স্বাধীন পারভেজ
এই দিনগুলোর কথা তাকে আমি নিশ্চয়ই বলব। হয়তো এমনই এক বিচ্ছিরি বাদলা দিনে ঘরের সবগুলো দরজা-জানালা আটকে দিয়ে দুজনে মেঝেতে বসে পড়ব, খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে। তারপর কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ আর ঝাঁজওয়ালা খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে তার হাতেমাখানো মুড়ি চিবুতে চিবুতে ঘেন্না আর বিরক্তিতে নাক মুখ সিটকে বলব তাকে আজকের দিনের ঘটনাটা। বলব কি অসভ্য ঝড় বাদলার মাঝে হাঁটুসমান কাঁদা মাড়িয়েও আমি দূর শহর থেকে ছুটে এসেছিলাম; একমাত্র তার টানে! তার মায়ায়। এসব শুনে সে বুঝি খুব হাসবে? বেদম হাসিতে ফেটে পড়ে, হাত পা ছুড়ে বিরাট এক কা- বাধিয়ে বসবে হয়তো। আচ্ছা, মেয়েটার হাসি কেমন? কে জানে। ছবিতে তো মুখটা বেশ গম্ভীর। হাসির লেশমাত্র নেই সেখানে। তবুও আমার তাকে ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। মনের ভেতর গেঁথে থাকা সেই নিষ্প্রাণ ছবিখানা থেকে থেকে কেমন খলবল করে হেসে ওঠে। বড় ভালো লাগে সে হাসির ঝলক। মুগ্ধ হয়ে সে মুখপানে তাকিয়ে থাকি একমনে আহা!
রাত ৯টা বেজে গেছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। একে তো গ্রামের কাঁচা রাস্তা, তার ওপর বিরক্তিকর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি লেগেই আছে। যেন কামার পাড়ার নোংরা অপরিষ্কার বাচ্চা ছেলেগুলোর নাক দিয়ে অবিরত ঝরা বিচ্ছিরি জল। ওয়াক! ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে আসে। বর্ষা বৃষ্টিতে আমার ভারি আ্যলার্জি। এই ঋতুটা দুই চক্ষে দেখতে পারি না। কালেভদ্রেও এই অসহ্য সময়টাতে গ্রামের পথ মাড়াই না। সেই এসএসসি পাস করার পর যবে থেকে শহরে ঢুকেছি তখন থেকে আজ অবধি, এই নয় বছরে একবারের জন্যও বর্ষাকালে গ্রামে আসিনি। রেকর্ড আছে। অথচ সেই আমাকে এই ঝড় ঝঞ্চার রাতে, ফ্যাচফেচে কাঁদায় ভরা মাটির রাস্তায় টেনে এনেছে একখানা থ্রি-আর সাইজের রঙিন ফোটো। একটা গম্ভীর থমথমে মুখচ্ছবি।
মা ছবিটা পাঠিয়েই ফোন করেছিলেন। বাড়ির সবারই নাকি মেয়ে দেখে খুব পছন্দ হয়েছে। আমি যেন অমত না করি। বড় বোনটি আশা প্রকাশ করেছিলেন- মেয়েটাকে আমি দেখেছি, তোর দুলাভাইও খোঁজখবর নিয়ে সব জেনেছে। বড় ভালো মেয়ে। বোনদের বিয়ের পর বাড়িটা তো একেবারে খালি হয়ে গেছে, দেখবি এ মেয়ে আমাদের ঘরে এলে বাড়িটা কেমন ঝলমল করে উঠবে।
শুনে শুনে আমার মন ভরে যায়। অদম্য চাপা খুশিতে ভেতরটা দারুণ চঞ্চল হয়ে ওঠে। আপন মনে ভাবতে থাকি, দিন মাস বছরের আবর্তে জীবনের প্রথম ত্রিশটি বসন্ত পেড়িয়ে গেলোও নীতি আর পারিবারিক রক্ষণশীলতার অজুহাতে নিজেকে এতোদিন কীভাবে বঞ্চিত করে রেখেছি নারী ঘটিত সবরকম রোমাঞ্চ থেকে! নিজের মধ্যে গুটিয়ে থেকেছি, বনসাইয়ের মত কাটিয়ে দিয়েছি বছরের পর বছর। শাসনের সেই বেড়াজালের ছিদ্র গলিয়ে তবু কখনো যদি আবেগের জল বেরিয়ে এসেছে, মন যদি ছুতে চেয়েছে কোনো মায়াবীনীকে; সাথে সাথে আঁকড়ে ধরেছি নিজেকে। টুটি চেপে ধরে আবারো বন্দি করে ফেলেছি নিমিষেই। অবাধ্য হতে দেইনি কোনদিন। অথচ আজ এতো বছর পরে, পরিণত আমার মনে এ কি আদিখ্যেতা এসে ভিড় করলো? লজ্জায় সংকোচে নিজের মাঝে গুটিয়ে যাই ভেবে।
হঠাৎ একটা কথা মনে উঠে আসে আমার। আচ্ছা, যাকে নিয়ে এতো ভাবছি সেও কি আমার মতই বর্ষা বিদ্বেষী? নাকি এই ঋতু নিয়েই তার যত আহলাদ আদিখ্যেতা! এমনটি হলে নির্ঘাত তার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করব। ভাবতে ভাবতে রেগে উঠি। কেন সে বর্ষা পছন্দ করবে? এটা কি পছন্দ করার মত কোন ঋতু হলো নাকি হ্যাঁ? যত্তসব!
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একসময় নিজের ছেলেমিপনায় নিজেই হেসে উঠি। ধুর! আমি তাকে কখনই বকব না। নিজের কোনো ইচ্ছেও তার ওপর চাপিয়ে দেব না। তার যদি বর্ষা ভালো লাগে, তো লাগুক না! বরং তার সাথে আমিও বর্ষার প্রেমে পড়তে শুরু করব। যার সাথে ঘর করব, যাকে ভালোবাসব তার পছন্দই তো আমার পছন্দ।
নিজেকে বড্ড উদার একজন প্রেমিক বলে মনে হতে থাকে আমার...।
হাজীবাড়ীর মোড় পার হয়ে এসেছি। বৃষ্টিও কমে এসেছে অনেকটা। তবে মাটির রাস্তা থেকে লাফিয়ে ওঠা কাঁদায় আমার প্যান্টের অর্ধেকটাই নোংরা হয়ে গেছে। আচ্ছা, বিয়ের পর যখন বাড়িতে আসবো, এমন বিদঘুটে বাদলা দিনে যখন কাদায় মাখামাখি হয়ে মাঝ উঠোনে এসে দাঁড়াবো তখন কি ঘটবে?। অপেক্ষায় উন্মুখ, দুশ্চিন্তা কাতর দুটি চোখে চেয়ে থাকা মানুষটি বারান্দার দরজা থেকে দৌড়ে ছুটে আসবে, উঠোনে। বাদলা বৃষ্টিকে রাজ্যের বকাঝকা করতে করতে হাত থেকে ব্যাগ ল্যাগেজগুলো সব কেড়ে নিবে। হাত ধরে ঘরে টেনে নিয়ে যাবে। পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার মাথা মুছে দেবে আর চিন্তিত কণ্ঠে অসুখ-বিসুখের আশঙ্কা প্রকাশ করবে। আবেগে হয়তো কেঁদেই ফেলবে একচোট!
আচ্ছা, এতো ভালোবাসাও কী পাবো আমি? পরিপূর্ণ একটা মনভর্তি আবেগ, আদর-ভালোবাসা সে তো আস্ত একজন মানুষ আমার, একান্ত আমার হয়ে থাকবে তো?
আহলাদে অভিমানে গুমগুম করে ওঠে আমার মন। আনমনে নিজেকে নিজে সান্ত¡না দিতে থাকি। পাবো, নিশ্চয়ই আমি তার এমন ভালোবাসাটাই পাবো। কেন পাবো না? আমিও কি তাকে কম ভালোবাসবো? মোটেও না। কক্ষনো তাকে কষ্ট দেব না। কোনোদিন তার রান্নার কোনো ত্রুটি ধরবো না। রোজ রোজ তাকে আমার কাপড় কাঁচতে বলব না। এমনকি সে যদি ঘুমকাতুরে হয়, রাত নিশিতে সুখ-দুঃখের গল্প করতে করতে বোকার মতো ঘুমিয়ে যায়, তবুও তাকে কিচ্ছুটি বলব না। সে তো আমার সঙ্গীনী, আমার বন্ধু। তাকে কি বকা যায়? কিছুতেই না।
আজকাল কত মানুষকে দেখি কারণে অকারণে বৌকে পেটায়। যৌতুক দাবি করে। পরকীয়া করে। ছিঃ! আমি ওসব দুই চক্ষে দেখতে পারি না। ভালো তো জীবনে কেবল একজনকেই বাসতে হয়। আর সে হল নিজের জীবনসঙ্গী। আমি তাকে ভালোবাসবো। খুব ভালোবাসবো। তাকে ভালোবাসতে শেখাবোও বটে। বাড়িতে যাতে কারো সাথে কোন ঝগড়া-ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য আগে থেকেই ওকে সব কৌশল শিখিয়ে দেব। আব্বা-আম্মা কিসে খুশি থাকে, বোনদেরকে কিকরে পটানো যায় সেসব তথ্য জানিয়ে দেব। কি করে বাড়ির সকলের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা, সম্মান ও ভালোবাসা অর্জন করা যায় সেসব টিপস্ আমি হাতেকলমে শেখাবো তাকে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে জেগে দুজনে মিলে এসব বিষয়ে পুটপুট করে গল্প করব। নিজেদের দৈনন্দিন পরিকল্পনা সাজাবো, রোজ রোজ। আর একটা কাজ করব আমি। ছুটিতে বাড়ি এসে যে ক‘টা দিন তার সাথে থাকার সুযোগ পাবো, রোজ রাত্তিরে বুকের ওপর টেনে নিয়ে আহলাদি কণ্ঠে তার কাছে জানতে চাইবো- মনি, আমার আজকের কোন আচরণে তুমি কষ্ট পাওনি তো?
এভাবেই আদরভরে রোজ তার মনের খোঁজ নিব। কোথায় কোন ম্যাগাজিনের গল্পে যেন পড়েছিলাম এমনটি।
মনে মনে তাকে নিয়ে একের পর এক নানা প্যান বানাতেই থাকি। নতুন সংসার, কতকি কেনাকাটা করা লাগবে। ঘরের সব কিছু সুন্দরভাবে গোছাতে হবে। কাজের কি আর শেষ আছে? সে নিশ্চয়ই খুব বুদ্ধিমতি হবে। সব ঝক্কি-ঝামেলা সামলে নিবে এক নিমিষেই। তাহলে বাবা বাঁচা গেল! যে অলস আমি! কেনাকাটা বা ঘর সাজানোতে একেবারেই দক্ষতা নাই আমার। সুতরাং এ দায়িত্ব আমি তার হাতেই তুলে দেব।
মা অবশ্য বলেছিলেন সে পরিবারের বড় মেয়ে। বাড়ির বড় মেয়েরা সাধারণত খুব দায়িত্বশীল আর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হয়। আমি মনে মনে নিশ্চিন্ত হতে শুরু করি।
এই যা! আবার ভারী বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। ধুত্তর! ভালাগেনা। হাতের ছাতাটা জুত করে ধরি। রাস্তার আশপাশের বাড়িগুলো নিঃসীম আঁধারে ঢাকা। সকলে ঘুমের রাজ্যে ডুবে আছে। কোথাও রা নেই। আচ্ছা, সে এখন কি করছে? আর মাত্র এক দিন পরই বিয়ের অনুষ্ঠান। শহর থেকে লাগেজভর্তি বিয়ের বাজার করে এই রাত্তিরে বাড়ি ফিরছি। আর মনের মাঝে তাকেই শুধু ভাবছি, ভাবনার সবটুকু সামর্থ্য ঢেলে দিয়ে। কিন্তু সে কি করছে? সেও কি এভাবেই ভাবছে আমাকে ঘিরে? আমার চলাফেরা, হাসি-কান্না, স্বভাব চরিত্র নিয়ে তার মনেও কি কল্পনার সমারোহ চলছে?
ভাবছে। সে নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে ভাবছে। এবং বিয়ের পর সেসব কথা সে লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে আমাকে বলবেও বটে। মেয়েরা বড্ড কল্পনাপ্রবণ, বড্ড ভাবুকমনের হয়। বর নিয়ে তাদের মনের ভেতর রাজ্যের কৌতূহল থাকে। থাকে হাজারো রঙিন স্বপ্নের ফুলঝুরি। সেও নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে ভাবছে। সান্ত¡না খুঁজে পাই মনের ভেতর।
নিজেকে এবার খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে মনে হতে থাকে আমার। খুউব।
বাড়িতে ঢুকে গেছি। ছোট কাকা এগিয়ে এসে ব্যাগগুলো সব তুলে নিয়ে গেছেন বড়ঘরে। বড় বোনটি তোয়ালে হাতে নিয়ে এগিয়ে আসেন। মা সম্ভবত নফল নামাজ পড়ছেন। অতিকষ্টে নিজের চেহারার লজ্জা আর মনের ভেতরকার আগ্রহের ছাপটা আড়াল করে রাখছি। বিয়ে আর বৌ নিয়ে ভেতরের এই উত্তেজনা আর উত্তাল আগ্রহটা কোনভাবে প্রকাশ হয়ে পড়লে কেলেঙ্কারীর আর শেষ থাকবে না। নিজেকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে সামলাই। ধীরে, বন্ধ,ু ধীরে!
কিন্তু বাড়ির সবাই এমন চুপচাপ, নীরব কেন!
নিশ্চয়ই সবার ঘুম পেয়েছে। ইশ! আমার জন্য এরা কষ্ট করে এতো রাতঅবধি জেগে আছে, ভাবতেই নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে। দ্রুত খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ি। তবে তার আগে সবাইকে ঘুমুতে যাওয়ার অনুরোধও করে ফেলি সুযোগ বুঝে। বড় হয়েছি, বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাড়ির সকলের প্রতি দায়িত্বশীল তো হতেই হবে, তাই না?
বড় বোনটি মুখ ভার করে দরজায় এসে দাঁড়ায়- ভেতরে আসবো, ভাইটি?
-হ্যাঁ, আপু, আসেন।
লাজুক হেসে সম্মতি জানাই। নির্ঘাত কনে সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবে। দারুণ লজ্জা লাগতে থাকে। সংকোচে যেন মিশে যাই মাটির সাথে।
বেশ খানকটা সময় চুপ থেকে আপু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। শুকনো দুখি দুখি কণ্ঠে বলেনÑ আসলে তোকে কি করে যে কথাটা বলব তাই ই ভেবে পাচ্ছি না। তোর জন্য যে মেয়েটিকে আমরা কনে হিসেবে ঠিক করে রেখেছিলাম, সে আজ সন্ধ্যায় তার প্রেমিকের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন