আনুষ্ঠানিকভাবে তার দ্বিতীয়াভিষেকটা হবে আজ। তবে গত সোমবার রাত থেকেই বাংলাদেশে তার ফেরার প্রক্রিয়া শুরু। সে রাতে ঢাকায় নেমে পরদিনই ছুটির আমেজেও সাত সকালে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে এসে দেখা করে গেছেন ক্রিকেটারদের সঙ্গে। চিরচেনা ‘কড়া হেডমাস্টার’ মার্কা চরিত্র থেকে বেরিয়ে খোশগল্পে সময় পার করতে দেখা গেছে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। দুই বছরের চুক্তিতে বাংলাদেশের পুরনো হেড কোচের দায়িত্বটা বুঝে নেবার আগে চেনা আঙিনা ঘুরে রেকি করে নিতে চেয়েছেন আবহ। গতকাল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনেও তাকে পাওয়া গেল কিছুটা নরম সুরে। চেহারায় গাম্ভীর্য টেনে কঠিন সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে চেনা সাংবাদিকদের খোঁজ খবর নিয়েছেন নিজ থেকেই!
তবে সাংবাদিকদের মনে যে ‘কঠিন’ প্রশ্নগুলো ছিল তার উত্তর দিতে গিয়ে সেই পুরনো রূপেই ধরা দিলেন এই লঙ্কান। এদিন শুরুটাই যে হয়েছে অপ্রস্তুত করার মতো এক প্রশ্ন দিয়ে। যেই হাথুরুর বিদায় নেয়ার প্রক্রিয়াটা নিয়ে হয়েছে কড়া সমালোচনা, তাকে বার বার ফেরাতে চেয়েছে বিসিবি! হ্যাঁ, তার মুখ থেকেই মিলেছে এমন সত্য। এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, ‘বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর এবারই কি প্রথম হাথুরুসিংহেকে ফেরার প্রস্তাব দিয়েছিল বিসিবি? উত্তর এলো, ‘না’। পরে সম্পুরক প্রশ্নটি ছিল, ‘এটা কি দ্বিতীয়বার ছিল?’ তাও উত্তরে এলো, ‘না’। হাথুরুসিংহের এই দুই ‘না’ বলায় পরিষ্কার হয়ে যায় অন্তত দুইবারের বেশি ফেরার প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি, নিজেও ফিরতেও চেয়েছিলেন। তবে সেটা এত দ্রুত হয়ে যাবে ভাবেননি।
জানালেন ২০১৭ সালে বিসিবির চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই এখানকার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তার, ‘ফিরে যাওয়ার পর থেকেই আমি বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুসরণ করছিলাম। সময় সময়ে অনেক খেলোয়াড়, কর্মকর্তা আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়, পরিস্থিতি নিয়ে যোগাযোগ রাখছিলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আমার বরাবরই সফট কর্নার ছিল। কারণ এটা আমার প্রথম আন্তর্জাতিক অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। ভেতরে ভেতরে আমি ফিরতে চেয়েছি। আমি ভাবিনি এটা এত দ্রুত হয়ে যাবে।’
অস্ট্রেলিয়ায় গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়ই হাথুরুসিংহের ফেরার বিষয় চূড়ান্ত হয়ে যায়। বিশ্বকাপ সামনে থাকায় তিনিও আর মৌসুম শেষ করার অপেক্ষা করেননি, ‘গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় আমি বিসিবি সভাপতি ও কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করি। কিছু বিষয় আলাপ করি। আমার মনে হয় ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের আগে এটা ফেরার আদর্শ সময়। এর থেকে পরে নিউ সাউথ ওয়েলসের মৌসুম শেষে এলে দেরি হয়ে যেত। বিগ ব্যাশের পর আমি সিদ্ধান্ত নেই চলে আসার।’ তবে অক্টোবর-নভেম্বরেই প্রথম নয়। এর আগেও একাধিকবার তাকে ফেরাতে চেয়েছিল বিসিবি। বারবার তার কাছে গেছে বিসিবির প্রস্তাব। এতে বোঝা যায় এই কোচের প্রতি বিসিবির তীব্রতা।
২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান কোচ হিসেবে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু সাফল্য আনেন তিনি। বিশেষ করে দলের খেলার ধরণ, শরীরী ভাষায় তিনি নিয়ে আসেন বদল। তার সময়েই ওয়ানডে ক্রিকেটে বড় দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ জেতা শুরু করে বাংলাদেশ। তবে শেষ দিকটা কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি আসে আলোচনায়। চুক্তির মাঝপথে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান অনেকটা রূঢ়ভাবে। হাথুরুসিংহের কোচিং স্কিল নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি, কিন্তু খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা ছিল চড়া। ২০১৭ সালে মাশরাফি মুর্তজাকে টি-টোয়েন্টি ছাড়তে চাপ দিয়েছিলেন তিনি, সেই চাপেই অবসর নেন মাশরাফি। টেস্ট থেকে বাদ দিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহকে। মুমিনুল হককেও বাদ দিয়ে পড়েছিলেন বিতর্কে।
তবে এদিন এক সাংবাদিকের এ নিয়ে অপ্রীতিকর প্রশ্ন শুনে কিছুটা রাগত স্বরে জবাব দেন হাথুরুসিংহে, ‘আপনার প্রথম প্রশ্নটি রাবিশ, কোন ক্রিকেটারের সঙ্গে আমার টানাপোড়েন নেই।’ এবার বাংলাদেশে আসার আগে ও পরে চার সিনিয়র সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে নাকি কথাও বলেছেন তিনি, ‘মোটেও না (সিনিয়রদের সামলানো চ্যালেঞ্জ)। সিনিয়রদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সবার মনযোগের কেন্দ্রে দল। দলের ভালোর জন্য সবাই চেষ্টা করবে। এমনকি আগেরবারও কোন ক্রিকেটারকে নিয়ে আমার সমস্যায় পড়তে হয়নি। দলের ভালোর দিকে সবার মনোযোগ নিতে চাই। এটাই হলো চ্যালেঞ্জ, আর কিছু না।’ নতুন দফায় দায়িত্ব নিয়ে সিনিয়র খেলোয়াড়দের ভূমিকাতেও কোন বদল আনার ইচ্ছে নেই তার, ‘গত ১২-১৫ বছর ধরে তারা যেমন ভূমিকা পালন করেছে, সেটাই করবে। তারা যতদিন খেলবে এবং নির্বাচিত হবে একই ভূমিকাই পালন করবে। তাদের ভূমিকা খুব একটা বদলাবে না। তারা বিশ্বমানের ও নিজেদের জায়গায় সফল।’
ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজে অতি স্পিনবান্ধব উইকেট বানানোর কৌশল চালু করেছিলেন হাথুরুসিংহে। তাতে মিলেছিল দারুণ কিছু সাফল্য। শ্রীলঙ্কান কোচের দায়িত্বের প্রথম মেয়াদে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দেশের বাইরে সেই ছক কার্যকর নয়। দ্বিতীয় দফায় দায়িত্বে এসেও স্পিন নির্ভরতা পাল্টে ফেলার কোনো ইচ্ছাই নেই হাথুরুসিংহের। তার সাফ কথা, ঘরের মাঠের সুবিধা নিতে হবে। এর ব্যপারে প্রশ্ন করা হলে প্রশ্নকর্তাকে একের পর এক পাল্টা প্রশ্ন করেন হাথুরুসিংহে, ‘ঘরের মাঠের সুবিধা কী? আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, ঘরের মাঠের সুবিধা কী? নিউজিল্যান্ডে গেলে আমরা কী ধরনের উইকেট পাই? অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে আমরা যখন যাই, তখন ওরা কী করে? ভারত ঘরের মাঠে কী করছে?’
পরে রূপক ব্যবহার করে তিনি নিজেদের শক্তি অনুসারে পরিকল্পনা সাজানোর পক্ষে যুক্তি দেন, ‘বিদেশে গেলে আমাদের যা আছে তা দিয়ে আমরা খেলার চেষ্টা করি। আপনার যদি ক্ষেপণাস্ত্র না থাকে, তবে আপনি কীভাবে যুদ্ধ করবেন? আপনাকে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল বেছে নিতে হবে, তাই না? আপনি তাদেরকে ঘরের মাঠে আসতে দেবেন (এবং আপনার যা কিছু আছে তা দিয়েই সেরাটা করবেন)। যদি আপনার কাছে গোলাবারুদ না থাকে, তবে আপনি এটা করতে পারবেন না।’ ঘরের মাঠের সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করতে বদ্ধ পরিকর ৫৪ বছর বয়সী এই কোচ, ‘আমরা যেমনটা আলোচনা করেছি, (ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোর) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কিছু খেলোয়াড় উঠে আসছে। খেলোয়াড়দের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে সময় লাগে। আমি আপনার সঙ্গে একমত নই (ঘরের মাঠে সুবিধা নেওয়ার প্রশ্নে) কারণ, প্রতিটি দেশই একই জিনিস করে। আপনাকে ঘরের মাঠের সুবিধা নিতে হবে। আমরা যখন দেশে থাকি, তখন নিজেদের শক্তিমত্তা অনুসারে খেলি।’
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবশ্য ঘরের মাঠে স্পিনবান্ধব উইকেট বানিয়েও টেস্টে সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০২১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয় তারা। গত বছর দুই ম্যাচের সিরিজে শ্রীলঙ্কার কাছে তারা পরাস্ত হয় ১-০ ব্যবধানে। এবার দেখা যাক, সেই ব্যর্থতার পেছনে ব্যর্থতাটা কার ঘরের মাঠের, ক্রিকেটারদের, নাকি কোচের!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন