বগুড়ার একমাত্র ফুটবল স্টেডিয়ামকে বিলুপ্ত করে সেখানে অনেক বড় পরিকল্পনা নিয়ে ২০০২ সালে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের আধুনিকায়ন করা হয়। এটি রূপান্তরিত হয় আধুনিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম হিসেবে। এটির ভিত্তিস্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। একটি অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম ও ক্রীড়া কমপ্লেক্স হিসেবে এটির নির্মাণকাজ শেষ হলে পরবর্তীতে আইসিসি এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মর্যাদা দিলে বেশ কয়েকটি ওয়ানডে এবং টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করা হয়। ২০০৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয় এই মাঠেই। সেসময় পাকিস্তানের কিংবদন্তি পেসার ওয়াসিম আকরামসহ বেশ কয়েকজন ক্রিকেট তারকা বগুড়ার এই স্টেডিয়ামকে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সাথে তুলনা করেছিলেন। বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার বেশ কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ওয়ান ইলেভেনের মাধ্যমে সৃষ্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই রহস্যজনক কারণে উপেক্ষার শিকার এই আন্তর্জাতিকমানের ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি। অথচ এখান থেকেই মুশফিকুর রহিম, শরিফুল ইসলামদের মতো ছেলেরা বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলছে। খাদিজাতুল কোবরা, রিতুমনি, শারমিন সুলতানার মতো নারী ক্রিকেটাররা জাতীয় পর্যায়ে খেলে দেশের মান উজ্জ্বল করছে। তৌহিদ হৃদয়, তামিমের মতো ছেলেরা আন্ডার নাইনটিন খেলে একমাত্র বিশ^কাপ শিরোপা জয়েল উল্লাসে ভাসিয়েছে বাংলাদেশকে।
অবশ্য শুধু ক্রিকেট নয়, সবধরনের খেলাধুলার আয়োজন একই জায়গায় করতে চেয়েছিলেন খালেদা জিয়ার সরকার। বিশেষ করে তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ইচ্ছে ছিল, ক্রীড়া কমপ্লেক্স-এর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে একটি আধুনিক ফুটবল স্টেডিয়াম, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন জিম, সর্বাধুনিক সুইমিংপুল, অ্যাথলেটিক্স এর জন্য আলাদা ট্র্যাক, ভলিবল মাঠ, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড এবং স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের ফাঁকা জায়গায় আন্তর্জাতিক মানের আবাসিক হোটেল নির্মাণ করা। সেকারণে স্টেডিয়ামের পাশের কৃষি খামারের কিছু অংশ নিয়ে সেখানে ফুটবল স্টেডিয়াম এবং অ্যাথলেটিক্স এর জন্য ট্র্যাক নির্মাণের পরিকল্পনাও করা হয়। তবে পরে আর সেটা সম্ভব হয়নি।
বগুড়ার শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়াম পুনঃনির্মাণকালীন সময়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মাহবুবুর রহমান বকুল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ক্রীড়া কমপ্লেক্স-এর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে বাস্কেটবল গ্রাউন্ড করা হয়। জাতীয় দল কিংবা বিদেশি ক্রিকেটারদের অনুশীলনের কথা ভেবেই এটা করা হয়েছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া কমপ্লেক্স করা সম্ভব হয়নি।’ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শহীদ চাঁন্দু ক্রীড়া কমপ্লেক্স-এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে বগুড়া উত্তরাঞ্চলের ক্রীড়ারাজধানী হয়ে উঠত। বগুড়া থেকে জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় সরবরাহ করা যেত। বিশেষ করে ক্রিকেট এবং ফুটবলে উত্তরাঞ্চলের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।’
স্টেডিয়ামের ভেন্যু ম্যানেজার জামিলুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বমানের ক্রিকেটার তৈরির জন্য শ্রীলংকান কিউরেটর নন্দসেনাকে দিয়ে স্টেডিয়ামে দুটি বাউন্সি উইকেট তৈরি করা হয়েছে, যা দেশের অন্যকোনো ভেন্যুতে নেই। সেই বাউন্সি উইকেটে অনুশীলন করেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এখনো সেই উইকেটগুলো দেশের সেরা বাউন্সি উইকেট হিসেবে বিবেচিত। তিনি বলেন, ‘ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগের মহাসড়কটি ফোরলেনে উন্নয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে। বগুড়ায় বিমানবন্দর এবং বগুড়া ঢাকা রেললাইনের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এ অবস্থায় বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে পুনরায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যুর মর্যাদা ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।’
তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আগের দিন অসহযোগিতার অভিযোগে বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম থেকে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মালামাল প্রত্যাহার করে নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। গত ২ মার্চ বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজামউদ্দিন চৌধুরী জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে একটি চিঠি দিয়ে জানান যে, ‘বিগত কয়েক বছর যাবত বগুড়া ক্রীড়া সংস্থার অসহযোগিতার ফলে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কর্তৃক নিয়মিতভাবে টুর্নামেন্ট/লীগ আয়োজন করা সম্ভবপর হচ্ছে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড উক্ত স্টেডিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। উক্ত ভেন্যুতে কর্মরত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দকে এর মধ্যেই অন্য ভেন্যুতে বদলি করা হয়েছে।’
এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে বগুড়াবাসী বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছেন। অনেকে কড়া ভাষায় বিসিবির সমালোচনা করেছেন। ঐ রাতেই ডাকা জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে এহেন জঘণ্য কাজের জন্য বিসিবি কর্মকর্তার লজ্জা থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মিলন। তিনি বলেন, ‘উনারা (বিসিবি) কেন রাগ করেছে আপনাদের বলি, আমাদের এই প্রিমিয়ার লিগ, আমাদের প্রিমিয়ার লিগটি আমরা উদ্বোধন করেছি (১ মার্চ), আমি একটা চিঠি দিয়েছি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গেম ডিভেলপমেন্টকে যে আপনাদের অবগত করা হলো ১ মার্চ বগুড়া প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ উদ্বোধন করেছি। গতকাল (১ মার্চ) বাতেন নামের (বিসিবির গ্রাউন্ডস কমিটির ম্যানেজার আব্দুল বাতেন) একজন (বিসিবির) কর্মকর্তা যার সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক যার সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত কথা হয় উনি আমাকে রিং দিলেন যে ‘মিলন ভাই, আমাদের যে খেলা আছে (ইয়ুথ ক্রিকেট লিগ) তাহলে কেন আপনি এখানে (চান্দু স্টেডিয়ামে) খেলা দিলেন?’ আমি বললাম ‘আমি খেলা দিলাম তাতে সমস্যা কি? আপনারাও খেলবেন, আমরাও খেলবÑ নো প্রবলেম। সামনে ২৩ মার্চ রমজান। আমাদের খেলাগুলো আমরা কবে করব? খেলা করতে হবে না আমাদের? খেলা না করলে আমরা ডেভেলপ করব কেমন করে?’ ওনারা পরে বললেন, ‘ঠিক আছে দেখা যাক কি করা যায়।’ একটু পরে আবার ফোন করে বললেন, ‘আপনাদের ভেন্যুতে সব লোক আমরা তুলে নিয়ে যাব। মালামাল তুলে নিয়ে যাব।’ পরে এই চিঠি পেলাম। আপনারা এ কথা বলার আগে আপনাদের মিনিমাম লজ্জা থাকা উচিত! কি আছে এখানেÑ আর কি তুলে নিয়ে যাবেন? আমাকে এক সাংবাদিক ভাই বললেন, বিসিবি নাকি এখানে মাসে ১৫ লাখ টাকা খরচ করে। ১৫ হাজার টাকার কোনো উপকার আছে? ১৫ লাখ টাকা কাকে দেয়। আর সেই টাকার বাস্তবায়ন কীভাবে হয়? গত ১৫ বছরে কি একটা ফ্লাড লাইট জ্বালাতে পেরেছে বিসিবি? ১৫ বছরে কি কোনো রাস্তা-ঘাটের সংস্কার হয়েছে? আমাদের ব্যক্তিগত টাকায় স্টেডিয়ামের রাস্তা সংস্কার করেছি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিসিবি ৩০ কোটি, ৫০ কোটি, ১০০ কোটি টাকা খরচ করে স্টেডিয়ামের রেনোভেশন করেছে। গত ১০ বছরে বিসিবি বগুড়ায় কয় হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছে?’
বিসিবির এই আচরণ উদ্দেশ্যমূলক কি-না জানতে চাইলে মাসুদুর রহমান বলেন, ‘উদ্দেশ্যমূলক নয়, এটা হল জ্ঞানহীন একটা কথার অংশ। একটা কথা বলতে হবে বলে দিলাম।’ তবে বিসিবির কিছু কর্মকর্তার দৃষ্টিভঙ্গি বগুড়ার প্রতি পক্ষপাতমূলক বলেও সাংবাদিকদের অভিযোগ করেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার এই সম্পাদক। জেলা ক্রীড়া সংস্থা বিষয়টির সমাধানে নিজে থেকে চেষ্টা করবে কি-না জানতে চাইলে মিলন বলেন, ‘আমরা নিজেরা এর যৌক্তিক সমাধান চাই। আমরা চাই বিসিবির সুদৃষ্টি আমাদের উপর আসুক। এখানে আন্তর্জাতিক মানের খেলা হোক। বগুড়া জনগণ সেটি চায়। আমরা কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনের বিপক্ষে নই। একটা জেলা ক্রীড়া সংস্থার বছরে ২০ থেকে ২৫টি ইভেন্ট। আমাদের তো সেই খেলাগুলো পরিচালনা করতে হবে। এই দায়ভার বগুড়ার মানুষ আমাদের দিয়েছে। বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনকে সচল রাখার। বগুড়ায় একটা মাত্র মাঠ। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন প্রত্যেকটি জেলা-উপজেলায় খেলা হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী ডিসেন্ট্রালাইজড করছেন খেলাধুলাকে আর বিসিবি আমাদের সহযোগিতায় বয়সভিত্তিক খেলোয়াড় পাচ্ছে। বগুড়া একটা প্রোডাকশন হাউস এবং এই প্রোডাকশন হাউসে ১০০০-১৫০০ ছেলে-মেয়েরা খেলে। তাদের মধ্যে আমরা নেতৃত্ব দিতে পারি বাংলাদেশকে। এটিই মনে হয় উনাদের (বিসিবি কর্মকর্তাদের) একটি অন্তর্নিহিত ক্ষোভ।’
কোচ মুসলিম উদ্দিনের কথা মনে পড়ে গেল। শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের পরিত্যক্ত টয়লেটকে কী সুন্দর সাজিয়ে স্থানীয় মেয়ে ক্রিকেটারদের ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এই কোচ। যার দেওয়ালে লেখা ছিল, ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, জীবন বদলে যাবে।’ মুসলিম উদ্দিন আজ আর নেই। ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পাড়ি জমিয়েছেন অনন্ত নক্ষত্রবিথীতে। প্রায় ৩ বছর হতে চলল, বগুড়ায় হয়ত ক্রিকেটও নির্বাসিত হতে যাচ্ছে। এই ক্রিকেট আঁতুরঘরের নিরব কান্না কি কারো হৃদয়ে দাগ কাটবে?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন