মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রোগীর ‘জীবন’ নিয়ে বাণিজ্য

অভিজাত ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

রাজধানী তথা দেশের অন্যতম অভিজাত হাসপাতাল গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল। দেখতে যেন ‘ফাইভ স্টার’ হোটেল। সেবার মানেও তেমনই আশা করেন সবাই। চিকিৎসা খরচও আকাশচুম্বি। কিন্তু অভিজাত এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নামে একের পর এক ঘটছে অমানবিক কর্মকাÐ। গুরুতর বা স্পর্শকাতর রোগীদের জীবন-মরণ নিয়ে চলছে রীতিমতো বাণিজ্য। ১৯৮০ দশকে ইউনাইটেড হাসপাতালটি মূলত কন্টিনেন্টাল হাসপাতাল নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালে কন্টিনেন্টাল হসপিটালটি মালিকানা বদলে হয় ইউনাইটেড হাসপাতাল। অবশ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হাসপাতালটির সঙ্গে বিতর্ক লেগেই রয়েছে। টাকার জন্য রোগী আটকে রাখা, লাইফ সাপোর্টের নামে মৃত্যু রোগীকে আইসিউইতে রেখে অতিরিক্ত বিল আদায়, ভুল চিকিৎসাসহ অবহেলায় আগুনে পুড়েও মরতে হয় রোগীদের। এছাড়া রোগীর শারীরিক অবস্থার সুযোগ বুঝে মোটা অংকের টাকা আদায়ের ফন্দি এঁটেও স্বজনদের সঙ্গে চলছে ছিনিমিনি খেলা। এমনই অমানিক ঘটনা ঘটানো হয়েছে দেশের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রæপের চেয়ারম্যান এম এম এনামুল হকের সঙ্গেও। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে তিনিও হাসপাতালের কতিপয় চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তাদের অবেহলা, দুর্ব্যবহার ও ছিনিমিনি খেলার শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় এ ব্যবসায়ীর সুচিকিৎসা ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে আমিন মোহাম্মদ গ্রæপের কর্মকর্তা মো. শরিফ গত বুধবার দিবাগত রাতেই গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করেছেন। জিডি নম্বর ৭৯।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কেবল এ বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীর সঙ্গেই নয়, এর বাইরেও ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ বর্তমানে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। স¤প্রতি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে গালফ এয়ারলাইন্সের একজন বিদেশী পাইলট মোহাম্মদ ইউসুফ হাসান আল হেন্দিকে গুলশানের এ হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানে তার যথাসময়ে এবং ঠিকমতো চিকিৎসায় না করায় করুণভাবে ওই পাইলটের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ আনেন তার বোন তালা ইলহেন্দি জোসেফানো। মৃতের বোন তালা ইলহেন্দি এ ঘটনাকে চিকিৎসা অবহেলায় হত্যা বলেও অভিযোগ করেছেন। এমনকি বিদেশি এ পাইলটের বোন হাসপাতালটির বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে তাকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পুলিশ এ আচরণ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন পাইলট ইউসুফ হাসান আল হিন্দির বোন তালা এলহেন্দি জোসেফানো।

অবশ্য চিকিৎসা অবহেলা ও বাণিজ্যের এখানেই শেষ নয়; সেবা না দিয়েও অতিরিক্ত বিল ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কাছে। ভোক্তা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ইউনাইটেড হাসপাতালে চারদিন ভর্তি থাকা একজন নন-কোভিড রোগীর জন্য পুনঃব্যবহারযোগ্য ৩টি পিপিই, ৪৪টি এপ্রোন, ৪৮টি মাস্ক, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গøাভস ৩৩৮টি, ক্যাপ ৪৩টি, জুতার কভার ৫৪টি, গজ ৫০টি এবং ৫টি হ্যান্ড স্যানিটারজাইরের বিল ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই রোগীর চারদিনের বিল করা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৩৬৩ টাকা। নুরুল হক ভ‚ঁইয়া নামের ওই ভুক্তভোগী রোগীর ছেলে ফারহান নূর ২০২০ সালের ১২ জুলাই ভোক্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, আমার বাবার চিকিৎসার জন্য কতজন ডাক্তার নার্স প্রয়োজন হয়েছে। হাসপাতালটির এ কার্যক্রম দেখে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, তারা চিকিৎসার নামে আর্থিকভাবে প্রতারণা করছে। এর আগে ২০২০ সালের ৩০ মে করোনার আইসোলেশন ইউনিটে পাঁচজন রোগীর অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে ইউনাইটেড হাসপাতালের কর্তা-ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হয় গুলশান থানায়। ওইসময় এ হাসপাতালের চেয়ারম্যান-এমডিসহ কয়েকজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল। এমন আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে।

আবাসন খাতের অন্যতম শীর্ষ এ ব্যবসায়ী এম এম এনামুল হকের স্বজনরা জানিয়েছেন, গুরুতর অসুস্থ হয়ে গত ২৭ জানুয়ারি দেশের এ বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালের ৬০৩ নম্বর ভিভিআইপি কেবিনে চিকিৎসা চলে আসলেও গত বুধবার দিনভর বিনা চিকিৎসায় কেবিনে ফেলে রাখা হয় তাকে। এমনকি তার শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক উচ্চমাত্রার ইনজেকশন দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। এতে শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়। এ বিষয়ে রোগী নিজে এবং তার পরিচর্যায় নিয়োজিত ব্যক্তিগতকর্মী ও স্বজনরা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাদের সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করা হয়। এক পর্যায়ে রোগীর কাছে রাত ৯টার দিকে হাসপাতালের একজন স্টাফ এসে জানান, আজ (বুধবার) আর কোনো ডাক্তার আসবেন না এবং ইনজেকশনও দেয়া সম্ভব না। এতে গুরুতর অসুস্থ এ ব্যবসায়ী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এসময় রোগীর স্বজনরা হাসপাতালে নিয়োজিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বিরক্ত হয়ে দুর্ব্যবহার করতে থাকেন। তার কিছু পরে রোগীর শারীরিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হওয়ায় টাকা আদায়ের ফন্দি নিয়ে হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার রওজার এলিস্টার এজেক এসে রোগীকে বলেন, আমাকে দুই লাখ টাকা দিলে ইনজেকশনসহ ডাক্তারের ব্যবস্থা করে দেবো। এসময় ডিউটি ম্যানেজারের সঙ্গে হাসপাতালের অজ্ঞাতনামা আরো দুই-তিনজন এসে যুক্ত হয়ে একই স্বরে সুযোগ সন্ধানী আচরণ করতে থাকেন। এমন অবস্থায় রোগী ও তার স্বজনরা চিকিৎসাসেবার প্রকৃত খরচের বাইরে ওই অতিরিক্ত টাকা দিত অসম্মতি জানান। তখন হাসপাতালের এ কর্মকর্তা বা কর্মীরা রোগীর শারীরিক অবস্থা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নানা ধরনের ভয়-ভীতি ও হুমকি দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে রোগী ও স্বজনরা তাদের অন্যায় ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সেখানে হাসপাতালের লোকজন জড়ো হয়ে হৈচৈ শুরু করেন। পরবর্তীতে খবর পেয়ে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আসেন সেখানে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হাসপাতালের ওইসব অমানবিককর্মীদের পক্ষ নিয়েই কথা বলতে থাকেন। এর ফলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এম এম এনামুল হক সেখানে ভর্তি থাকলেও তার সুচিকিৎসা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। তবে উপস্থিত হাসপাতালের পরিচালক এসে বলেছেন, এ ঘটনায় যারা অবেহলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ ব্যাপারে কথা বললে হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কর্নেল (অব.) বশির বলেন, বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি থেকে এমন পরিস্থিতি হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। তারপরও এ বিষয়ে খতিয়ে দেখে হাসপাতালের কেউ অপরাধ করে থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে গুলশান থানায় দায়েরকৃত সেই জিডির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হাফিজুর রহমান জায়েদ বলেন, বুধবার রাতেই ওই বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছি। প্রাথমিকভাবে ঘটনা জেনে মনে হয়েছে, হাসপাতালে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা ও ব্যবস্থাপনাগত কিছু ত্রæটি ছিল। একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট মূলত আমিন মোহাম্মদ গ্রæপের চেয়ারম্যানের চিকিৎসায় নির্ধারিত ছিলেন। ওই চিকিৎসক নাকি পারিবারিক কাজে হাসপাতালে আসতে পারেননি। যদিও অন্য চিকিৎসককে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে এ ধরনের একজন রোগীর আস্থা সঙ্কট হওয়ায় স্বাভাবিক। এ ধরনের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ব্যক্তিগত নিরাপত্তা তিনি দেখবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তার চিকিৎসার কিছু বিষয় অবশ্যই অনুসরণ করা উচিৎ ছিল।

এসআই হাফিজুর বলেন, জিডি হওয়ার পর এটি আদালতে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর প্রক্রিয়া করা হচ্ছে। আদালতের অনুমোদন হলেই ইউনাইটেড হাসপাতালের অভিযুক্তদের বিষয়ে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন