ক্যরিয়ারের অধরা বিশ্বকাপ অবশেষে হাতে তুলতে পেরেছেন গেল বছরে। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাবও পেয়েছেন। তাই ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড় হিসাবে অন্য কাউকে বেছে নেওয়া কার্যত অসম্ভব ছিল। প্যারিসে পুরস্কারের মঞ্চ প্রস্তুতই ছিল। বাকি ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। লিওনেল মেসির হাতে ফিফা বর্ষসেরা পুরুষ খেলোয়াড়ের পুরস্কার দ্য বেস্ট তুলে দেওয়ার মাধ্যমে সেই আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন হলো গতপরশু রাতে। ফিফার ২০২২ সালের বর্ষসেরা পুরুষ খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতলেন আর্জেন্টাইন তারকা মেসি। এটি তার ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় ‘বেস্ট’ ট্রফি।
আর্জেন্টাইন জাদুকর এবার যে ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড় হচ্ছেন, তা অনুমিতই ছিল। ক্লাব ফুটবলে আগের মতো গোলবন্যা হয়তো বইয়ে দেননি, কিন্তু জাতীয় দলে অবিশ্বাস্য এক বছর কাটিয়েছেন। কোনো পঞ্জিকাবর্ষে জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করেছেন, প্রথম ম্যাচে হেরে বসা আর্জেন্টিনাকে পরম আরাধ্য বিশ্বকাপ জেতানোর পথে প্রতি ম্যাচেই কাব্যিক পারফরম্যান্স ছিল তার।
এরপরও ফিফা দ্য বেস্টে অবশ্য ভালোই প্রতিদ্ব›িদ্বতা হয়েছে। একটুর জন্য বিশ্বকাপ জিততে না পারা কিলিয়ান এমবাপে দারুণ প্রতিদ্ব›িদ্বতা গড়ে তুলেছেন। তার দল বিশ্বকাপের ফাইনালে হারলেও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার গোল্ডেন বুট ঠিকই জিতেছেন এই ফরাসি তারকা। তবে সেটুকু যথেষ্ট ছিল না মেসিকে টপকে সেরা ফুটবলার হওয়ার জন্য। ৫২ পয়েন্ট পেয়ে মেসিই হয়েছেন সেরা। ক্লাব-সতীর্থ ও বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুটজয়ী এমবাপে পেয়েছেন ৪৪ পয়েন্ট। ওদিকে চোটের কারণে বিশ্বকাপে খেলতে না পারা করিম বেনজেমা ভোটে ৩৪ পয়েন্ট পেয়েছেন। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক করা এমবাপ্পে উপস্থিত থাকলেও বেনজেমা যাননি প্যারিসে।
পরশু রাতের এই জয়ে সাতটি বালন ডি’অরের সঙ্গে এখন সাতটি ফিফা দ্য বেস্টেরও মালিক মেসি। ব্যক্তিগত এই অর্জনের রাতেও বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দের কথা বারবার বলেছেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক, ‘এটা দারুণ। এটা চমৎকার এক বছর ছিল এবং আজ (পরশু) রাতে এখানে উপস্থিত হয়ে এই পুরস্কার জেতা আমার জন্য গর্বের। আমি কোচ স্কালোনি এবং আমার সতীর্থদের ধন্যবাদ দিতে চাই, তারা না থাকলে এখানে উঠতে পারতাম না। বহুদিন ধরে দেখা একটা স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হয়েছে আমার। যেকোনো খেলোয়াড়ের স্বপ্ন বিশ্বকাপ জেতা; খুব কম মানুষই এটা অর্জন করতে পেরেছে, আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন।’ নিজে না পেলেও পিএসজি সতীর্থের এমন অর্জনে খুশি এমবাপ্পেও। একটু পরই ইনস্টাগ্রামে এক পোস্টে ফরাসি গোলমেশিন লেখেন, ‘অনেক অনেক অভিনন্দন। তুমি সত্যিই দ্য বেস্ট।’ পাশে রাজার মুকুটের একটি ইমোজিও যোগ করেন এমবাপ্পে।
বিভিন্ন নামে ১৯৯১ সাল থেকে বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার দিয়ে আসছে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থাটি। শুরু থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার নামের পুরস্কারটি একবার জেতেন মেসি। সেই থেকে শুরু সেরার মঞ্চে এই মহাতারকার আধিপত্যের। পরের ছয় বছর ফরাসি ম্যাগাজিন ফ্রান্স ফুটবল আর ফিফা মিলে দেয় ফিফা ব্যালন ডি’অর। এই পুরস্কারটি মেসি জেতেন ২০১০, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৫ সালে। এরপর বর্তমানের দ্য বেস্ট নাম দেয় ফিফা, ২০১৯ সালের পর যা এবার আবারও জিতলেন তিনি। গড়লেন প্রথম ফুটবলার হিসেবে তিনটি দশকে এই পুরস্কার জয়ের কীর্তি। এদিকে প্রথম নারী হিসেবে টানা দুটি ফিফা দ্য বেস্ট জিতেছেন বার্সেলোনার মিডফিল্ডার আলেক্সিয়া পুতেয়াস।
মেসির জাতীয় দলের সতীর্থ ও কোচ জিতেছেন পুরষ্কার। সেরা গোলকিপারের পুরষ্কার জিতেছেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। আর সেরা কোচ হয়েছেন আর্জেন্টিনাকে ৩৬ বছর পরে বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার মূল কারিগর লিওনেল স্কালোনি। রিয়াল মাদ্রিদের বস কার্লো আনচেলত্তি ও ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলাকে টপকে বর্ষসেরা কোচ হয়েছেন স্কালোনি। বিশ্বকাপ ফাইনালের অন্তিম মুহ‚র্তে কোলো মুয়ানির শট আটকে দলকে টিকিয়ে রাখা এমিলিয়ানো মার্তিনেস সেরা গোলরক্ষক হওয়াটাও তেমন চমক জাগানিয়া নয়। এই আর্জেন্টাইন পেছনে ফেলেছেন থিবো কোর্তোয়া মরক্কোর হয়ে দুর্দান্ত বিশ্বকাপ কাটানো ইয়াসিন বুনু।
এই প্রথম ফিফার ম‚ল তিনটি পুরস্কারই কোনো একটি দেশে গেল। আর্জেন্টিনার জয়জয়কার এখানেই শেষ নয়। ফিফার বর্ষসেরা সমর্থকের পুরস্কারও জিতেছে আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপে দলে দলে কাতারে হাজির হয়ে যেভাবে সমর্থন দিয়েছেন এবং দলকে দেশে যেভাবে বরণ করেছেন তা এতটাই অনন্য ছিল যে ফিফার পুরস্কারও পেয়েছেন তারা। এর শিকিভাগ হলেও কৃতিত্ব বাংলাদেশেরও আছে। সমর্থকদের পক্ষ থেকে এ পুরস্কার বুঝে নিয়েছেন কার্লোস পাস্কেল। ১৯৭৪ বিশ্বকাপ থেকে গত ১৩টি বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনাকে সমর্থন জানাতে ড্রাম নিয়ে গ্যালারিতে হাজির হয়েছেন তিনি। এদিন স্টেজেও সে ড্রাম নিয়ে উঠেছেন ৮২ বছর বয়সী।
এবারের বর্ষসেরা পুরস্কার দেওয়ার শুরুতে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো মঞ্চে উঠে গত বছর মারা যাওয়া ব্রাজিলের প্রয়াত কিংবদন্তি ফুটবলার পেলেকে স্মরণ করে বলেন, ‘পেলেই ফুটবল। পেলে চিরকালীন।’ তিনবার বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তির একটি ভিডিও ফুটেজও দেখানো হয়। পেলেকে স্মরণ করতে মঞ্চে ওঠেন ব্রাজিলের আরেক কিংবদন্তি রোনাল্ডো। দুবার বিশ্বকাপজয়ী রোনাল্ডো পেলেকে পর্তুগিজ ভাষায় স্মরণ করেন। কালোহীরাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিফার একটি বিশেষ সম্মাননা ট্রফিও তুলে দেওয়া হয় পেলের স্ত্রীর হাতে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন