গুঞ্জনটা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। আগের দিন সিলেট থেকে সেই গুঞ্জনে জোর হাওয়া দিয়েছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পর সেই তোড়ে নড়ল সাড়ে ৮ হাজার দূরত্বের নিউসাউথ ওয়েলস। ইংল্যান্ডের সেই বাতাস ঘুরে তরঙ্গবার্তা হয়ে ফিরল ঢাকায়। তাতে নিশ্চিত হওয়া গেল, চন্ডিকা হাথুরুসিংহেই হচ্ছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নতুন কোচ। নতুন বললে ভুল হবে, নতুন মোড়কে পুরনো কোচ আরকি! এর আগেও যে বাংলাদেশকে বেশ লম্বা সময় কোচিং করিয়েছেন এই লঙ্কান। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিসিবি, হাথুরুসিংহের জাতীয় দলের কোচ হওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। দুই বছরের চুক্তিতে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ হবেন হাথুরুসিংহে। ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসবেন এই লঙ্কান কোচ।
গত ডিসেম্বরে ভারত সিরিজ শেষে হঠাৎই বাংলাদেশ দলের হেড কোচের দায়িত্ব ছেড়েছিলেন রাসেল ডমিঙ্গো। তখন থেকেই নতুন কোচ খুঁজছে বিসিবি। এমাসেই বাংলাদেশ সফরে আসছে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল। তার আগেই প্রধান কোচের শূন্য আসনে কাউকে বসাতে চায় দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থাটি। আলোচনায় তখন থেকেই হাথুরুসিংহে। গতপরশু সিলেটে বিপিএলের ম্য্যাচ দেখতে গিয়ে হাথুরুসিংহের কোচ হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট না করলেও একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বিসিবি সব পাপনও। বলেছিলেন, ‘(প্রধান কোচ) চলে আসবে। আমরা যে ধরণের কোচ খুঁজছি, ফুল টাইম, ওটাতে ও (হাথুরুসিংহে) আছে। অন্য কেউ ফুল টাইম না। কেউ হয়তো দুইশ দিন, কেউ একশ দিন। কাউকে আবার আইপিএলে ছেড়ে দিতে হবে। এটা হাথুরুসিংহের নেই। সেদিক থেকে মনে হয় যে, ওর সম্ভাবনা বেশি। দেখতে পাবেন... ইংল্যান্ড সিরিজের আগে অবশ্যই দেখতে পাবেন। আসবে।’
সেই সন্দেহ গতকাল সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে পরিস্কার করেছে বিসিবি। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী নিজামুদ্দিন চৌধুরী সুজন হাথুরুকে স্বাগত জানিয়ে লেখেন, ‘চন্ডিকার (হাথুরুসিংহে) অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি তার ধারণা দলটির সাফল্য তরান্বিত করতে সহায়তা করবে। তিনি একজন পরীক্ষিত কৌশলী, যার সুফল আমরা তার আগের সময়কালে দেখেছি।’ একই বিজ্ঞপ্তিতে হাথুরুর বার্তাও সংযুক্ত করে দিয়েছে ক্রিকেট বোর্ড। যেখানে দ্বিতীয় বারেরমতো দায়িত্ব নিয়ে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ৫৪ বছর বয়সী এই লঙ্কান, ‘এটা সত্যিই সম্মানের। আবারও বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে কোচিং করানোর সুযোগ পেয়ে আনন্দিত। আমি এর আগে যতদিন সেখানে ছিলাম এদেশের সংস্কৃতির, মানুষের উষ্ণ ভালোবাসা পেয়েছি। আমি আবারও মুখিয়ে আছি দলটির খেলোয়াড়দের সাথে কাজ করতে, তাদের সাফল্য উপভোগ করতে।’
তবে গত দু’দিন ধরে আবার ভিন্ন গুঞ্জনও উড়ছিল দেশের ক্রিকেট অঙ্গনে। অনেকেই বলছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে দেন দরবার করে ক্রিকেট এনএসডব্লিউ’র সঙ্গে বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিচ্ছেন তিনি। তবে এটা যে সত্যি নয় তা অন্তত স্পষ্ট জানিয়ে দিল ক্রিকেট এনএসডব্লিউ। গতকাল নিজের ওয়েবসাইটে ক্রিকেট এনএসডাব্লিউর হেড অব ক্রিকেট মাইকেল ক্লিঞ্জার বলেন, ‘গত কয়েক বছরে ক্রিকেট এনএসডব্লিউ, ব্লুজ এবং সিডনি থান্ডারে চমৎকার অবদান রেখেছেন চন্ডি (হাথুরুসিংহে) এবং তাকে যেতে দেখে আমরা দুঃখিত।’ আর বাংলাদেশই যে হাথুরুর গন্তব্য তা ইঙ্গিতে সেটিও বুঝিয়ে দিয়েছেন ক্লিঞ্জার, ‘কিন্তু তার আন্তর্জাতিকভাবে কোচিং রোল চাওয়ার আকাক্সক্ষাকে আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারি এবং আমরা তার কোচিং ক্যারিয়ারের পরবর্তী অধ্যায়ে তাকে শুভেচ্ছা জানাই।’
এই খবরের সূত্র ধরেই সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে গতকাল বিপিএলে ঢাকা ডমিনেটর্সের বিপক্ষে ফরচুন বরিশালের ম্যাচের সময়ও আলোচনায় ছিলেন হাথুরু। ম্যাচ শেষে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন বরিশাল অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। তাঁকেও প্রশ্ন করা হয়, আবার হাথুরুসিংহের ফেরাটাকে তিনি কীভাবে দেখছেন। উত্তরে কোনো মন্তব্য করতে চাননি জাতীয় দলের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দলনেতা। সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে সাকিব শুধু বলেছেন, ‘নো কমেন্টস।’ তার সঙ্গে আবার কাজ করার অভিজ্ঞতার ব্যাপারে জানতে চাইলে সাকিবের উত্তর, ‘ঠিক আছে (হাসি)।’
ঘটনাচক্রে, প্রথম যেবার বাংলাদেশের কোচ হয়েছিলেন, সেবারও নিউ সাউথ ওয়েলসের সহকারী কোচের দায়িত্ব ছেড়েই এসেছিলেন। ২০১৪ সালের মে মাসে শুরু হয় বাংলাদেশের কোচ হিসেবে তার প্রথম মেয়াদ। স্থায়ী হয়েছিলেন প্রায় ৩ বছর। বিচ্ছেদটা মোটেই প্রীতিকর ছিল না। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। মূলত, নিজের দেশ শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। যদিও বিপুল অংকের পারিশ্রমিকও একটা বড় কারণ ছিল। শ্রীলঙ্কার কোচ হিসেবে হাথুরুসিংহের সময়টা মোটেও সুখকর হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই তার মোটা অংকের বেতন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন দেশের ক্রীড়ামন্ত্রী। বোর্ডের কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়দের সঙ্গে খিটিমিটি লেগেই ছিল। শেষ পর্যন্ত অনেক নাটকের পর তাঁকে বরখাস্ত করে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড।
বাংলাদেশের কোচ হিসেবেও প্রথম মেয়াদে বিতর্কে জড়ালেও বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় কিছু সাফল্য এসেছে তার সময়েই। ২০১৫ সালে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিন ওয়ানডে সিরিজ জয়, সে বছরই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা ছাড়াও ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ তার অধীনে। হাথুরুসিংহের সময় টেস্ট ক্রিকেটেও বলার মতো কিছু সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। মিরপুরে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয় এবং কলম্বোয় বাংলাদেশের শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছিল।
‘কড়া হেডমাস্টার’ হিসেবে খ্যাতি ও কুখ্যাতি দুটোই আছে হাথুরুসিংহের। বলতে গেলে, অনেকটা অপেশাদারের মতো প্রথম মেয়াদে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব ছাড়লেও, অনুমান করা যায় হাথুরুসিংহের কড়া মনোভাবই তাঁকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে টেনেছে বিসিবিকে। তবে সাফল্য বিচারে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে প্রথম মেয়াদে হাথুরুসিংহেকে সফলই বলতে হবে। এবার বদলে যাওয়া বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে হাথুরুসিংহে কেমন করেন সেটাই বড় কৌতুহল।
ইংল্যান্ড দলের বাংলাদেশ সফরে আসার আর ২৩ দিন বাকি। আগামী ১ থেকে ১৪ মার্চের মধ্যে টাইগারদের বিপক্ষে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলবে তারা। ১৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে বিপিএলের এবারের আসর। এর তিনদিন পর ২০ তারিখ বাংলাদেশে পা রাখার কথা হাথুরুর। তার তিনদিন পর ইংল্যান্ড দলও পৌঁছাবে ঢাকায়। ১০-১৫ দিনে নতুন করে দলের সঙ্গে বোঝাপড়া মিটিয়ে কতটা সফল হন হাথুরু সেটিই এখন দেখার। এই দেখার মধ্যেই যে কষতে হবে এবছরই নভেম্বরে ভারতে হতে যাওয়া ওয়ানডে বিশ্বাকপের ছকও।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন