তুরস্ক এমন একটি দেশ যাদের অর্থ-সম্পদ, প্রযুক্তি, অস্ত্র কোনো কিছুরই অভাব নেইÑ তদুপরি ভূমিকম্পের কবলে তারা আজ নাস্তানাবুদ। বহির্বিশে^র যেকোনো পরাশক্তি মোকাবিলায় তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও আল্লাহর দেয়া ভূমিকম্পের কাছে অসহায়ত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। বিষয়টি কেবল সংবাদের মধ্যে কিংবা সাময়িক শোক প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না বরং এ থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের পাথেয় অনুসন্ধান করতে হবে। গুনাহ পাপাচার থেকে বিরত থেকে আল্লাহপাকের নৈকট্য হাসিলে মনযোগী হতে হবে। গতকাল জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ানে খতিব এসব কথা বলেন।
রাজধানীর মহাখালীস্থ মসজিদে গাউছুল আজমের জুমা পূর্ব বয়ানে খতিব প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে কারো অন্তরে সন্দেহের অবকাশ থাকলে নিঃসন্দেহে ওই ব্যক্তি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, আজাব, গজবের মাধ্যমে তার বান্দাদের অন্তরে ভয়ের সৃষ্টি করেন। যাতে বান্দাগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পথে ফিরে আসে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভ‚মিকম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে খতিব মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভ‚মিকম্প থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের পাথেয় অনুসন্ধানে গুরুত্বারোপ করে বলেন, ভবিষ্যতের পাথেয় বলতে আল্লাহর রাজি-খুশি, ইবাদাত-বন্দেগী, সৎপথে জীবন পরিচালানার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। সর্বপরি আল্লাহ কর্তৃক প্রণীত জীবন বিধান অনুযায়ী ব্যক্তি, পারিবার ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। মৃত্তিকা বিষেশজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পূর্ব দক্ষিণাঞ্চল ভ‚মিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এসকল এলাকায় ভ‚মিকম্প কিংবা ভ‚মিধসের মতো ঘটনা ঘটলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে তাদের ধারণা। আমাদের নাফরমানী ও পাপাচারের কারণে যেন আমার এমন বিপর্যয়ে আপতিত না হই, সেদিকে লক্ষ্য রেখে নিজেদের পরিবার ও সমাজকে পাপমুক্ত রাখার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। খতিব বলেন, তুরস্ক ও সিরিয়া মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় তাঁদের এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে হতাহত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো ঈমানী দায়িত্ব। কেননা, রাসূল (সা.) বলেছেন এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই এবং মুসলমানগণ পরস্পর একটি দেহের ন্যায়, দেহের যেকোনো স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হলে যেমনিভাবে পুরো শরীর তা অনুভব করে ঠিক তেমনিভাবে এক মুসলমান কষ্টে থাকলে অপর মুসলমানও ব্যথিত হবে। তিনি সকলকে নিয়ে ভ‚মিকম্পে নিহতদের রুহের মাগফিরাতে দুয়া কামনা করেন এবং সম্ভব হলে আর্থিক সহায়তা প্রেরণের জন্য উপস্থিত মুসল্লিসহ দেশবাসীর প্রতি আহŸান জানান।
আল্লাহর গজব ও আজাবের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে পবিত্র কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে খতিব বলেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৫৯)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, “বলে দাও, ‘আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম ’ (সূরা আনআম : ৬৫)। তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী যদি এমন কোনো বিপদের সম্মুখীন হয় যা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনই পথ অবশিষ্ট নেই তাহলে বুঝতে হবে এ বিপদ কিংবা আজাব তার কৃতকর্মের কারণে আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত কেননা আল্লাহ বলেন, ‘যে বিপদ-আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন’ (সূরা শুরা : ৩০)। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে; কিন্তু তার খেয়ানত করা হবে, জাকাতকে দেখা হবে জরিমানা হিসেবে, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে, পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে; কিন্তু মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নিয়ে পিতাকে দূরে সরিয়ে দেবে, মসজিদে উচ্চস্বরে শোরগোল হবে, জাতির সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসকরূপে আবির্ভূত হবে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হবে নেতা, একজন মানুষ যে খারাপ কাজ করে খ্যাতি অর্জন করবে, তাকে তার খারাপ কাজের ভয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হবে, বাদ্যযন্ত্র এবং নারী শিল্পীর ব্যাপক প্রচলন হবে, মদপান করা হবে, লোকজন তাদের পূর্ববর্তী মানুষগুলোকে অভিশাপ দেবে, এমন সময় তীব্র বাতাস প্রবাহিত হবে এবং এমন একটি ভ‚মিকম্প হবে যা সেই ভ‚মিকে তলিয়ে দেবে (তিরমিজি: ১৪৪৭)। এ হাদিস দ্বারা আমরা বুঝতে পারি আল্লাহর নাফরমানী, ক্রমবর্ধমান গুনাহ অব্যাহ রাখলে ক্রমেই মানুষ আল্লাহর গজব ও আজাবের সম্মুখীন হতে থাকে। তাই আল্লাহ প্রদত্ত গজব আজাব যা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই সেসকল বালা-মুছিবত থেকে পরিত্রাণ পেতে আল্লাহ অনুগ্রহের বিকল্প নেই। আর আল্লাহর অনুগ্রহ পেতে অবশ্যই আমাদের তাঁর নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালনা করতে হবে।
মিরপুরের বাইতুল আমান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল্লাহ ফিরোজী গতকাল জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ানে বলেন, ভালোবাসা শব্দটি পবিত্র। পরস্পরের মধ্যে প্রীতি স্থাপনের জন্য আল্লাহতায়ালা প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছেন। ভালোবাসার কারণেই মমতাময়ী মা গর্ভে সন্তান ধারণ করেন। পিতা কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ভালোবাসার কারণেই জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীরা স্বজাতিদের নিয়ে একত্রে বসবাস করে। ভালোবাসা মহান আল্লাহর অনুপম দান। তবে ভালোবাসা হতে হবে পবিত্র। ভালোবাসার নামে তরুণ-তরুণীর বিবাহবহির্ভ‚ত অবাধ মেলামেশা, যৌনাচার সম্পূর্ণভাবে হারাম ও কবিরা গুনাহ। শরীয়তের দৃষ্টিতে ভালোবাসা কেবল বিয়ের পরেই।
বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, সেটা আল্লাহর রহমত এবং তাতে অনেক সওয়াব ও কল্যাণ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, তার এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ কর এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও রহমত (দয়া) সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর ভেতর নিদর্শন আছে সেই সব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা রূম-২১)। সুতরাং আসছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের নামে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতাকে আমরা পরিহার করতে হবে। এই দিবস মূলত বিয়ে বহির্ভ‚ত অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশের একটি নোংরা সংস্কৃতি। এটা পালন করা কোনো মুসলমানের জন্য বৈধ নয়। ভালোবাসা দিবস উদযাপনের নামে অবাধ যৌনাচারে মেতে ওঠে একশ্রেণির মানুষ। অথচ আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তোমরা ব্যভিচারের নিকটেও যেয়ো না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা। (সূরা বনি ইসরাঈল-৩২)। অর্থাৎ তোমরা ব্যভিচার তো করবেই না। এমনকি ব্যভিচারের দিকে আকর্ষণ করে, ব্যভিচারে উদ্বুদ্ধ করে, যেনার পথে প্ররোচিত করে এমন কোনো কাজও করবে না।
খতিব আরও বলেন, মানুষের অপরাধ ও গোনাহের কারণে জলে স্থলে নানা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। একের পর এক ভ‚মিকম্প, ভ‚মিধস, মহামারী, বন্যা ইত্যাদি দেখা যায়। এসব প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। (সূরা রূম-৪১)। আল্লামা ইবনু কাইউম (রহ.) বলেন, মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে ওঠার অনুমতি দেন। ফলে বড় ধরনের ভ‚মিকম্প অনুভ‚ত হয়। তখন এই ভ‚মিকম্প মানুষকে ভীত করে। তারা মহান আল্লাহর নিকট তওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয়। সম্প্রতি তুরস্কে ভয়াবহ ভ‚মিকম্পের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সতর্ক করেছেন। এখনও সময় আছে, আমরা অপরাধ থেকে ফিরে আসি। ভালোবাসা দিবসের নামে ইসলামবহির্ভ‚ত সবধরনের সম্পর্ক, অশ্লীলতা, যৌনাচারকে পরিহার করি। তওবা করে গোনাহমুক্ত জীবনযাপন করি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, গোনাহ থেকে তওবাকারী নবজাতক বাচ্চার ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে যায়। (তিরমিযী)। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের আমল করার তৌফিক দান করেনÑ আমীন।
কামরাঙ্গীরচরস্থ রহমতিয়া জামে মসজিদের খতিব মুফতি সুলতান মহিউদ্দিন জুমার বয়ানে বলেছেন, ভালোবাসা দিবস পশ্চিমা দেশ থেকে আমদানি করা ইহুদি-নাসারাদের অপসংস্কৃতি। কথিত ভালোবাসার দ্বারা মুসলিম যুবক-যুবতীদের চরিত্র হননের অপচেষ্টা চলছে। ভালোবাসা দিবস নামে নগ্নতা-বেহায়পনা, অশ্লীলতা আর পাপাচার ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। সুতরাং কোন মুসলমান এ ধরনের নাজায়েয, নির্লজ্জ ও অশ্লীল দিবস উদযাপন করতে পারে না। প্রত্যেক অভিভাবকদের সচেতন থাকা উচিত, যেন সন্তানরা এসব নির্লজ্জ ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত হতে না পারে। আমাদের দেশের সরকারেরও উচিতÑ যুবসমাজের চরিত্র রক্ষায় অসামাজিক, অশ্ললীতা বন্ধে ভালোবাসা দিবস সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা। নামাজ শেষে তিনি ভ‚মিকম্পে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত সিরিয়া ও তুরস্কের মুসলমানদের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন