দেশের ২২তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল গতকাল সোমবার দুপুরে এ পদে তাঁকে ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করেন। এর আগে রোববার সকালে এ পদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রেসিডেন্টপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন মো. সাহাবুদ্দিন। তার মনোনয়ন বৈধ বিবেচিত হয়। আর কোনো প্রার্থী মনোনয়ন জমা না দেয়ায় নির্বাচন কমিশন অবসরপ্রাপ্ত এই জেলা জজকে পরবর্তী প্রেডিডেন্ট হিসেবে ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করেন।
পেশাগত ও রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারমন্ডিত মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন- এ ছিল অনেকের ধারণার বাইরে। ২১তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে মো. আবদুল হামিদের মেয়াদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হতে পারেন- এ নিয়ে চলে নানা জল্পনা-কল্পনা। প্রায় ২ মাস ধরে সংবাদমাধ্যমে ভেসে বেড়ায় বেশ কিছু নাম। কিন্তু সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে মনোনয়পত্র দাখিলের শেষ দিন ১২ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন দলের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। মনোনয়নপত্র দাখিলের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাউর হয়ে যায় মো. সাহাবু্িদ্দন চুপ্পুর নাম। আকস্মিক এই নামে আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা, প্রেসিডিয়াম মেম্বার, কর্মকর্তা, সরকারের অবসরপ্রাপ্ত ও পদস্থ কর্মকর্তা, সাধারণ মানুষ, তথা দেশবাসী শুধু বিস্মিতই হয়েছেন। কারণ, প্রেসিডেন্ট পদের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় এই নামটি ছিল একেবারেই অনুচ্চারিত। সাধারণের ভাবনারও অতীত অথচ স্বনামধন্য সুযোগ্য এই ব্যক্তিত্বকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেন রীতিমতো চমক দেখালেন। ভুল প্রমাণিত হলো সবার জল্পনা-কল্পনা। গত দু’দিন ধরেই বিষয়টি ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বিচার ও আইনাঙ্গনে বইছে উচ্ছ¡াস। রাজনৈতিক অঙ্গনেও যেন এসেছে স্বস্তি। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি যেসব দফতরে দায়িত্ব পালন করেছেন সেসব ক্ষেত্রে বইছে আনন্দের বন্যা। তবে বহুল আলোচিত হলেও রাষ্ট্রপ্রধানের এই পদটিতে আমলা-বহিভর্‚ত ব্যক্তিকে বেছে নেয়ায় প্রশাসনের একটি অংশে লক্ষ করা গেছে হতাশা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লক্ষণীয় হয়ে ওঠে প্রশাসন ক্যাডারদের বিরস বদন। সর্বসাধারণের মধ্যে নিজ জেলা পাবনায় দেখা দেয় মিষ্টির সঙ্কট। বঙ্গভবন তাদের হতে যাচ্ছে- এমনই আনন্দে উদ্বেলিত পাবনার মানুষ। কারণ, পাবনার প্রতিটি অঞ্চলে রয়েছে তার পদচিহ্ন। আশৈশব রাজনীতি করেছেন। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠকর্মী। শিক্ষাজীবনে করেছেন সাংবাদিকতা। দৈনিক বাংলার বাণীতে জেলা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন পাবনা জেলা প্রেসক্লাব। রাজনীতির পাশাপাশি সম্পৃক্ত ছিলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। ছিলেন অনেক সংবাদমাধ্যমের উপদেষ্টা। নিবেদিত ছিলেন সমাজসেবামূলক নানা কর্মে। এসব কারণে সবার কাছেই তিনি ‘নিজেদের লোক’।
সর্বমহলের অলোচনায় ঘুরেফিরে এ প্রশ্নই উঁকি দিয়েছে যে, কোন্ বিবেচনায় বেছে নেয়া হলো রাজনৈতিক অথচ বিচার বিভাগীয় এই ব্যক্তিত্বকে? এ প্রশ্নে অনেকে যার যার মতো খুঁজছেন উত্তর। তবে প্রায় সব আলোচনার উপসংহার মিলিত হয়েছে এক মোহনায়। তা হলো- চলমান রাজনৈতিক উত্তাপ, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সমূহ রাজনৈতিক সঙ্কট, টানাপড়েন, সাংবিধানিক জটিলতা, বিরোধী পক্ষের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন, আশঙ্কিত সংঘাত, উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতিতে করণীয়। এসব বিষয়কে মাথায় নিলে এমন একজন ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রয়োজন তার সবকিছুই সামাল দেয়ার পরিপক্বতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা রয়েছে। এ বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোনয়ন শতভাগ যথার্থ। বিষয়টি অনেকের কাছে এমনও মনে হচ্ছে যে, এ ধরনের পরিস্থিতির প্রয়োজনেই যেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে প্রধানমন্ত্রী তৈরি করে রেখেছিলেন। সযতনে তাকে করে রেখে দেয়া হয়েছিল বলেই আওয়ামী লীগ সভাপতি তার নামটি নিয়ে আলোচনার সুযোগ দেননি। উঠতে দেননি কোনো বিতর্কও। যে কারণে মনোনয়নপত্র জমাদানের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল তার সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অথচ মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু একাধারে দলের দুর্দিনের সাথী, বৈরী সময়ের সাহসী কণ্ঠ, স্পষ্ট, প্রতিবাদী, কারা নির্যাতিত এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্মুখযোদ্ধা। কর্মজীবনের প্রতিটি পরতে তিনি রেখেছেন দলীয় আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর। এ বিবেচনায় তিনি আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা। সময়ের হুজুগে ভেসে আসা ‘হাইব্রিড’ তিনি নন। এছাড়া পেশাগত কারণে তিনি বিচার, সংসদ এবং আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ। সরকার ও সময়ের চাহিদা এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তিনি দিতে পারেন বিচক্ষণতার পরিচয়। এমন পরিস্থিতিতে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ, দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিনকে বেছে নেয়া আওয়ামী লীগের জন্য এক অনন্য সিদ্ধান্ত। তবে সরকারি দলের বাইরেও যে মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খুব একটা বিতর্ক রয়েছে- এমনও নয়। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রেসিডেন্ট পদের এই মনোনয়ন নিয়ে বাহ্যত প্রতিক্রিয়াহীন।
তবে এ বিষয়ে ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ একটি দিয়েছেন বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষযক সম্পাদক ও সাবেক এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তার মতে, মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় চমক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের জন্য এর চেয়ে ভালো, এর চেয়ে বেটার অপশন আর ছিল না বলে আমি মনে করি। তিনি একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের অত্যন্ত অনুগত। আনুগত্যের পরিচয় দিচ্ছেন অতীত থেকেই। শিক্ষাজীবনে তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। পরে জেলা যুবলীগের সভাপতি হন। এবং ধাপে ধাপে তিনি আওয়ামী লীগের বর্তমান উপ-কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হিসেবেও আছেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। তার নাম খুব ‘ফেস’এ এসেছে, এমনটি নয়। তিনি যে একান্ত অনুগত এটাই শুধু নয়। তিনি কিন্তু আওয়ামী লীগের হয়ে সাহসিকতার পরিচয়ও দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে যখন নৃশংস হত্যাকান্ড হয়, সে সময় আওয়ামী লীগের যারা মোস্তাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিতে দুই মিনিট চিন্তা করেননি, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। তিনি কেবিনেট মেম্বার ছিলেন না। তবে তিনি সে সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে শক্তভাবে যুক্ত ছিলেন। এবং তিনি প্রতিবাদ করে কারাগারে যান। প্রায় তিন বছর তার কারাগারে কাটে। এর মধ্য দিয়েই কিন্তু একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, ¯্রােতে গা ভাসানো যে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা আছেন তিনি সেই সুবিধাভোগী নন। তিনি সাহসী ব্যক্তি এবং আওয়ামী লীগের জন্য জান বাজি রেখে প্রতিবাদও করতে জানেন। তৃতীয় যে যোগ্যতা এ সময়ে একজন রাষ্ট্রপতির থাকা দরকার ছিল সেটি হচ্ছে আইন বিষয়ে সম্যক ধারণা। সেটি কিন্তু তার আছে। তিনি জেলা ও দায়রা জজ ছিলেন। দেশ যদি একটি টার্মঅয়েলের মধ্যে পড়ে, পড়তেই পারে। নির্বাচন তো দরজায় কড়া নাড়ছে। এরকম একটা সময়ে আইন, সংবিধান, নির্বাচন সংক্রান্ত যে আইনগুলো আছে, যে বিধিগুলো আছে এগুলোর বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা যে ব্যক্তির আছে তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হন তাহলে এক ধরনের কমফোর্ট আওয়ামী লীগের জন্য। সে দিক থেকে বিবেচনা করলেও তিনি আন-প্যারালাল। দেশের জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি না। একেবারে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি চিন্তা করেন তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য একটি স্বস্তির বিষয়। এর চেয়ে ভালো পছন্দ আর নেই। তিনি কোনো খবরের আলোচনায় ছিলেন না। তার বেলায় কোনো রকম বিতর্কিত খবরও আসেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন