহুর আহেমেদ স্টেডিয়ামের ভূমি অধিগ্রহণ করেছিল সিডিএ, তাতেই ভাঙতে হয় পুরাতন ইনডোরটি। এরপর স্টেডিয়াম চত্বরেই একটি আন্তর্জাতিক মানের ইনডোরের পরিকল্পনা নেয় এনএসসি।
জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ^মানের সুবিধাদি নিয়ে ২০২০ সালে নতুন ইনডোরের কাজ শুরু করে সিডিএ। ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ও বিসিবি পরিচালক আ জ ম নাছির উদ্দীন। গত বছর এই বিপিএলের অষ্টম আসরে আশার বানী শুনিয়ে স্টেডিয়ামের ভেন্যু ম্যানেজার ফজলে বারী খান রুবেল বলেছিলেন, ‘আর মাত্র এক মাসের মধ্যেই এই ইনডোরে অনুশীলন করতে পারবেন ক্রিকেটাররা।’ তবে গত আড়াই বছরের করোনা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ ও বিপিএলের মতো ব্যস্ততায় কাজ হয়েছে ধীরগতিতে। এ কারণেই নির্ধারিত সময়ে গড়ে ওঠেনি এই ইনডোরটি। দেরীতে হলেও অবশেষে কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে সাগরিকা, পেয়েছে আন্তর্জাতিক মানের ‘নিজস্ব’ এক ইনডোর।
ইট-কংক্রিটের দেয়াল আর শক্ত ভিতের অবকাঠামোতেই যে ইনডোর হতে হবে, সে ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দৃষ্টিনন্দন এক অনুশীলন পরিবেশ দিচ্ছে এই ‘ঝিনুক ইনডোর’। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও আন্তর্জাতিক মানের সুবিধাদি নিয়ে ইনডোরটি পড়বে স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে যাবার পথে। ইস্পাতের শক্ত-মোটা খাম আর পুরু হিট প্রুফ কাঁচে ঘেরা অবকাঠামো দিয়েছে দারুন এক অবয়ব। তবে ইনডোরটি সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এক ছাদ। রোদ-বুষ্টি থেকে বাঁচতে যে মোটা সিমেন্ট শিট গুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই নির্মাণশৈলী দেখিয়েছেন স্থাপত্যবিদ। প্রধান ফটকের দিকটা একটু উঁচুতে রেখে ছাদের সিমেন্ট শিটগুলোকে এমনভাবে বসানো হয়েছে তাতে ইনডোরটিকে দেয়া হয়েছে ঝিনুকের অবয়ব। সূর্যালোকে সাগরপাড়ে যেন এক টুকরো ঝকঝকে মুক্তো নিয়ে অপেক্ষায় এক ঝিনুক।
শুধু দেখতেই সুন্দর নয়, কাজেরও বটে এই নতুন ইনডোরটি। আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে এতে। ১৪২ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৫৮ ফুট প্রস্থের এই ইনডোরটিতে আছে চারটি উইকেট। যার দুটি সবুজ টার্ফের, পাশের দুটি ম্যাটের। চাইলে এবারের বিপিএলে অশং নেয়া ফ্রাঞ্চাইজিগুলোও শৈত্যপ্রবাহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য যে কোনো কারণে মুল মাঠে অনুশীলন সম্ভব না হলে ইনডোরেও অনুশীলন করতে পারবেন ক্রিকেটাররা। তা-না হলে আসছে ফেব্রুয়ারি-মার্চে বাংলাদেশ সফর করবে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল। আন্তর্জাতিক কোনো দল হিসেবে জস বাটলার-স্যাম কারানরা ঠিকই পাবেন বাংলাদেশের মাটিতে বিশ^মানের ইনডোরে অনুশীলনের সুযোগ। আর তাতে দীর্ঘ দিনের এক আক্ষেপ ঘুঁচিয়ে পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন স্টেডিয়ামে রূপ পাবে সাগরিকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন