সাহেদ বিপ্লব
তরু সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়ে যায় আর ফেরে রাত দশ-এগারোটার দিকে। সারাদিন কাটে তার মিটিং মিছিল, সংগঠন অফিসে বৈঠক নিয়ে। ছোট ছোট পাটির সাথে আলোচনা চলছে, কিভাবে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সরকার যা করছে এটা অন্যায়, এটা করলে দেশের ক্ষতি হবে, জাতির ক্ষতি হবে, এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
এসব করে একদিন অফিস থেকে এলো বাসায়।
বাসায় আসার পর মা বলল, সারাদিন কিসব করছিস? দুদিন পরই ঢাকা যেতে হবে উচ্চ শিক্ষার জন্য, সে কথা কি মনে আছে?
তাই বলে, মা, আমরা তো বসে থাকতে পারি না। সরকার যা করছে সব অন্যায়, আমরা তার প্রতিবাদ করছি মাত্র।
তা না হয় বুঝলাম, এবার লেখাপড়া শেষ করে বাবার স্বপ্নটা পূরণ কর।
তরু কিছু না বলে মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। একসময় মায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে, কি দেখছ অমন করে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলে, সেদিনের ছেলে আজ দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেছিস! আমি কোথাও গেলে তুই পাছে পাছে ছুটতি আর বলতিস কোলে যাবো, এক মুহূর্তের জন্য কোথাও যেতে পারতাম না । আজ তুই সারা দিন বাইরে থাকিস! তুই মাছ খেতে গিয়ে কাঁটা তোর গলায় বিঁধে গেলো, কোনোভাবে বের হলো না, শেষে তোর মামা তোকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটলো, তুই ছিলি তোর ছোটমামার জান।
তরু শুনছে, কিছু বলছে না। ভালোই লাগছে ফেলে আসা দিনগুলির কথা শুনতে।
আরেক বার কি হলো জানিস? ভরা বর্ষা তখন। বাড়ির সামনের খালটা কানায় কানায় ভরা। দুপুরের খাবারের পর তুই নেই, নেই তো নেই- কোথাও নেই। লোকজন ছুটল চারদিকে। জাল নিয়ে পানিতে নামল অনেকেই। আমি তো হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছি। শেষে তোকে কোথায় পাওয়া গেল জানিস?
আমি কি করে জানবো?
বাবার দেয়া গাড়িটা আলমারীর নিচেই লুকিয়ে রাখতে গিয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলি। বলে শব্দ করে হাসলো জামিলা খাতুন।
দুই
তরু ঢাকা গিয়ে উঠলো তার এক মামাতো বোনের বাসায়। মামা হিসাব করেই টাকাঅলা মানুষের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে।
শ্রাবন্তী তরুর দিকে তাকিয়ে বললো, এটা তোর থাকার রুম। যতদিন কলেজ হস্টেলে সিট না মেলে ততদিন এখানে থাকতে পারবি, কোনো চিন্তা নেই।
রাজার বাড়ির মত বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিস দেখেছি, টাকা থাকলে যা হয়।
শ্রাবন্তী হাসলো, কিছু বললো না।
মামা খুব চালাক মানুষ, দেখেশুনে তোকে টাকাঅলা মানুষের কাছে বিয়ে দিয়েছে। সারাজীবন পায়ের উপর পা দিয়ে খেতে পারবি।
শ্রাবন্তী হেসে ফেলে বললো, বাবা যদি ধনীর ঘরে বিয়ে না দিতো তাহলে আজ ঢাকায় এসে পথে পথে ঘুরতে হতো তোকে। এবার ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আয়।
তরু কিছু বলতে চাইলো কিন্তু কিছু বলার আগেই শ্রাবন্তী রুম থেকে বের হয়ে গেল।
একসময় তরু ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
কি দেখছিস এমন করে?
কার জন্য এতো আয়োজন?
কারো জন্য নয়। প্রতিদিন এভাবে আয়োজন থাকে। একটু থেমে শ্রাবন্তী আবার বলে, এই বাসায় একেকজনের একেক প্যাখনা। এ এটা খাবে না, ও ওটা খাবে না, এভাবে সাত আট প্রকার হয়ে যায়। নে এবার খেয়ে নে।
ঢাকায় এসেও সেই রাজনীতি। পল্টনের এক জনসভায় সরকারকে জানিয়ে দিল আপনারা যে রাজনীতি করছেন তাতে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণ হচ্ছে না, হচ্ছে আপনাদের। আমরা দেশের সাধারণ মানুষ এই রাজনীতি থেকে মুক্তি চাই। দেশকে এগিয়ে নিতে চাই উন্নয়নের পথে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্র দেশের বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এই ছাত্ররা দেশের সম্পদ হবার কথা ছিল কিšুÍ হয়নি। একটা চাকরির জন্য সারাদেশ ঘুরে বেড়ায় কিন্তু চাকরি নেই। এই দেশ এতজন শিক্ষিত বেকারকে একটা চাকরি দিতে পারে না শুধু রাজনীতির ভুল সিদ্ধান্ত নেবার কারণে।
পরের দিন এই সংবাদ প্রকাশ হল সকল জাতীয় পত্রিকায়।
দেশের সুধী সমাজ সাধুবাদ জানালো কিšুÍ সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী সুযোগসন্ধানী আখের গোছানো রাজনীতিক তার এই বক্তব্য সহজভাবে নিল না। তারা ভাবল এই সংগঠন তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। তাই মাথা চাড়া দেবার আগেই উপড়ে ফেলতে হবে কাঁটা।
একটি জাতীয় পত্রিকা তরুর সাৎকার গ্রহণ করে।
সাংবাদিক : আপনারা কি আগামীতে কোন রাজনৈতিক দল করবেন?
তরু : আমরা রাজনৈতিক দল করতে আসিনি। আমরা এসেছি সরকার যে ভুল করছে তা ধরিয়ে দিতে, যাতে সব ক্ষেত্রে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সাংবাদিক : আপনারা কি সরকার পরিবর্তন চান?
তরু : সরকার পরিবর্তন করা আমাদের লক্ষ্য না। যে সরকার আসে আসুক, এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। সরকার ভুল করতে পারে, আমরা তা ধরিয়ে দিয়ে সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতে চাই। এই দেশ আমাদের। আমরা যদি ভুল করি তাহলে এই দেশ অনেক পিছিয়ে যাবে। দেশে অনেক সমস্যা আছে। ভোটের রাজনীতি করলে চলবে না। মিথ্যার ঝুলি উপুড় করে দিয়ে বড় বড় কথায় জনগণকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ক্ষমতায় এসেই আখের গোছানোর ধান্দা করলে তো দেশ চলবে না।
সাংবাদিক : এ থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়?
তরু : আমাদের দেশে অনেক সম্ভাবনা আছে কিšুÍ রাজনীতির সমস্যার কারণে আমাদের দেশ এগিয়ে যেতে পারছে না। রাজনীতি ছিল দেশের মানুষের সেবা করবার স্থান কিন্তু সেই রাজনীতি আজ লুটেপুটে খাবার স্থান হয়ে গেছে। এই যদি হয় রাজনীতির স্থান তাহলে লজ্জা রাখার জায়গা আর থাকে কি?
পরের দিন জাতীয় পত্রিকায় এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ হবার সাথে সাথে হইচই পড়ে গেল সারা দেশে। বিদেশি মিডিয়া তাদের তাদের মন্তব্য প্রতিবেদনে বলে, কে এই ছেলে? তিনি কি আগামী দিনের জাতীয় কণ্ঠস্বর? তার সাহস আছে বটে!
মৃত্যুর হুমকি আসতে লাগলো তরুর মোবাইল ফোনে। পাত্তা না দিয়ে একের পর এক মিছিল মিটিং চালিয়ে যেতে লাগলো সে। তারপর একদিন হঠাৎ গুম হয়ে গেল।
বাসা থেকে বেরিয়ে যাবারকালে শ্রাবন্তীকে বলে গিয়েছিলো সংগঠন অফিসে মিটিং আছে। নয়টার ভিতর বাসায় ফিরে আসবে কিšুÍ আর ফেরেনি। প্রথমে শ্রাবন্তী ভেবেছিল কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে বাসায় আসতে পারেনি, মাঝে মাঝে বাসায় ফেরে না তরু। কিন্তু তরু আজো ফেরেনি। গুম হয়ে গেছে সে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন