শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

গুলশানের অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ আরো একজনের মৃত্যু

অগ্নিকাণ্ডে নিহত ২ : ভোরেও ছিল ধোঁয়া চলে তল্লাশি ভবনে ফায়ার সেফটি-লাইসেন্স ছিল না : লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

রাজধানীর গুলশানে আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতের নাম রাজু। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে। রাজু শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল ভোর ৪টার দিকে মারা যান। তিনি ভবনটিতে বাবুর্চির কাজ করতেন। ভবনের ৪ তলার লিফটের পাশে বৈদ্যুতিক তার থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। চার তলায় হার্ডবোর্ড দিয়ে আবদ্ধ ছিল লিফট চলাচলের জন্য বৈদ্যুতিক তার। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি এ তথ্য জানান। আহতদের চিকিৎসায় ২৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। গত রোববার রাতে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ভবনটি থেকে গতকাল সোমবার ভোরেও ধোঁয়া বের হয়। এ সময় ভবনটিতে তল্লাশি চালায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। নিহত আনোয়ার ওই ভবনের ১২ তলায় বসবাসরত বিসিবির অন্যতম পরিচালক ফাহিম রহমানের কেয়ারটেকার ছিলেন, নিহত রাজু ছিলেন তার পরিবারের বাবুর্চি।

গতকাল সোমবার সকালে গুলশান-২ এর ১০৪ নং সড়কের ২/এ ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখনও উৎসুক জনতার ভিড়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ সদস্য। আগুন নেভার পরই ভবনটিতে তল্লাশি অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সকালেও সেখানে চলছে তল্লাশি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, ভেতরে কোনো লাশ রয়েছে কি না, কোথাও আগুনের কুণ্ডলী কিংবা এখনও ধোঁয়া উড়ছে কি না তা দেখা হচ্ছে। তবে ভবনের ভেতরে নতুন করে আর কাউকে পাওয়া যায়নি।

ভবন থেকে বের হওয়া একজন ফায়ার ফাইটার বলেন, আগুন নিভলেও ভবনটির সপ্তম তলায় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। সেখানে নতুন করে পানি দেয়া হয়েছে। আগুনের সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা জোন-৩ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম জানান, ভবনটির সিঁড়ির পাশেই ঘটনা ঘটেছিল। বের হওয়াতে ঝুঁকি থাকার কারণে অনেকেই আটকা পড়েন। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে আগুন নির্বাপণসহ অনেক লোক উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গুলশানে আগুন লাগা ভবনে কোনো ফায়ার সেফটি ও ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ছিল না। কর্তৃপক্ষ শুধু প্রথমে একটি এনওসি নিয়েছিল।

অগিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান তাজুল ইসলাম বলেন, আগুন বিভিন্নভাবেই লাগতে পারে। এখানে গ্যাসের লাইন, বিদ্যুতের লাইন, আবার একই সঙ্গে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থও আছে। সুতরাং কোনটা থেকে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে বলা যাচ্ছে না।
শর্টসার্কিট থেকে গুলশানে আবাসিক ভবনে আগুন : গুলশান বিভাগের ডিসি আ. আহাদ বলেন, ইতোমধ্যে ভবনটি পুলিশের নিরাপত্তায় মালিকদের জিম্মায় বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বৈদ্যুতিক শটসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। ভবনের নকশা, আগুনের কারণসহ অন্যান্য কোনো ত্রুটি ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখবে ফায়ার সার্ভিস ও রাজউক। তবে আমরা প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জানতে পেরেছি আগুনের সূত্রপাত ঘটেছিল বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কারণে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দু’জন মারা গেছেন।

ভবনটির বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ভেতরে প্রবেশ করছি না। তবে ফ্ল্যাটের মালিক যারা রয়েছে তারা ভবনের নিরাপত্তা কর্মীদের ডেকে নিয়ে প্রবেশ করছেন। ভেতরে কি অবস্থা তা ফ্ল্যাট মালিকরাই বলতে পারবেন। ভবনটি এখন মালিকদের জিম্মায় রয়েছে। আমরা নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছি।

আগুনের সূত্রপাত নিয়ে যা জানালো ফায়ার সার্ভিস : সোমবার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ওই ভবনের চার তলায় লিফটের পাশে হার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি একটি ইলেকট্রিক বোর্ড ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত। আগুনে ৫ ও ৫ তলায় তেমন ক্ষতি না করে উঠে যায় সাততলায়। তারপরে উপরের দিকে ১০, ১১, ১২ তলায়।
তিনি আরও বলেন, চারতলা লিফটের পাশে বৈদ্যুতিক তারে গোলযোগের কারণেই আগুন লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা আমাদের। তবুও ৫ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আগুনের সূত্রপাত অনুসন্ধান করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। সঠিক কারণ বেরিয়ে আসবে।

আহতদের চিকিৎসায় ২৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন : অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় ২৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সমান্ত লাল সেন।

তিনি বলেন, গুলশানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমাদের এখানে তিনজন এসেছে। এদের মধ্যে সায়মা রহমান সিনহার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। অন্য দুইজনকে জরুরি বিভাগের অবজারভেশনে রাখা হয়েছে।এদের মধ্যে একজনকে আজ ছেড়ে দেয়া হবে। সামন্ত লাল আরো বলেন, আমরা সায়মা রহমানের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। ৪৮ ঘণ্টা আমরা তাকে অবজারভেশনে রাখব। এরপর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

ভবন নির্মাণকালীন প্রকৌশলী মাহফুজুল হাসান সাংবাদিকদের জানান, ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা ছিল। একটি ফ্ল্যাট থেকে প্রথমে ধোঁয়া শুরু হয়, পরে আগুন ছড়িয়েছে। ধোঁয়ার জন্যই বেশি সমস্যা হয়।
ভবনে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে এলার্ম হয়েছে বলে জানান তিনি। প্রকৌশলী মাহফুজুল হাসান বলেন, যারা নিচের দিকে ছিলেন তারা নেমেছেন। আগুন লাগার পর প্রত্যেকেই যদি সিঁড়ি দিয়ে বের হয়ে যেতেন, তাহলে সবাই নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারতেন। অনেক সময় ভুল এলার্ম হয়। যারা বাসায় ছিলেন তারা মনে করেছিলেন ভুল এলার্ম হয়েছে। যখন তারা দেখেছেন আগুন, এবং নিচ থেকে বলছিলেন ‘আগুন লেগেছে সবাই নেমে যান’ তখন যে যতটুকু পেরেছে নেমে এসেছেন। তিনি বলেন, ভবনে অগ্নি নির্বাপণ প্রশিক্ষণের একটি টিমও ছিল, তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিয়েছেন। প্রত্যেক বাসায় সচেতন করেছেন।

অগ্নিকাণ্ডে ভবনটিতে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহফুজুল হাসান বলেন, ‘নিউ এইজ’ গার্মেন্টসের এমডি আরিফ ইব্রাহিমের ১০ ও ১১ তলা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমি সব ফ্লোরে গিয়েছি, তবে অন্যান্য ফ্লোরে মূল দরজা বন্ধ আছে।

রাজউকের অনুমতি নিয়ে ভবনটি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভবনটিতে সব সিস্টেমই করা আছে। রাজউক থেকে যেই সার্টিফিকেট দেয় ওটাও নেওয়া আছে। এছাড়া ওই ভবনের চারতলার এ-৪ ফ্ল্যাটের মালিক ওয়াশিম রেহমান বলেন, ভবনের প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটের গ্লাস ভেঙে গেছে। এছাড়া ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার হাইড্রেন্ট ও ফায়ার এক্সিটও ছিল। সব কিছুই সচল ছিল। প্রত্যেক দুই সপ্তাহ পর পর এখানে ফায়ার সেশন হতো। আগুনটা অনেক বড় হওয়ায় সেগুলো খুব বেশি কাজে লাগেনি।

কারণ অনুসন্ধানে ঘটনাস্থলে তদন্ত কমিটি : আগুনের কারণ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিসের গঠিত তদন্ত কমিটি। গতকাল সোমবার ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের মিডিয়া কর্মকর্তা শাজাহান সিকদার জানান, ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর থেকে গুলশানের ভবনে লাগা আগুনের কারণ অনুসন্ধানে গুলশানের ঘটনাস্থলে কাজ করেছে তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রধান পরিচালক (অপারেশনস ও মেইনটেইনেন্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য তদন্ত কমিটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। গত রোববার সন্ধ্যা ৬টা ৫৯ মিনিটের দিকে গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর রোডে ১২ তলা আবাসিক ভবনে আগুন লাগে। এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে রাত ১১টার দিকে। এ ঘটনায় এরইমধ্যে দুজন মারা গেছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন