ঢাকা যাওয়ার বিরাট আয়োজন শেষে কবি মারুফ বাসে চেপে বসেন। বাস চলছে না ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করা হচ্ছে বুঝে ওঠা মুশকিল। একটু পরপর বিরাট ঝাঁকুনি। কবি মারুফ এক হাত উঁচু হয়ে আবার চেয়ারে আছড়ে পড়ছেন। তার পাশের ভদ্রলোক একটু হালকা পাতলা হওয়ায় সে দিচ্ছে দেড় হাতের লাফ। সারা বাসে লাফালাফি চলছে। শুধু যাত্রীরাই লাফাচ্ছে এমন নয়। ছিট কভার লাফাচ্ছে। কাচের জানালা কড়কড় শব্দ করে জানান দিচ্ছে যে কোন সময় ছিট কভারের মতো সেও লাফ দিয়ে পড়তে পারে। কাচের জানালা লাফিয়ে পড়লে মারাত্মক বিপদ ঘটে যেতে পারে। ড্রাইভারের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে।
মানুষ ভেদে ধৈর্য ভিন্ন। কবি মারুফের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। চিতকার করে বলে, এই যে ড্রাইভার আমরা হাই জাম্পের প্রতিযোগিতায় যাচ্ছি না যে আমাদের লাফানোর প্রাকটিস করাতে হবে।
-চেতেন ক্যান? রাস্তা ভাংগা।
-ভাংগা রাস্তায় গাড়ি আস্তে চালতে হয়। এতগুলো যাত্রী, বোধ জ্ঞান নেই ?
-না নাই। আফনে আইস্যা গাড়ি চালান।
কথা শেষ করে ড্রাইভার স্টার্ট বন্ধ করে দেয়।
এতো সময় ক্ষিপ্ত, বিড়বিড় করে ড্রাইভারের নিকুচি করা মানুষ গুলো মুহুর্তে ভোল পাল্টায়।
-ড্রাইভার তার মতো করে গাড়ি চালাবে। অল্প রাস্তাই তো ভাংগা।
আরেকজন বলে, এই লোকটাকে ঘাড় ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিন।
উত্তেজিত মানুষের কথায় কবি মারুফ নিজেকে সামলাতে পারেন না।তিনিও উত্তেজেত হন।‘আমি কে আপনি জানেন? জানেন কোথায় যাচ্ছি?’
-আমার জানার কোন দরকার নেই। ইস, কোথায় যাচ্ছে। যেন ক্রিকেট টিমের প্লেয়ার। বড় রিস্ক নিয়ে পাকিস্তান সফরে যাচ্ছে....
এদেশের মানুষ যখন উত্তেজিত হয় তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুঝে না বুঝে সবাই ক্ষিপ্ত হয়।ক্ষিপ্ত হয় যে অসহায় তার উপর।উচ্চ পর্যায়ের হুমকি ধামকিতে কবি মারুফ থ হয়ে যায়। প্রতিজ্ঞা করে, এখন থেকে চুপ করে বসে থাকবে কেউ ছাদ ফুটো হয়ে বেরিয়ে গেলেও কিছু বলবে না। ঢাকা পৌঁছাতে সকাল দশটা বাজে। মাথা এলোমেলো তার ওপর, ক্ষুধার্ত। পেটের ভাষায় বললে,
আমি আর সহিতে পারিনা এ জ্বালা।
কবি, তোমার ভাবনায় আছে শুধু মেলা।
কবি রা আর যাই হোক নিষ্ঠুর নয়। ঢাকা শহরে হোটেল খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। এপাশে ওপাশে হোটেল। মোড়ে মোড়ে হোটেল। ফুটপাতে হোটেল। প্রথম খাবার টা দামী হোটেলেই খাবে। তৃতীয় তলায় হোটেল স্বপ্নপুরী। বড় বড় অক্ষরে লেখা। কবি মারুফ তরতর করে সিড়ি বেয়ে উঠে যান।
রিসিপশন লেখা কক্ষে বড় টেলিভিশন নিয়ে বসে আছে আধাবয়সী এক ভদ্রলোক।
-কী খাবার আছে?
লোকটা ভ্রুকুঞ্চন করে কবি মারুফ কে পর্যবেক্ষণ করে। তার হাবভাবে মনে হয়- যেন বিমানবন্দরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির থার্মাল স্ক্যানার পরীক্ষা করছেন। প্রতিদিন পৃথিবী একটু একটু করে অভিশপ্ত হয়ে উঠছে। দায়ী কে?
হোটেল ম্যানেজার নিরবতা ভেঙে ফিসফাস করে বলেন, কতক্ষণ থাকবেন, কী টাইপ, ফার্স্ট ক্লাস না সেকেন্ড ক্লাস?
একঝাঁক প্রশ্নে কবি মারুফ কিছুটা চিন্তিত হয়ে ওঠেন। খাবারের সাথে ক্ষনের সম্পর্ক, তার সাথে টাইপ! কী টাইপ সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। কম্পিউটার টাইপ না পুরানো আমলের ঘড়ঘড়ে টাইপ? টাইপের পর রেজাল্ট আছে। ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস ! তিনি নিশ্চয়ই ভুল করে কোন কলেজে ঢুকে পড়েছেন!
-সরি স্যার। আমার ভুল হয়েছে। আমি হলাম কবি। পড়াশোনা করতে আসিনি। বইমেলায় এসেছি।
লোকটা নাক সিটকায়। কবিদের গায়ে যেন কটু গন্ধ। কবি মারুফ নেমে আসে। নিচে নেমে ফুটপাতের এক দোকান থেকে ভুনাখিচুড়ি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভাবেন এবার আরাম করে মেলায় যাওয়া যাবে। প্রথম বই, প্রথম মেলা, প্রথম ঢাকা। ভাবতেই কেমন মজা লাগে। প্রকাশকের সাথে কথা বলা দরকার।
-হ্যালো।
-জি ভাই বলেন।
-আমি কবি মারুফ।
-হু, বলেন।
-ঢাকায় নতুন মানুষ। কোথায় আসবো বুঝতে পারছি না।
-শাহবাগের দিকে চলে আসেন। মেলায় যাবেন বললেই হবে।
একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে বলে, মেলায় যাবে ?
-কী মেলায় যাবেন হেইডা কন, মেলার কী আর শেষ আছে।
-মানে!
-মানে আর কী...বানিজ্য মেলা, বিজ্ঞান মেলা, বস্ত্র মেলা, সামনে দেখবেন যাগো সুন্দরী সুন্দরী বউ আছে হেরা বউ মেলা শুরু করে দিছে।
-প্রতিযোগীতার যুগ। সবাই চায় তার আপন প্রতিভা বিকশিত হোক। মানুষের কাছে পৌঁছে যাক।
-আফনে কী কবি ভাইজান?
-হু।
-কবি দেখলেই আমার কাতুকুতু দিতে ইচ্ছা করে। হেরা হাসে না। হুতুমপেঁচার মতো মুখ গম্ভীর কইরা বসে থাকে।
-কই আমি তো গম্ভীর হয়ে বসে নেই। কথা বলছি।
-কথা কইলে কী হবে, আপনার চেহারায় হুতুমপেঁচা ভাব আছে।
মারুফ উত্তেজিত হয়ে বলে, ছোট মুখে বড় কথা, যা ভাগ।
-ভাইগা যামু কিন্তু তার আগে কী আফনেরে একটু কাতুকুতু দিতে পারি স্যার। খুব রাগ করছেন। একটু হাসবেন।
রিকশা ড্রাইভার অনুমতির অপেক্ষা না করেই কবি মারুফ কে কাতুকুতু দেয়া শুরু করে।
পেটের ভেতর ভুনাখিচুড়ির দাপাদাপি। কাতুকুতু। হড়বড় করে বমি করে দেয় কবি মারুফ। কাতুকুতু দেয়া রিকশা ড্রাইভার বৃষ্টি ভেজার মতো বমি ভেজা হয়ে ক্যাবলার মতো তাকিয়ে থেকে বারবার শুধু বলে, একী করলেন স্যার!
কবির কোনদিকে খেয়াল নেই। অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, মেলায় এতো জ্বালা....
বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব সাহিত্যের বহুল আলোচিত, সমালোচিত এবং প্রশংসিত আমেরিকান কবি, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক সিলভিয়া প্লাথ (ঝুষারধ চষধঃয)। ইংরেজি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নারীবাদী এই কবির লেখায় একপ্রকার আগ্রাসী বিচ্ছিন্নতা আর আত্মধ্বংসনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
পারিবারিক সংঘর্ষের কারণে পিতা-মাতার সঙ্গে তাঁর বেড়ে ওঠা হয়নি। শৈশবের অধিকাংশ সময় কেটেছে উইনথ্রপের জনসন এভিনিউতে। পয়েন্ট শার্লি নামক দাদিমা’র বাড়িটি ছিল তাঁর জন্য একটা অভয়াশ্রম। উইনথ্রপে থাকাকালীন সময়ে মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা বোস্টন হেরাল্ড” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯৪০ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস হারান। বাবার সমাধি দেখে ফিরে এসে সিলভিয়া লিখেছিলেন, “ঊষবপঃৎধ ড়হ অুধষবধ চষধঃয” বিখ্যাত কবিতা।
প্রাত্যহিক জীবনের নিত্যব্যবহার্য অনুসঙ্গগুলো তিনি খুব সাবলীলভাবে তাঁর কবিতার ভাঁজে তুলে ধরেছেন। যেমন, আচমকা টেলিফোন, কালশিটে কিংবা রান্নাঘরের সামগ্রী, অপ্রত্যাশিত শারীরিক আঘাত, হঠাৎ করে আসা অতিথি, মোমদানি, কাগজের দাগ, আয়নার প্রতিবিম্ব ইত্যাদি। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে এমনসব প্রসঙ্গ বা চিত্রকল্প যা তাঁর রূপান্তরিত অস্তিত্বকে জানান দেয়।
তাঁর লেখায় রক্ত, ভ্রুণ, করোটি, চাঁদ, হাসপাতালের গন্ধ এসেছে। তিনি কবি ইয়েটস, ডিলান টমাস, মারিয়ান মুরের সাহিত্য চিন্তাধারার প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন।
সিলভিয়ার কবিতায় ধরা পড়ে সমসাময়িক জীবনের অলিগলি আর মৃত্যুর প্রতি আবিষ্ট এক সত্ত্বার মর্মান্তিক নির্যাস। তাঁর লেখায় যুগোত্তীর্ণের আভাস দেখা গেছে বিনা প্রশ্নে,
যেন ওই স্বচ্ছ কাচের বোতলে বন্দী
জাহাজের মতো সুন্দর
ধরাছোঁয়ার বাইরে, বস্তাপঁচা
নজরকাড়া, সাদা এক দুরন্ত পুরাণকথা”।
কবি সিলভিয়া প্লাথের অধিকাংশ কবিতাই আত্মজৈবনিক এবং স্বীকারোক্তিমূলক। তারই ধারাবাহিকতায় ঈড়হাবৎংধঃরড়হ ধসড়হম ঃযব ৎঁরহং” কবিতায় তাঁর সরল স্বীকারোক্তি ছিল এমনটা;
ফাটলধরা কার্ণিশ, আগে ছিল অগুণতি পাথরের স্তম্ভ
তুমি যেই না এসে দাঁড়াও...
নায়কের মতো ফিটফাট, সুবেশ, সুঠাম
আমি ঘটিহাতা সাবেকী ব্লাউজে,
ব্রুচে আঁটা সোনালি রেশম
তোমার চোখেতে চোখ, বিয়োগান্ত যাত্রাপালা শুরু
আমাদের বাজে পোড়া নষ্ট ভিটেমাটি, ফাটল ধরা দেওয়াল, কার্ণিশ...
অস্থিরমনা এই কবি প্রকৃতির সৌন্দর্য, রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, সমুদ্র, সাগরের ঢেউ ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হলেও এসবের মহত্ত্বতা তাঁর ব্যক্তিজীবনে স্পর্শ করাতে পারেননি। প্রতিভাবান এই কবি জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন। তাঁর প্রথম গল্প “অহফ ঃযব ংঁসসবৎ রিষষ হড়ঃ পড়সব ধমধরহ”( ১৯৫০)। এ বছরেই প্রথম প্রবন্ধ লিখেন “ণড়ঁঃয অঢ়ঢ়ষব ভড়ৎ ড়িৎষফ ঢ়বধপব” নামে। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা “দ্য স্মিথ রিভিউ”। তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা ম্যাডমোইসেল” এ সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব পান এবং ছুটে যান। জীবন এবং জীবিকার তাগিদে তাকে ছুটতে হয়েছে এক শহর হতে অন্য শহরে।
কলেজ জীবনের শেষ দিকে তিনি অহঃর -ফবঢ়ৎবংংধহঃ -এর আক্রান্ত হওয়ায় বারবার আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তৎকালীন বিখ্যাত কবি ডিলান থমাসের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তাঁর সাথে সাক্ষাত না হওয়ায় এই প্রথমবারের মত তিনি প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেন। এ হতাশা, বিষন্নতা এবং ভয় থেকে তিনি আর কখনোই নিষ্কৃতি পাননি।
এই তরুণ নারীকবি ব্যক্তিজীবনে কতটা আবেদনময়ী প্রেমিকা ছিলেন তা তাঁর কবিপ্রেমিককে লেখা দুটো লাইন আজও স্মরণ করিয়ে দেয়,,
সেই রাতে কিছুই না, আমি অনুভব করলাম কতটুকু মোলায়েম ও আবেদনময়ী ছিল তোমার শরীর। অসমাপ্ত
সেই মুহূর্ত আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ ব্র্যান্ডির মত মাতাল করে রেখেছে।”
১৯৫৬ সালে কবি তাঁর প্রেমিকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ক্ষণজন্মা এই মহিলা কবির সংসার জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। সিলভিয়া প্লাথ প্রচন্ড মেধাবী প্রমাণে সচেষ্ট হলেও মনোদৈহিক সংকটে ভুগেছেন সব সময়। কবি সেক্সটন ও স্টারবাক ব্যক্তিগতভাবে তাকে সার্পোট দিয়ে গেছেন। ১৯৬০ সালে প্রথম কবিতার বই “ঞযব ঈড়ষড়ংংঁং ধহফ ড়ঃযবৎ ঢ়ড়বসং” প্রকাশিত হয়।
জীবনের কোনো একসময় সিলভিয়া বলেছিলেন, “কখনো পারব কি, এই যে এত বই; সব পড়ে শেষ করতে? ইচ্ছে তো খুব, একার মধ্যে বহু হয়ে থাকার; জীবন কাটাব যখন যেভাবে খুশি। সাধ হয় সবকিছুতে পটু হতে, সাধ্য নেই। বাঁচতে ইচ্ছে করে সব রং, আলো, ছায়া, রস, রূপ , সুরভি নিয়ে। যত রকম মানসিক আর শারীরিক অস্তিত্ব সম্ভব ..সবটুকু শুষে নিয়ে যেন সোচ্চারে বাঁচি। কিন্তু আমার যে কী নিদারুণ সীমাবদ্ধতা!”
তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে লিখতে থাকেন একের পর এক কবিতা। অসমাপ্ত
জীবনের প্রতিটি দশকেই তিনি স্বেচ্ছামৃত্যুর মুখোমুখি হন। কখনো ঘুমের ঔষধ খেয়ে কখনোবা গাড়ির সাহায্যে দূর্ঘটনা ঘটিয়ে। তিনি বলেন, উুরহম, রং ধহ ধৎঃ ষরশব বাবৎুঃযরহম বষংব. ও ফড় রঃ বীপবঢ়ঃরড়হধষষু বিষষ. এই প্রসঙ্গে তিনি আরো লিখেছিলেন, “আমি নি:শর্ত আত্মসমর্পণ করলাম আমার চারপাশের এই অন্ধকারের ঘূর্ণির কাছে; যাকে ভেবেছিলাম এক চিরন্তন বিস্মৃতি মাত্র।” মৃত্যুর আগে তাঁর মাকে লিখেছেন “ও’স ৎিরঃরহম ঃযব নবংঃ ঢ়ড়বসং ড়ভ সু ষরভব, ঃযবু রিষষ সধশব সু হধসব”
বিষাদগ্রস্ততা চোরাবালির মতো সিলভিয়াকে গ্রাস করেছে প্রতিনিয়ত। মানসিক ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে যে যন্ত্রণা পেয়েছেন সে অন্তর্দাহই তাকে সাহস যুগিয়েছে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শক্তি দিয়েছে। তাইতো কলমের খোঁচায় খই ফুটেছে একের পর এক অবিস্মরণীয় কবিতার।
১৯৬০ -এর পর কবিতায় ংঁৎৎবধষরংঃরপ উঠে এসেছে নিসর্গচিত্র। সঙ্গে বন্দীদশার অব্যক্ত যন্ত্রণা আর মৃত্যুর নিঃশব্দ যাত্রাপালা।
তাঁর বিখ্যাত “উধফফু”- কবিতায় পিতা কন্যার সম্পর্কের যে টানাপোড়েন তার বাস্তব কাব্যিক রূপ দেখিয়েছেন। “ঞঁষরঢ়ং” কবিতায় নিজেকে সন্ন্যাসিনী বেশে রহস্যলোকের নিরবয়ব শূন্যতায় কীভাবে নিঃশব্দে বিস্তরণ করে যাচ্ছেন তার প্রতিলিপি এঁকেছেন।
সিলভিয়া প্লাথের একমাত্র আত্মজীবনীমূলক অসমাপ্ত উপন্যাস “ঞযব ইবষষ ঔধৎ”(১৯৬৩) প্রকাশিত হয় ভিক্টোরিয়া লুকাস ছদ্মনামে। আর এই উপন্যাসের বহিঃপ্রকাশ ব্যক্তি জীবনের সংকটময়তা, বিষন্নতা।
তিনি অর্ধশতকেরও অধিক ছোটগল্প লিখেছেন।
অবশেষে ১৯৬৩ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি গ্যাস জ্বালিয়ে ওভেনে মাথা রেখে আত্মহত্যা করেন।
আত্মহত্যার আগে অবশ্য তিনি একটি চিঠি লিখে যান তাঁর স্বামী টেড হিউজের উদ্দেশ্যে “এটি তোমাকে লেখা আমার শেষ চিঠি। তুমি ফিরে এসে আমাকে আর পাবে না।”
কবিরা অভিমানী হয়। সিলভিয়া প্লাথ যেন একটু বেশিই অভিমানী। দুর্দান্ত অভিমানের বশেই আমেরিকান ব্রিটিশ এই কবি চোখ বুজেন। প্রতিথযশা এই কবির স্বর্গীয় আত্মার সমাধী হয় হেপটন্সটল চার্চে, ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার, ইংল্যান্ড। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি ছবি আঁকাতেও পারদর্শী ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তাঁর “অৎরবষ” নামক শেষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়।
উধফফু এবং খধফু খধুধৎঁং এর মতো অসাধারণ কবিতাগুলো তাকে এনে দেয় মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার (১৯৮২)। সিলভিয়া প্লাথ ইংরেজি সাহিত্যের একমাত্র কবি যে কিনা সর্বপ্রথম ব্যক্তি মরণোত্তর পুলিৎজার পুরষ্কার পেয়েছ।
সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু সংবাদ যেন কবি এ্যান সেক্সটন কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাইতো শোকাহত হৃদয়ে লিখেছেন দীর্ঘ লাইনের কবিতা।
সিলভিয়ার মৃত্যু
ওহ্ সিলভিয়া, সিলভিয়া,
পাথর আর চামচ বোঝাই একটা মৃত বাক্স
দু’টো ছেলেমেয়ে, দু’টো উল্কা নিয়ে
একটা ছোট খেলার ঘরে বাঁধনছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছ,
বিছানার চাদরে তোমার মুখ,
কড়িকাঠে তোমার মুখ, তোমার মুখ নীরব প্রার্থনায় জড়িয়ে,
(সিলভিয়া, সিলভিয়া
ডেভনশায়ার থেকে সেই আলু আর মৌমাছির চাষ
করবে বলে লিখবার পর
তুমি কোথায় গেলে?)
কিসের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলে?
কিভাবে তার উপর শুয়ে পড়েছিলে?
চোর-
কিভাবে তুমি হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গিয়েছিলে,
একা একা হামাগুড়ি দিয়ে মৃত্যুর ভিতর,
যে মৃত্যু আমি এত বেশি করে চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম এতদিন ধরে,
(সংক্ষেপিত)
কবি সিলভিয়া প্লাথের দুটো বিখ্যাত কবিতার ভাবানুবাদ;
“মেড গার্লস লাভ সং”
এখানে যা কিছু রং, ধূসর
বেগুনি বাকি শরীরটুকু নিস্তেজ
মুক্তোর মত।
পাহাড়ের ক্ষুদ্র কোটরে
প্রচন্ড সাগর ঢুকে পড়ে
শুষে নেয় সবটুকু নির্যাস ভরা শূন্যতায়
অদৃষ্টের চিহ্ন দেয়াল বেয়ে নেমে আসে মাছির মতো।
হৃদয় রুদ্র হয়ে আসে
সমুদ্র পাশ ফিরে শোয়
আয়নাগুলো পড়ে থাকে নির্বাকে।
সাগরবেলা ম্যাগনোলিয়া
উপরে এই এখানে সীগাল কাঁদছে আর আমরা হেঁটে চলেছি –
বিবর্ণ লাল ছোপ ছোপ ধ্বংসাবশেষ, সামুদ্রিক প্রাণীদের দাঁড়া, আর খোলসের গোলকধাঁধার ভিতর দিয়ে।
যেন এখনও গরমকাল
ওই ঋতু ঘুরে দাঁড়িয়েছে
যদিও সমুদ্রে সবুজ বাগান
পথ থমকে, মাথা নুইয়ে ফিরে
পেয়েছে নিজেদের মুখচ্ছবি - যে ছবি
আঁকা এক প্রাচীন বই-এর পাতায়, অবিনশ্বর বাগানে।
কিংবা হয়ত দেয়ালে ঝোলানো ট্যাপেস্ট্রির নকশায়,
ফেলে আসা গাছের পাতাগুলো দুমড়ে, মুচড়ে ঝরে পড়েথ
এমনকি শুকায় সময়, ফেলে আসা মাস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন