নিজের সংস্কৃতিকে যে পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ করতে পারেনি,ভিন্ন সংস্কৃতির উদযাপন তার সৃষ্টিতে মৌলিক কোন সংযোজন করে না।বেশিরভাগ সময়ে তা সম্পর্কহীন ও অনাশ্রিত কিন্তু কারও কারও কৌশলগুণে চোখ ধাঁধানো ব্যাপার সৃষ্টি করে। একদিন সাহিত্যের ভাষাকে বইয়ের ভাষা থেকে মুখের ভাষায় আনার জন্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল,ফলে সাহিত্য অকৃত্রিম হয়েছিল।অথচ আজ সাহিত্য মুখের কথা তো দূরে থাক,হৃদয় থেকেও যেন বিতাড়িত।মধ্যযুগ থেকে কবিতা আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছিল এই মানুষেরই কথা বলা দিয়ে।এক হিসেবে বৈষ্ণব কবিতাতেও মানবিক আদলেই বাক ও মনোধর্মীতা পাওয়া যায়।কিন্তু তার ভাষা ব্রজবুলি ভাষার প্রভাবে ও সুরধর্মীতার জন্য অতি লালিত্যময় হওয়ার কারণে সেখানে আধুনিকতা সৃষ্টি হয়নি।তবে তার সময়ের জন্য সেটাই আধুনিক।সমকালের যা চাহিদা মেটায় তাই সেই সময়ের আধুনিকতা।মোটা চাল মেশিনে মিহি করে কাটলেই যেমন চিকন চালের স্বাদ পাওয়া যায় না তেমনি স্থূল ভাব উপরচালাকি আঙ্গিকে সূক্ষ্ণধর্মী করে প্রকাশ করলেই তা কবিতা নতুন হয় না।কবিতায় ভাষা,উপমা,রূপক ও চিত্রকল্পের প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে।কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করা যেকোন কবির পক্ষেই এসব ট্যাকনিক্যাল বিষয় এখন হাতের নাগালে।সুতরাং সেখানে আর বাজিমাত দেখানোর কিছু নেই।
বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমান,আল মাহমুদের পর এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।তাদের পর আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকাচারকে বিস্তৃতভাবে ধারণ করে এরকম কবি আর আসেনি।বলতে গেলে বাংলা কবিতা তার রাজপথ থেকে সরে গিয়ে যাত্রা থামিয়ে কোন এক নান্দনিক বাগানে চড়ুইভাতিতে মেতে আছে।এই আনন্দ,শব্দের মগ্নতাকে ছোট করছি না।তার আলাদা গুরুত্ব অবশ্যই আছে।তবে বাংলা কবিতার চিরকালের যে প্রেরণা,তা ফিরিয়ে আনতে আবারও রাজপথের কবি দরকার।রাজপথের কবি মানেই তিনি রাজনীতি ও বিবৃতিধর্মী কবিতা লিখবেন তা নয়।তিনি মূলত বাঙালী সংস্কৃতি ও বিশ্ববোধকে এক বিস্তৃত সীমানায় ধারণ করবেন এবং তার সৃষ্টিতে তার প্রকাশ ঘটাবেন।
মধ্যযুগের দেব বন্দনা,অনুবাদ সাহিত্য,মঙ্গল কাব্য এসবের ভেতর পুনরাবৃত্তিমূলক উপাদান থাকলেও,কবিতার যে ব্যাপক প্রেরণা তার কখনও অভাব ছিল না।জীবন ও সমাজের সাথে সেইসব কবিতার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক,তার উপযোগিতা ছিল সমাজে।কবিতায় কবির জীবনের অবশ্যই ব্যাপক প্রভাব থাকে।কবিকে ভাল বা মন্দ হতে হবে এটা জরুরি নয় সত্যি,তবে কবিকে তার আদর্শে,তার বোধে,তার সীমানায় অনেক বড় হতে হয়।সমকালীন জীবন জটিলতা কবিকে সে সুযোগ দিচ্ছে না সেটা ভিন্ন কথা।এই অজুহাতে কোন কবিকে গ্রেস মার্ক দিয়ে বাংলা কবিতা তো তাকে সিংহাসনে বসাবে না।সৃষ্টির সাধনা দিয়েই তাকে তা অর্জন করতে হবে।কবিতার যত রথী-মহারথী আছেন তাদের সবাই বলে গেছেন যে কবিতা যখন মানুষের জীবন ও প্রকৃতির অবলম্বন থেকে দূরে সরে যায় তখন তা শুষ্ক ও প্রাণহীন হয়ে আসে এবং শিল্পের চিরায়ত আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়।সঞ্চয় ফুরিয়ে এলে ক্রমেই তা চমক ও আলোবাজির দিকে ঝুঁকে পড়ে।তাই ভাষাকে নিজের প্রয়োজনেই আবার মাটি ও প্রাণের কাছে ফিরতে হবে।
শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিতা তিরিশের কবিতার উত্তরসুরী।তবে তিরিশের কবিতা থেকে তা কতটুকু অগ্রগামী তা নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ।তিরিশের কবিরা মূলত লিখেছেন আধুনিক নগর মানুষের যাপন ও প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা।কখনও তাদের কবিতায় ক্ষীণ স্বরে দেখা গেছে বিপ্লবের সুর।উত্তরাধুনিকতা নামধারী শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিতা সেই অর্থে কোন বিশ্বাস বা আদর্শে বিশ্বাসী নয়।তা একধরনের আধ্যাত্মবাদী কিন্তু এটা ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার মত নয়,জীবন ও জগত বিষয়ে এক ধরনের উন্নাসিক ভাব।উত্তরাধুনিক কবিতা তাই শব্দ সম্ভার ও নান্দনিকতার দিকে বেশি ঝুঁকে গেছে।তবে কেন যেন আমার মনে হয় তিরিশের কবিতার বিস্তীর্ণ পথের চেয়ে তা ক্রমশ ক্ষীণ ও সরু এক পথে হেঁটে চলেছে,বিস্তীর্ণ জীবনের গন্ধ ও আবেগ যেখানে উপেক্ষিত।একদল কবি মিলে একই সুর ও স্বরের কবিতা নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিখে চলছে।যেখানে ব্যক্তিগতভাবে তাদের চেনা যায় না,পাওয়া যায় শুধু দলগত পরিচয়।প্রতিভার পরিচয় থাকলেও তা গন্তব্যহীন,সময়ের অনুরণনহীন ও চাতুর্যময়। নতুনধারা মূলত মহামারি ও যুদ্ধসঙ্কুল পরিবর্তীত বিশ্বে মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ইঙ্গিতকে প্রাধান্য দিতে চায় কবিতায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন