মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন : উনিশ শতকের শুরুতে পশ্চিমা সাহিত্যের বাতাস বেশ জোরে ধাক্কা মারে এদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর। ফলে আধুনিকতার নামে একে একে হারিয়ে যায় নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারা। পরিবর্তিত হতে থাকে মানুষের চিন্তাচেতনার রূপ। পশ্চিমা ধারার ফলে যখন উদভ্রান্ত অবিভক্ত ভারতীয়রা অহিংস, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তির নেশায় সংগঠিত হবার চেষ্টা করছিল, সে সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষমতার আধিপত্যের নেশায় পৃথিবী উপহার পেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের জ্ঞান বিজ্ঞানে এসেছে বড় পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের হাওয়া বাংলা সাহিত্যেও লেগেছিল বেশ শক্তভাবেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একচ্ছত্র আধিপত্যের মধ্যে ধূমকেতুর মত আগমন ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের। তার লেখনীর আঘাতে কবি-সাহিত্যিকদের যেমন ভাবিয়ে তুলেছিল, তেমনি ঘুম হারাম করে দিয়েছিল ‘জোঁক’রূপী বৃটিশ সিংহাসনের।
এমন ঝড়ের মধ্যে থেকেও বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা থেকে যিনি ছিলেন নির্বিকার তিনি হলেন কবি জসীম উদ্দীন। সবাই যেখানে ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় ব্যস্ত, সেখানে জসীম উদ্দীন নির্লিপ্তভাবে নিজস্ব-ইতিহাস-ঐতিহ্য-চেতনাকে উজ্জীবিত করার প্রয়াসে গ্রাম থেকে গ্রামে, একটি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী শতকরা পঁচানব্বই ভাগ গ্রামীণ মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। উদভ্রান্ত মানুষের শিক্ষা নিহিত আছে জসীম উদ্দীনের লেখনীতে। কিন্তু সে শিক্ষা নেয়ার মত সময় হয়তোবা এদেশের মানুষের ছিল না বা আজো আছে বলে মনে হয় না। ফলে দিনে দিনে শারীরিক গড়নে ও বর্ণে বাঙালি হবার পরও আমরা চিন্তাচেতনায় এবং আদর্শে সঙ্করায়িত হয়ে পরগাছায় পরিণত হচ্ছি।
জসীম উদ্দীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাখালী, তার ছাত্রাবস্থাতেই প্রকাশিত হয়। এখানে আঠারটি কবিতা রয়েছে। ‘কবর’, ‘পল্লী জননী’, ও ‘রাখাল’ ও ‘রাখালী’র মত শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা আছে এ কাব্য গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। কারো কারো মতে, কবর ও পল্লী জননীর মতো শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা কেবল জসীম উদ্দীনের বেলায় নয় সমগ্র বাংলা সাহিত্যেও বিরল। আলোচ্য লেখায় পল্লী জননী কবিতার মূল্যায়নের প্রয়াস চালাবো।
বাষট্টি লাইনের এ কবিতাটি এক অসহায় দরিদ্র জননীর হৃদয়ের যে ক্ষত রয়েছে তা ফুটে উঠেছে। খুব স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হয় যেন এক হতভাগ্য ও হতদরিদ্র মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থায় থাকা একমাত্র পুত্রসন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণার যে কাতরতা তা সহ্য করতে পারছেন না। তিনি নিশ্চিতভাবেই অকল্যাণের সুর শুনতে পাচ্ছেন হুতুম প্যাঁচার ডাকে। ফলে একমাত্র অবলম্বনকে ধরে রাখতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে হুতুম প্যাঁচাকে তাড়াতে ‘দুর-দুর’ করছেন।
সার্থক সাহিত্যে প্রচুর রূপক ব্যবহার হয়। এ রূপকের মধ্যেই নিহিত থাকে প্রকৃত ঘটনা ও বার্তা। জসীম উদ্দীনের পল্লী জননী কবিতাটিও তেমনি একটি। এ কবিতার মূল ঘটনাগুলি তৃতীয় ব্যক্তি প্রকাশ করলেও ক্ষণে ক্ষণে মা-ছেলের যে কথোপকথন রয়েছে তা আমাদের হৃদয়কে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। কবিতাটির শুরুর ভঙিমা গদ্যের মত। ‘রাত থম্থম্ স্তব্ধ নিঝুম, ঘোর-ঘোর-অন্ধকার’- এখানে ক্লান্ত ও বেদানাক্লিষ্ট একজন মানুষ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে যেভাবে ধীরে ধীরে কথা বলে সেভাবে বক্তা শুরু করেছেন।
সাহিত্যে ঘোর অন্ধকার সব সময়ই অজানা আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে সামান্য নিঃশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায় পৃথিবীর নিস্তব্ধতার জন্য, সেখানে মৃত্যু পথ যাত্রী রুগ্ণ সন্তানের শিয়রে বিধবা মা বসে আছেন। সন্তানের শিয়রে থাকা বাতিটি যখন নিবু নিবু করে জ্বলে তখন ‘বিরহী মায়ের একলা পরাণ দোলে।’
দারিদ্র্যক্লিষ্ট অসহায় মায়ের অসহায়ত্বকে স্পষ্ট করার জন্য বক্তা বেশ কিছু শব্দ ব্যবহার করেন যা সে সময়ের আধুনিকতার আড়ালে পুঁজিবাদের যে নিষ্ঠুর যাঁতনা তা ফুটে ওঠে। ভাঙা ছোট কুঁড়েঘরের মধ্যে শীতের ঠা-া বাতাস মাকে আরো বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলছিল। তার উপর পাশের ডোবা থেকে পচা গন্ধে মা ও ছেলের জীবন যেন প্রায় থেমে যাচ্ছিল। কিন্তু হতভাগ্য মায়ের মনে বার বার সন্তানের মৃত্যু আশঙ্কায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তুলেছিল, সেখানে দীর্ঘ অসুস্থ পা-ু বাঁচার আশায় রাতের অবসান চায় এবং সকালের আলো কামনা করে মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মারে, কত রাত আছে, কখন সকাল হবে।’ আর তখনই মায়ের অন্তরাত্মা আরো কেঁপে ওঠে এবং সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে ঘুমাতে বলে। এখানে জসীম উদ্দীন এই এ সৃষ্টি বিশ্ব সাহিত্যে নতুন মনে হয়নি, কেননা ইংরেজ কবি শেলির বিখ্যাত ‘ওড টু ওয়েস্ট উইন্ড’ কবিতার শেষ দু’টি লাইনের প্রতিধ্বনি দেখতে পাই। সেখানেও বক্তা সব হতাশাকে ভুলে যাবার জন্য শীতের নিকশ-নিরান্দনের পর বসন্তের কামনা করছেন।
সন্তানের অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরতা দেখে মা অস্পষ্ট মনে আল্লা-রসূল-পীরকে ডাকেন এবং মসজিদ-মাজারে বিভিন্ন কিছু মানত করে। সব নিস্তব্ধতাকে ভেঙে ছেলে বলে উঠল, ‘মাগো! পায়ে পড়ি বল্, ভাল যদি হই কাল,/ করিমের সাথে খেলিবার গেলে দিবেনাতো গাল।’ এরপর একে একে পা-ু তার সব কথা বলতে থাকে। সে মাকে আরও বললো, ‘শোন মা, আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,/ রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাতানির শিকা ভরে।/ খেজুরে গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়োমের কোলা ভরে,/ ফুলঝুরি শিকা সাজাইয়া রাখো আমার সমুখ পরে।’ এমন আবদার মাকে আরো বেশি অস্থির করে তুলেছে। একে একে মায়ের মনে পড়ল পা-ুর সব কাজের কথা। যেখানে একদিন কঠোর শাসন করেছিল একটু সন্ধ্যা করে বাসায় ফিরেছে বলে। মা ভাবেন আজ এমন হতো না যদি সেদিন তিনি এমন শাসন না করতেন।
এসব কথাকে চাপিয়ে ধীরে ধীরে মায়ের হত-দরিদ্রতার চিত্র তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। ‘কত কথা আজ মনে পড়ে মার, গরীবের ঘর তার,/ ছোট খাটো বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার।/ আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই।’ তাই সেদিন ছেলেকে ‘আড়ঙ’ মুসলমানদের জায়গা নয় বলে বারণ করতে চাইলে পা-ু প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং জিজ্ঞেস করে, ‘করিম যে গেল? আজিজ চলিল?’ কিন্তু দুখিনী মা কোনো জবাব দিতে পারেনি বরং তার জ্বালা সেদিন যা ছিল আজ আরো দ্বিগুণ আকারে দেখা দিয়েছে।
এ ব্যথা দ্বিগুণ হবার মূল কারণ ছেলের বায়না পূরণ করতে না পারা নয়। এমন অসুস্থতার দিনেও ডাক্তার এনে চিকিৎসা না করাতে পারার ফলে। মা হাহাকার চিত্তে বলে উঠল, ‘আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,/ ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা।’
এ করুণ যন্ত্রণা ও হাহাকার আরো তীব্রতর হতে থাকে রাত গভীর হবার সাথে সাথে। রাত যত গভীর হয় অসহায় মা বুঝতে পারে তার সন্তান তত বেশি মৃত্যুর কাছাকাছি চলে এল। এর এ আশঙ্কা আরো বাড়ে ঘরের চলে হুতুম প্যাঁচার ডাক শুনে। এ যে অকল্যাণের সুর। মায়ের দুশ্চিন্তা আর মা-ছেলের থেমে থেমে কথোপকথনের মধ্যেও আমরা বুঝতে পারি ধীরে ধীরে সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। তাই বক্তার মুখে শুনি, ‘রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একলা জাগিছে মাতা,/ সম্মুখে তার ঘোর কুজ্ঝটি মহাকাল রাত পাতা।/ পার্শ্বে জ্বালিয়া প্রদীপ বাতাসে জমায় খেল,/ আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।’
পরিশেষে এ কথা বলা যায়, ‘দারিদ্র্য দুঃখতাড়িত পল্লী নারীর মাতু¯েœহের এমন বাস্তবধর্মী ও হৃদয়স্পর্শী চিত্র বাংলা কাব্যে বড় একটা চোখে পড়ে না।’ ‘পল্লীজীবন বাস্তবের পটভূমিতে মাতৃ¯েœহের যে করুণাঘন রূপ এ কবিতায় ধরা দিয়েছে, তা বাংলা কাব্যে প্রায় একক।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন