আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসির কোনও বৈশি^ক ইভেন্টে বাংলাদেশের একটি ক্রিকেট দল টানা তিন ম্যাচে জয় দিয়ে শুরু করবে, তা হয়তো অনেকের ভাবনাতেই আসেনি। কিন্তু সেটাই এখন বাস্তবতা। দক্ষিণ আফ্রিকায় চলমান নারীদের যুব বিশ্বকাপের প্রথম আসরে হ্যাটট্রিক জয়ে ‘এ’ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দাপটের সাথেই সুপার সিক্সে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ক্রিকেট দল। যার মধ্যে প্রথম ম্যাচেই ছিল অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে স্বপ্নের মতো শুরু করা।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের শক্তি ও পেশাদারিত্ব বিবেচনা করলে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয় অবশ্যই একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সেটি যে পর্যায়েরই হোক না কেন। অস্ট্রেলিয়ার এই ক্রিকেট দলের পাঁচজন ক্রিকেটার নারীদের বিগ ব্যাশ টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের মতো বড় প্রতিযোগিতায় খেলেছেন। অভিজ্ঞতার তুলনা করলে বাংলাদেশের এই অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ক্রিকেট দলটির বেশিরভাগ সদস্য এখনো পর্যন্ত তেমন কোনও বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়নি। সেখানে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পরে দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে বাংলাদেশের এই যুবারা। আর শেষ ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়েছে টেকনিক্যাল গেম খেলে।
ম্যাচ জয়ের চাইতে যে বিষয়টি নিয়ে সবেচয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তা হলো যেভাবে বাংলাদেশ জিতেছে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের এই খেলায় মাইটি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩০ রান তাড়ায় ৫ উইকেট হারিয়ে ১২ বল হাতে রেখেই জিতেছে দিশার দল। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ ২০ ওভার ব্যাট করে ১৬৫ রান তুলেছে মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে। বাংলাদেশের স্বর্ণা আক্তার আলাদা করে নজর কেড়েছেন এদিন। ২৮ বলে ৫০ রানের একটি ইনিংস তিনি খেলেছেন ১৭৮ স্ট্রাইক রেটে। যা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট উপযোগী।
ব্যাট হাতে দক্ষতা দেখানো বাংলাদেশ দলের আরেক ক্রিকেটার হচ্ছেন আফিয়া প্রত্যাশা। এই টুর্নামেন্টে এখনো পর্যন্ত তিনি শীর্ষ ১০ রান সংগ্রাহকদের মধ্যে একজন তিনি। আফিয়া প্রত্যাশার ব্যাটিংয়ের ভিডিও শেয়ার দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ভেরিফাইড ফেসবুক পাতায় লিখেছে, ‘ইনক্রেডেবল হিটিং’। শেষ ম্যাচে প্রত্যাশা মেটাতে না পেরে দশম হলেও বাকি দুই ম্যাচে ব্যাট হাতে নিজেদের জাত চিনিয়ে সেরা দশে আছেন স্বর্ণা ও দিলারা আক্তাররা।
ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ক্রিকেট বিশ্লেষক এস সুদার্শানন এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটি তিনি মাঠে বসে দেখেছেন। সেদিনই তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়কে স্মরণীয় একটি আপসেট হিসেবে অভিহিত করে লিখেছিলেন, ‘এই দলটার মধ্যে এমন একটা ব্যাপার রয়েছে যা বাংলাদেশের আগের নারী দলগুলোর মধ্যে দেখা যায়নি। সেটা হচ্ছে পাওয়ার হিটিং।’
বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলটি সম্পর্কে অনেকেই তেমন কিছু জানতেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় টুর্নামেন্ট শুরুর আগে তাদের নিয়ে তেমন কোন আলোচনা হয়নি। এই টুর্নামেন্টের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলের জন্য একটি ক্যাম্পের আয়োজন করেছিল। সে ক্যাম্পের আগে বিভিন্ন জেলার নারী ক্রিকেটারদের নিয়ে একটি টুর্নামেন্ট হয়েছিল। সেখান থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ক্রিকেটারদের বাছাই করা হয়। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের মূল কোচ দিপু রায় চৌধুরীর অধীনেই এই টুর্নামেন্টের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে অনূর্ধ্ব-১৯ দলটি। দিপু রায় চৌধুরী বলেন, ‘এই দলটা এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে যাতে তারা বয়সভিত্তিক পর্যায়ে অন্তত দুটি বিশ্বকাপ খেলতে পারেন। এভাবে করে প্রতিভা আর অভিজ্ঞতার একটা মিশেল আনতে চাইছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোডের্র নারী উইং।’ দ্বিতীয় ম্যাচে স্বর্ণা আক্তারের ব্যাটিংয়ে ৫০ রানের ইনিংস দেখে দীপু রায় চৌধুরী বলেন, ‘সামনেই স্বর্ণাকে জাতীয় দলে ডাকা হবে।’
স্বর্ণা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জ্বর নিয়ে খেলতে নেমেছিলেন, মাঠ থেকে বের হওয়ার পরেও শরীরের পরিস্থিতি ভালো ছিল না বলেন দীপু রায় চৌধুরী কিন্তু এমন অবস্থায়ও যে ভয়ডরহীন ক্রিকেটের প্রদর্শনী দেখিয়েছেন স্বর্ণা সেটার প্রশংসা পাচ্ছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের কাছ থেকে। স্বর্ণার ব্যাটিং নিয়ে ক্রিকেট বিশ্লেষক এস সুদার্শানন লিখেছেন, ‘স্বর্ণা শুধু পাওয়ার দিয়ে খেলেন না, তিনি মাঠে ফাঁকা জায়গা সম্পর্কে সচেতন থাকেন এবং সেটা কাজে লাগান।’
কঠিন দুটি প্রতিপক্ষের বিপক্ষে মোটামুটি জাত চিনিয়ে জয় পাওয়া বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশাটা গিয়েছিল একটু বেড়ে। শেষ প্রতিপক্ষ ফুটবল প্রধান দেশ যুক্তরাষ্ট্র হওয়ায় ম্যাচটি একপেশে জয়ের স্বপ্নও দেখছিল বাংলাদেশ। তবে সেখানেই ধাক্কা খেয়েছে দিশার দল। টস জিতে ব্যাট করতে নামা আমেরিকানদের ১০৩ রানেই আটকে ফেলে দিশা-মারুফারা। তবে এই রান তাড়া করতে গিয়েও ম্যাচ যুবা টাইগ্রেসদের ম্যাচটি জিততে হয়েছে ৫ উইকেট খুইয়ে, ১৮তম ওভারে গিয়ে! সেখানেও ছিলেন আফিয়া। এদিন যে হাসেনি তার ব্যাট।
উদ্বোধনী জুটিতে একটু পরিবর্তনও আনেন কোচ দীপু রায়। সবাইকে বাজিয়ে দেখতেই এমনটা করেছেন বলে জানান অভিজ্ঞ এই কোচ। মিডল অর্ডার থেকে সুমাইয়া আক্তারকে ওপেনিংয়ে তুলে আনা হয়। প্রত্যাশার সঙ্গে এই জুটি সফল হয়নি। তবে ফর্মে থাকা দুই ব্যাটার দিলারা ও স্বর্ণা ঠিকই পান রানের দেখা। এই টুর্নামেন্টের সেনসেশন স্বর্ণা যথারীতি আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের ধারা ধরে রেখে ২ চার ও ১ ছক্কায় করেন ১৪ বলে ২২। অবিশ^াস্য ব্যপার হলো, দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার পর পাঁচ ম্যাচ খেলে প্রথমবার আউট হলেন স্বর্ণা। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করেন তিনি অপরাজিত ২০ ও ভারতের বিপক্ষে ৭ ছক্কায় অপরাজিত ৭৮। এরপর মূল টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেন অপরাজিত ২৩, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২৮ বলে অপরাজিত ৫০।
এ দিন বড় জয় না পাওয়ায় মন্দের ভালো দিক, সুপার সিক্সের আগে অন্য ব্যাটারদের খানিকটা ব্যাটিং অনুশীলন হয়ে যায়। তা কাজে লাগিয়ে ১৮ রানে অপরাজিত থাকেন রাবেয়া খান। অধিনায়ক দিশা যদিও ১০ রান করে আউট হয়ে গেলেও আগের দুই ম্যাচে ওপেনিংয়ে ব্যর্থ মিষ্টি সাহা এবার সাতে নেমে কিছুটা ছন্দ খুঁজে পান। অপরাজিত থাকেন তিনি ১৩ বলে ১৪ রান করে। শুধু ব্যাট হাতেই নয়, বল হাতে ৩ ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে বোলিং টেবিলের শীর্ষ দশে আছেন জাতীয় দলের হয়ে খেলা মারুফা আক্তার। তার চাইতেও বড় কথা, মিতব্যয়ী বোলিংয়ে প্রতি ম্যাচেই উইকেট পেয়েছেন এই মিডিয়াম পেসার। প্রথম ম্যাচে অজিদের বিপক্ষে ২ উইকেট নিয়েছিলো সে। আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়েছেন, জিতিয়েছেন।
এই টুর্নামেন্টে স্বর্না এবং আফিফা, দিশা, মারুফারা এখনো পর্যন্ত যে নৈপুন্য দেখিয়েছেন তাতে করে আসন্ন নারী বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য তাদের সম্ভাবনার দুয়ার অনেকটাই খুলে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। অনেকেই আইসিসির ভেরিফাইড পাতার ভিডিওগুলো শেয়ার করে লিখছেন, ‘বাংলাদেশের অন্য দলগুলোর উচিৎ এই দল থেকে শিক্ষা নেয়া’। ফেসবুকে দেশের প্রখ্যাত এক ক্রিকেট বিশ্লেষক লিখেছেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ শেষেও আফিয়া ও স্বর্ণাকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফেরানোর দরকার নেই। আগামী মাসে ওখানেই নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। যদিও যুব আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পার্থক্য অনেক। তবে আমাদের জাতীয় দলের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের যে বাস্তবতা, তাতে প্রত্যাশা ও স্বর্ণাকে জায়গা দেওয়াই যায়।’
২০২০ সালে এই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই প্রথম ও একমাত্র আইসিসির কোনো বৈশি^ক ট্রফির স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল বাংলাদেশের। সেটিও এই যুব ক্রিকেটের হাত ধরে। সেবার আকবর আলী, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীদের হাত ধরে ঝা চকচকে এক ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরেছিল অনূর্ধ্ব-১৯ দল। এবার সেই একই ক-িশনে আরেকটি স্বপ্ন পূরণের পালা যুবা টাইগ্রেসদের। তবে তার চাইতেও সামনে এগিয়ে তাকাতে হবে এই দলটিকে নিয়ে। দলের দিলারা, রাবেয়া খান, মারুফা এর মধ্যেই জাতীয় দলে খেলে ফেলেছেন। অধিনায়ক দিশাও বেশ ভালো অলরাউন্ডার। অনেক সময়ই সামর্থ্য ও যোগ্যতা থাকার পরেও, বাংলাদেশের ক্রিকেট দলগুলো বড় টুর্নামেন্টে ঠিক প্রমাণ দিতে পারেনা মানসিক শক্তির অভাবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই দলটির ক্রিকেটারদের মানসিক শক্তিটাই বড় উপজীব্য। সেটি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন অনেক যতœ, প্রচুর ম্যাচ, ভালো কোচিং আর আর্থিক নিরাপত্তা। সেটি করতে হবে তাদেরই অবিভাবক, ক্রিকেটে অবিভাবক বিসিবিকেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন